জীবনযুদ্ধে হাওরের লাখো মানুষ: উধাও প্রকৌশলী-ঠিকাদার

সুনামগঞ্জে দুর্নীতির কারণে হাওরের ত্রুটিপূর্ণ ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে বিস্তৃর্ণ জমির বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর যে সকল হাওর এখনো অক্ষত আছে সেগুলোকে রক্ষা করতে রাত দিন প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এই দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-ঠিকাদারদের থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ কোনো বাঁধে তাদের টিকিটির দেখাও মিলছে না। বোরো ফসল নিয়ে উদ্বিগ্ন জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।

রবিবার রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কৃষি বিভাগের তথ্যমতে জেলা তলিয়ে যাওয়া বোরো ফসলের পরিমাণ ২০ হাজার হেক্টর জানানো হলেও বাস্তবে সেটা অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন বোরো চাষীরা।

দুর্নীতির কারণে বার বার বছরের একটিমাত্র ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তির পরিপ্রেক্ষিতে এবার ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে চরম অনিয়ম ও দুনীতির প্রতিবাদের দাঁনা বাঁধতে শুরু করেছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে।

রবিবার বিকালে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরের উথারিয়া বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোব্ধ জনতা সুনামগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রায় দুইঘণ্টা ধরে অবরোধ করে রাখেন। পরে পাউবোর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, সরেজমিন গিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শফিউল আলমের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে অবরোধ তুলে নেয় বিক্ষোব্ধ জনতা।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায় বৃষ্টি ও নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার কারণে জেলার যেসব হাওরগুলো এখন অক্ষত আছে তার সবগুলোই রয়েছ ঝুঁকির মধ্যে। প্রতিটি ফসলরক্ষা বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে স্থানীয় মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। কিন্তু বাঁধের আশপাশে কোথাও দেখা মিলছে না বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা কিংবা ঠিকাদারদের।

বছরের পর পর সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল নিয়ে এমন উদ্বেগময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিষয়টি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের দৃষ্টি দেওয়ার দাবি কৃষকদের।

সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর জানায়, সুনামগঞ্জে চলতি মৌসুমে দুই লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান। যেখান থেকে ৮ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিকটন ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্র নির্ধারণ করা হয়। যার বাজার মূল্য ২ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। আবাদকৃত এই বোরো ফসলের দুই তৃতীয়াংশ আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সংস্থাটি ২২৫টি পিআইসি এবং ৪৮টি প্যাকেজের মাধ্যমে হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও পুরোনো বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ১০ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে হাওরের মূল ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ করেন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা। বাকি টাকা নামেমাত্র কাজ করে, কোথাও কোথাও কাজ না করে ঠিকাদারদের মাধ্যমে ব্যয় দেখানো হওয়ার প্রক্রিয়া করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয়রা জানান, জনগণে প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে হাওরের ফসলরক্ষা বাধ নির্মাণে জনপ্রতিনিধরা মোটমুটি কাজ করলেও অনেক ঠিকাদার নামমাত্র কাজ করায় হাওরের বোরো ফসল ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অনেক হাওরের বেড়িবাঁধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়োগ পাওয়া ঠিকাদার কোন কাজই করেননি। সরেজমিন তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর ঘুরে এমন অভিযোগের পাওয়া যায়। হাওরের সাহেবনগর বেড়িবাঁধে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু মাটি ফেলা হলেও বাকিটুকু অরক্ষিত রয়ে গেছে।

বাঁধ পরিদর্শন করতে আসা তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, ‘অধিক মুনাফার আশায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের এইসব অপকর্মগুলো করেছেন। আমার উপজেলায় শতকার ৯০ ভাগ বেড়িবাঁধে কোন কাজই হয়নি। বিষয়টি আমরা প্রতিবেদন আকারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো যাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কেউ পার পেয়ে যেতে না পারে।’

এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যর্থতার পর ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা তাদের বাঁশ, বস্তা, দড়ি নৌকা ইত্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করছেন।
সরেজমিন ঘুরে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের এই দৃশ্য দেখা গেছে শনির হাওরের লালুরগোয়ালা, নান্টুকালি, ঝালখালি, মাহলিয়া হওরের ময়নাখালি বাঁধে। তাহিরপুর উপাজলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল এসবের সমন্বয় করছেন। কৃষকের পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীরাও ফসল রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। লালুরগোয়ালা বাঁধে নিজে কাজ করছেন তাহিরপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান বুরহান উদ্দিন। রবিবার হাজার দুয়েক মানুষ এই বাঁধে দিনভর কাজ করেছেন। এ সময় পাউবোর কোন কর্মকর্তা কিংবা ঠিকাদারের দেখা পাওয়া যায়নি।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, হাওরগুলো রক্ষার জন্য আমরা বরাবর ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যুদ্ধ করি। কিন্তু এবারও হাওরের বেড়িবাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ থাকলেও কোন কাজই হয়নি। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা জুড়ে মাইকিং করিয়ে ফসলরক্ষা বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে মানুষকে অনুরোধ করেছিলাম। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজারো মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে যাচ্ছেন।

