পানিতে ডুবছে কৃষকের স্বপ্ন

ফসল ঘরে তুলতে না পারায় প্রতিটি এলাকায় কৃষকের আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে উঠছে। একমাত্র বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল কৃষকদের বুক ফাটা আর্তনাদে হাওরাঞ্চলে অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করছে। ফসল ডুুবে যাওয়ার কারণ হিসেবে বৈরী আবহাওয়ার পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিযুক্ত স্থানীয় পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি) ও ঠিকাদারদের খামখেয়ালিপনাকে দায়ী করছেন কৃষকরা। তারা হাওর রক্ষা বাঁধে ঠিকমত কাজ করেনি। ফলে বাঁধ ভেঙ্গে ফসল ডুবছে।
এ অঞ্চলের কৃষকের একমাত্র ভরসা বোরো ফসল। আয়ের একমাত্র উৎস এ ফসল। এ ফসলের উপর নির্ভর করেই অনেক স্বপ্ন দেখেন তারা। আগামী দিনের পরিকল্পনাও করেন। তাদের সারা বছরের খোরাক চলে। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বিয়ে-শাদিসহ সব ব্যয় নির্বাহ করেন ফসল দিয়ে। একমাত্র বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল এ অঞ্চলের অধিকাংশ হাওর ইতোমধ্যে ডুবে গেছে। প্রতিদিনের বৃষ্টিপাতে পানি বাড়ছে হাওরে। সৃষ্টি হচ্ছে পানিবদ্ধতা (ডুবরা)। হাওর রক্ষাবাঁধ ভেঙ্গে ও ডুবরার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে বিশাল বিশাল হাওর। ইতিমধ্যে জেলার ধর্মপাশা উপজেলার ৫টি হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ফসল তলিয়ে গেছে। গত দু’দিনে ধর্মপাশা উপজেলার ধারাম হাওরের উলাসখালি ও দৌলতপুর এলাকার বাঁধ ভেঙ্গেছে। টগার হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ফসল ডুবেছে। জগন্নাথপুর উপজেলার বিশাল নলুয়ার হাওর ডুবেছে। এ সকল হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার খবর জানিয়েছেন এলাকার কৃষকরা।
সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতি বছরই হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করে। এবারও হাওর রক্ষা বাঁধে কাজ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিযুক্ত ঠিকাদার ও পিআইসি। তবে অসময়ে এ কাজে হাত দেয় তারা। ফলে দুর্বল বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পানি বাড়ার সাথে সাথে ভেঙ্গে যাচ্ছে এ সকল বাঁধ। কৃষকদের অভিযোগ- তারা ঠিকমত বাঁধের কাজ করেনি। তাদের দায়সারা কাজে কৃষকদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে। ফসল খোয়া যাওয়ায় তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। কৃষকদের খোরাকি নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে তারা। এদের গাফিলাতির কারণে হাওর পাড়ের কৃষকরা আজ পথে বসেছে। জেলার প্রতিটি এলাকার কৃষকের কান্নায় ও আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে উঠছে। শত চেষ্টা করেও অনেক এলাকায় বাঁধ রক্ষা করতে পারেনি কৃষকরা। হাওর রক্ষার জন্য প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের সূত্র মতে, এবারও এ এলাকার জন্য বরাদ্দ এসেছে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। কোটি কোটি টাকা খরচ করার পর কেন বাঁধের কারণে ফসল নষ্ট হবে, এ প্রশ্ন এখন কৃষকদের। হাওর পাড়ের কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। তাদের চোখের সামনে এখন অন্ধকার। তাদের স্বপ্ন ছিল এ ফসল ঘরে উঠিয়ে ধারদেনা শোধ করবেন। নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মিটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবেন। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। দিরাই উপজেলার বরাম হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়েছে ফসল। তাহিরপুর উপজেলার বৃহৎ শনির হাওর, হালির হাওর, সোনামোড়ল হাওরের ফসল প্রচন্ড ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যে কোন সময় এ সকল হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ফসল তলিয়ে যেতে পারে। স্থানীয় লোকজন ও কৃষকরা কিছু কিছু হাওরে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে দিনরাত কাজ করছেন। যাতে কোন উপায়ে ঠেকানো যায় বাঁধ ভাঙ্গার চাপ।
এদিকে বিশ্বম্বরপুর এলাকার করচার হাওরের ফসল ৫০ ভাগ তলিয়ে গেছে। এ ছাড়াও এ উপজেলার আঙ্গারুলির হাওরের ৫০ ভাগ ফসল নিমজ্জিত হয়ে গেছে। বাকিটুকু যায় যায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। যে কোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে বাকি ফসলটুকু তলিয়ে যেতে পারে। ফতেপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মহিবুর রহমান জানান, বৃহৎ খরচার হাওর যায় যায় অবস্থা। বাঁধে ঠিকমতো কাজ হয়নি। ফতেপুর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড মেম্বার আব্দুল হেকিম জানান, এলাকার পনার হাওর, সজনার হাওর ডুবে গেছে। এ এলাকার বেশীর ভাগ হাওরের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নাই। তাই বৃষ্টিপাতে ডুবরার সৃষ্টি হয়েছে এবং ধীরে ধীরে ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। নদীগুলোও ভরাট হয়ে গেছে। হাওর থেকে পানি বের হওয়ার কোন সুযোগ নাই। তিনি আরো বলেন, হালির হাওরের বাঁধে ঠিকমত কাজ না করায় হাওরটি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের ডাকুয়ার হাওরের ৫০ ভাগ ফসল ডুবে গেছে। বৃহৎ শনির হাওরের ২৫ ভাগ ফসল ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে। কৃষকরা জানান, শনির হাওরের নান্টু খালির বাঁধ ডেবে গেছে। যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। জামালগঞ্জ উপজেলার বেহলী ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নির্মাল্য কান্তি রায় ওরফে সসীম বাবু ইনকিলাবকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদাররা হাওর রক্ষা বাঁধে ঠিকমত কাজ করেনি। তারা ঠিকমত কাজ না করায় আজ বাঁধগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। শনির হাওর পাড়ের বিশিষ্ট সমাজ সেবক শওকত মিয়া জানান, শনির হাওর, হালির হাওরের ফসল মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাঁধ ভেঙ্গে এ দু’টি হাওরের ফসল যে কোন সময় তলিয়ে যেতে পারে। কোন কোন পয়েন্টে মাটির কাজ করেনি ঠিকাদার ও পিআইসি। তিনি বলেন, রহমতপুর বেড়ি বাঁধে মাটির কাজ করেনি। তাই পুরাতন বাঁধটি ধসে পড়ছে। এলাকার লোকজন দিয়ে এখন কাজ করানো হচ্ছে। নান্টুখালির বাঁধসহ অন্যান্য বাঁধে জরুরী ভিত্তিতে কাজ করার দাবী জানান শওকত মিয়া। তিনি বলেন, শনির হাওর ডুবে গেলে সব সর্বনাশ হয়ে যাবে। কৃষকদের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়ে যাবে। কারণ, একমাত্র এ হাওরের উপর এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ নির্ভরশীল। জেলার দেখার হাওরসহ প্রায় সব কয়েকটি হাওরের ফসল এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
কৃষকদের অভিযোগ, দুর্বল বাঁধ নির্মাণ করেছে ঠিকাদার ও পিআইসিরা। বৃষ্টির সাথে সাথে বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। হাওর রক্ষা বাঁধ বৃষ্টির পানিতে গলে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। ঠিকাদার ও পিআইসিদের গাফিলাতির জন্য ফসলহানি হয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা।
এদিকে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাহেদুল হকের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলে জানানো হয় তিনি মিটিং-এ আছেন। ফলে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি। দিরাই-শাল্লার নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য ড. জয়া সেন গুপ্ত দিরাই উপজেলার ইনকিলাব সংবাদদাতাকে জানান, ফসল নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে এবং হাওর রক্ষা বাঁধে যারা দুর্নীতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টায় এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
নেত্রকোনা থেকে এ কে এম আবদুল্লাহ
গত ক’দিনের অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যেতে বসেছে নেত্রকোনা জেলার হাওর উপজেলা হিসেবে খ্যাত খালিয়াজুরী ও মোহনগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলের কৃষকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের সোনালি ফসল। গতকাল রোববার সকালে মোহনগঞ্জ উপজেলার গাগলাজুরে চর-হাইজদা বেড়িবাঁধের জালালপুর পয়েন্টে প্রায় ২শ’ ফুট বাঁধ ভেঙে গেছে।
গত ক’দিনের অব্যাহত বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পানিতে খালিয়াজুরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ধনু নদী ও মোহনগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি দ্রæত বৃদ্ধি পেয়ে নদীর দুই ক‚ল ছাপিয়ে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। আগাম বন্যায় বিগত বছরও ফসলহানি ঘটে। গত বছরের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এ বছর আশায় বুক বেঁধেছিল কৃষক। এ জন্য তারা ধারদেনা করে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে ইরি-বোরো ফসল রোপণ করেন। ফসল রোপণের পর শীতজনিত এবং বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে সেচের পানির অভাবে কৃষরা কিছুটা বেকায়দায় পড়েন। তারপরও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম আর পরিচর্যায় ধানের ফলন ভালো হয়েছিল। চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে আকস্মিক অনবরত বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে হঠাৎ করেই নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। কৃষকরা প্রতি বছর আগাম বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে বারবার উঁচু করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের দাবি জানিয়ে আসছে।
খালিয়াজুরী উপজেলার দেরাকান্দা গ্রামের মোশারফ হোসেন মাস্টার, কামাল মিয়া, ইব্রাহিম মিয়া, দুলাল মিয়া, সোলেমান আলীসহ অনেক কৃষকের অভিযোগ, তাদের বাড়ির সামনে হাওরের বাঁধ ভেঙে প্রায় শতাধিক একর জমির ফসল আকস্মিক ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। ঝুঁকিতে রয়েছে আরো কয়েকশ’ একর ফসলি জমি।
কৃষক কামাল মিয়া জানান, জমির ধান এখনো ভালো করে পাকেনি। তারপরও পানির সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁচা-পাকা ধান কাটতে সকালে জমিতে যাই। দুই ঘণ্টার মধ্যে চোখের সামনে আমার সোনালি ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। এত দ্রæত পানি চলে আসবে আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি। ধান কাটার জন্য আমরা প্রস্তুতও ছিলাম না। এখন কি করব নিজেও জানি না।
লেপসিয়া হাওরের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিম্নাঞ্চলের ফসল ইতোমধ্যেই পানিতে ডুবে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে হাওরে ঢলের পানি ঢুকে বিনষ্ট করে দিতে পারে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। জগন্নাথপুরের পুবের হাওর পানিতে তলিয়ে গেছে। বোয়ালী হাওরের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করে কোনো রকমে বাঁধ আটকে রাখা হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে পানি ঢুকে যেতে পারে হাওরে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নিমগ্ন জমিতে, তারা এখন কি করবে তা ভেবে পাচ্ছেন না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর