সারাদেশে চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ ইউরিয়া সারই এই মৌসুমে ব্যবহৃত হয়। অথচ পিক মৌসুমকে সামনে রেখে শিল্প সচিব ইউরিয়া সারের মূল্য টনপ্রতি ৪ হাজার টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
এ বিষয়টি সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য সচিবদের সতর্ক করে দেন। সেই সঙ্গে বলে দেন, সারের মূল্য বৃদ্ধির কোন চিন্তা সরকারের নেই।
১৪ মার্চ মঙ্গলবার ‘সারের দাম বাড়বে না’ শীর্ষক শিরোনোমে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই সারের জন্য কৃষক মারা গেছে। আমরা সারের জন্য বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। ক্ষমতায় এসে আমরা সব ধরনের সারের দাম কমিয়েছি। যার সুফল কৃষক ভোগ করছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এই অবস্থায় ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সরকার কোনভাবেই ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধি করবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সারের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি নীতি নির্ধারণীমূলক। নীতি নির্ধারণী বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনপ্রতিনিধিদের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত। ৎ
বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, আগ বাড়িয়ে শিল্প সচিবের এরকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ সঠিক হয়নি। ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধির কোন চিন্তা সরকারের নেই।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, সারাদেশে সারের ব্যবস্থাপনা খুব ভালভাবে চলছে। কৃষককে এখন আর সারের পেছনে ছুটতে হচ্ছে না, সারই কৃষকের পেছনে ছুটছে। দেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এই অবস্থায় দাম বৃদ্ধি করা হলে সারের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।
জানা যায়, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে- এ অজুহাতে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবে বলা হয়, সরকার দীর্ঘদিন ধরেই ইউরিয়ায় ভর্তুকি দিয়ে আসছে। তারপরও সার উৎপাদন ও বিপণনে লোকসান বাড়ছে। এ অবস্থায় প্রতি টন ইউরিয়া সারের দাম বর্তমান ১৪ হাজার টাকার স্থলে ১৮ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছেন সিনিয়র শিল্প সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। যা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হযেছে। প্রস্তাবের অনুলিপি দেয়া হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়কেও।
এতে দেখা যায়, ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধি হলে টনপ্রতি দাম বাড়বে ৪ হাজার টাকা এবং ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি দাম বাড়বে ২০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি ইউরিয়ার সারের দাম ৪ টাকা বেড়ে যাবে।
গত ২০ ডিসেম্বর বিসিআইসি কর্তৃক উৎপাদিত ইউরিয়া সারের বিক্রয়মুল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত এক সভা শিল্প সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ‘প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের সাথে গড়ে ১৫ শতাংশ মার্জিন বিবেচনা করে সরকার কর্তৃক ভর্তুকি অথবা টনপ্রতি ইউরিয়া সারের ৪ হাজার টাকা হিসাবে ভর্তুকি প্রদান বা সরকার কর্তৃক টনপ্রতি ইউরিয়ার বিক্রয় মুল্য ১৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করা।’
এই সভায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব উপস্থিত ছিলেন। তিনি ওই মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপত্তি জানান। তিনি বলেন, বর্তমানে ইউরিয়া সারের কেজিপ্রতি মূল্য ১৪ টাকা, এমওপি সারের কেজিপ্রতি মূল্য ১৩ টাকা, টিএসপি সারের কেজিপ্রতি মূল্য ২০ টাকা এবং ডিএপি সারের কেজিপ্রতি মূল্য ২৩ টাকা নির্ধারিত আছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে বলেন, ভর্তুকি কমাতে ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে মাঠ পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক ডিলার সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে ইউরিয়া সার মজুদ করছে বলে অভিযোগ আসছে। বরং তারা সারের দাম বাড়বে এই খবরে কারখানা ও বাফার গুদাম থেকে বেশি করে ইউরিয়া সার উত্তোলন করছে।
অন্যদিকে, ডিলাররা একের পর এক ঢাকায় বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) অফিসে ফোন করে জানতে চাইছে সরকার সারের দাম বাড়াচ্ছে কি না? ইউরিয়া সারের এই মূল্য বৃদ্ধির খবরে মাঠ পর্যায়ে এক প্রকার হুলস্থুল পড়ে গেছে। যদিও বিএফএ অফিস থেকে বলা হচ্ছে, ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধির কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সরকার কেজিপ্রতি ইউরিয়া সারের বিক্রয় মূল্য ১৮ টাকা থেকে কমিয়ে ১৪ টাকা নির্ধারণ করেছে। দেশ এর সুফল পাচ্ছে। দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে। ফলে খাদ্যশস্য আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। কৃষি খাতে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে, কৃষি মন্ত্রণালয় তাকে ভর্তুকি মনে করছে না। মন্ত্রণালয় এটাকে বিনিয়োগ হিসাবে দেখছে। তাছাড়া, বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম ভর্তুকি দিচ্ছে কৃষি খাতে। অথচ রিটার্ন পাচ্ছে অনেক বেশি।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ্ বলেন, ‘সরকার ইউরিয়া এবং নন-ইউরিয়া সারের দাম কমিয়েছে। ফলে এর সুফল কৃষক পাচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধির কোন প্রয়োজন নেই।’
কৃষি বিশেষজ্ঞরাও আশঙ্কা করছেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত বিবেচনা করা হলে কৃষকের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদনে। যদিও সরকার কয়েক বছর ধরে প্রতি টন ইউরিয়া সারে ২ হাজার ৭৯৬ টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে।
কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এ ভর্তুকি বড় ভূমিকা রাখছে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ইউরিয়া সার। সরকার নিজস্ব উৎপাদন এবং আমদানির মাধ্যমে এ সারের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৫ লাখ টন। এই চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় চলতি বোরো মৌসুমে। এ কারণেই এই মৌসুমকে ইউরিয়া সারের পিক মৌসুম বলে। এই মৌসুমে বোরো ধানের জমিতে তিন দফা ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। ইতোমধ্যে প্রথম দফা সার দেয়া শেষ। দ্বিতীয় দফার প্রায় ৫০ ভাগ দেয়া হয়েছে। এই মার্চ মাসের মধ্যেই বাকি অর্ধেক এবং তৃতীয় দফা সার প্রয়োগ করতে হবে।
জানা যায়, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) ক্রমাগত লোকসান ঠেকাতেই সারের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়, বিসিআইসি কর্তৃক প্রতি টন ইউরিয়া সারের গড় মূল্য ১৬ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। কিন্তু সরকার নির্ধারিত মূল্য হচ্ছে ১৪ হাজার টাকা। ফলে এক টন সারে লোকসান হচ্ছে ২ হাজার ৭৯৬ টাকা। আরও বলা হয়, প্রত্যেক শিল্পকারখানা মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশায় পরিচালনা হচ্ছে। কিন্তু বিসিআইসির সার কারখানাগুলো ক্রমাগত লোকসানের কারণে আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সুষ্ঠুভাবে কারখানাগুলো পরিচালনার স্বার্থে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো আবশ্যক।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, বিসিআইসি’র ইউরিয়া সার কারখানাগুলো নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বিদ্যুত উৎপাদন গ্যাসনির্ভর হওয়ায় এ খাতে ব্যয় বাড়ছে। সরকার ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতে গ্যাসের মূল্য ৪ দশমিক ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছে। এ দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে বিদ্যুত উৎপাদনে। এছাড়া নতুন শাহ জালাল সার কারখানায় উৎপাদিত সারের বেশিরভাগই দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে সরবরাহ হচ্ছে। এক্ষেত্রে সার লোড-আনলোড এবং পরিবহনে ২ হাজার টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে। যে কারণে সারের গড় উৎপাদন মূল্য বেড়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে সরকারের নির্ধারিত প্রতি টন ১৪ হাজার টাকা মূল্যে।
আগামীতে ইউরিয়া সারের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে- এ আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রস্তাবে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ইউরিয়া সারের সম্ভাব্য ব্যয়ের একটি ধারণা সেখানে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এজন্য ব্যয় হবে ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ওই হিসাবে প্রতি টন সারের উৎপাদন মূল্য হবে ২০ হাজার ৩০ টাকা।
এর পরবর্তী অর্থবছর ২০১৭-১৮ সালে ১৪ লাখ ২৫ হাজার টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এজন্য ব্যয় হবে ২ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। ওই হিসাবে প্রতি টন সারের মূল্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার ২৭০ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪ লাখ ২৫ হাজার টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এজন্য ব্যয় হবে ১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ওই হিসাবে প্রতি টন সারের মূল্য ১৬ হাজার ১৫০ টাকায় উন্নীত হবে।