স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতে আসা তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সংশ্লিষ্ট সকলেই দুর্নীতিগ্রস্ত। তার ভাষায়, ‘অর আর টাউট।’ তিনি বলেন, তাদের হাওর ও হাওরের জনগণের প্রতি তাদের কোন মমত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা নেই। হাওরের ফসল রক্ষার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেন আর এরা সেটা ভাগবাটোয়রা করে খায়।’

রাজানগর গ্রামের কৃষক আব্দুস সোবহান বলেন, ‘কন্টাকটরার এত পাওয়ার যে, এমপিও এরার ধারে যাইতে পারে না। কাম না করিয়াই বিল তুলিয়া নেয়।’

কৃষকরা জানান, মোটা অঙ্কের বরাদ্দের পরও গত মৌসুমে পাহাড়ি ঢল ও অকাল বন্যায় দুর্নীতির কারণে দুর্বল ফসলরক্ষা বাঁধ তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জের ৮০ ভাগ বোরো ফসল। গতবছর বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হলে এবার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বলে জানান তারা

এদিকে, তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালি বাঁধ ভেঙে বিস্তৃর্ণ হাওরের ফসল পানি নিচে তলিয়ে গেছে। ওই প্রকল্পের সভাপতি ছিলেন দক্ষিণ শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বজিত সরকার। স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্মাণে অনিয়ম থাকায় এই বাঁধটি পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে গেছে ।

এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনারথাল, ফাসুয়া, গুরমা, বোয়ালা, শালদিঘা হাওরসহ কয়েকটি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ৩৯০৬ হেক্টর জমির ফসল। ফাসুয়া নদীর পাশে যে বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যায় সেটি নির্মাণে সরকরি বরাদ্দ ছিল ১০ লাখ টাকা। স্থানীয়রা জানান চৈত্র মাসের শেষ পর্যায়ে এসেও বাঁধের কাজ সম্পূর্ণ না করায় পানির চাপে এটি ভেঙে যায়। নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত ছিল জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব আহমদ।09

বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সভাপতি ও চামরদানী ইউপি চেয়ারম্যান জাকিরুল আজাদ মান্না অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মাছ ধারার জন্য রাতের আধারে দুর্বত্তরা বাঁধটি ভেঙে দিয়েছে।

রবিবার ধর্মপাশা উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন বাঁধে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একত্মতা পোষণ করেন উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব খান-সহ স্থানীয় আওয়ামী লীগে ও বিএনপি নেতারা।

এদিকে, জেলার অন্যতম প্রধান হাওর নলুয়ারহাওরের ডুমাখালি, শালিকা ও মাছুয়াখালি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি ঢুকে হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। গত দুদিন ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করেন শেষ রক্ষা করতে পারেননি কৃষকরা। এখানে বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি অভযোগ কৃষকদের।

উপজেলা কৃষি কর্তকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার জানান, এবছর নলুয়াহাওরসহ উপজেলার ছোটবড় ১৫টি হাওরে ২৫ হাজার হেক্টর বোরাধান চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে নলুয়ারহাওরে ১০ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে।
দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় একের পর এক বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে বোরো ফসল। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বরাম হাওরের তুফানখালী ও কডাইকালী বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এছাড়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এবং বাঁধের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় টাংনিরহাওর, কালিয়াকোটা হাওর, ছায়ারহারওরসহ ২৭টি হাওরের অনেক পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে

দিরাই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান তালুকদার জানান, পিআইসির কাজ ২ ফ্রেব্রুয়ারি ও ঠিকাদারের কাজ ৩১ মার্চের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও দিরাই ও শাল্লা উপজেলার অধিাকাংশ হাওরে কাজই হয়নি।

এছাড়া, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকার কারণে ৭ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে । এছাড়াল জামালগঞ্জ উপজেলায় বাঁধ ভেঙে ও জলাবদ্ধতায় ৭ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছর উদ্দিন বলেন, নদীর পানি হাওরের বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে অনেক বাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান এই কর্মকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর