গ্রামীণ মধ্যবিত্ত্য গৃহস্থ পরিবারে জন্ম। বড় হয়েছি মফস্বল শহরে। আমার শৈশব, দূরন্ত কৈশোর আর তারুণ্যের শুরুটা এখানেই। তাই আমার শিক্ষা, ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গির একটা বিরাট এলাকা জুড়ে আছে গ্রাম, হাওর ও মফস্বলের প্রভাব।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহর থেকে জন্মভূমি নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামটির দূরত্ব গুগোল মানচিত্র অনুযায়ী মাত্র ২৪ কিলোমিটার। কিন্তু আবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় এটা ছিলো অনেক দূরের পথ। রিকশা, নৌকা, পায়ে হাঁটা ছিলো যাতায়াতের মাধ্যম। সময় লাগতো প্রায় সারাদিন। তখন রিকশায় ইঞ্জিন ছিলো না, নৌকা বাইতো মাঝি সাথে দাঁড়, ছোট বেলায় কাঁধেও চড়েছি হাঁটতে না পেরে। এখন চাইলে এক ঘন্টায় পৌঁছানো যায়। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপ ভ্যান, মোটর সাইকেল, চাইলে প্রাইভেট কার…
আমার বুবু (দাদি) খুব গর্ব করে বলতেন, সয়াবিন তেল আর লবণ ছাড়া কিছুই আমাদের বাজার থেকে কিনতে হয় না। নতুন ধান ঘরে তুলে উঠানেই চাল করা হতো। নিজেদের পুকুর, বিল আর নদীতে মাছ তো ছিলোই। পুকুর পারে ছিলো মরিচ আর ধনেপাতার সমারোহ, পাশেই সর্ষে ক্ষেতের সমুদ্র। বাড়ির আঙ্গিনায় ফলতে দেখেছি সবুজ সবজি। মাচায় করে টিনের চাল ছুঁয়ে উঠতো শিম, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, কাকরুল, ঝিঙ্গে। আমাদের গাছের সজনে গোটা পাড়া বিলোতেও শেষ হতো না। বাড়ির পেছনে দেখেছি জাম্বুরা গাছ, তেঁতুল গাছ, বিশাল বিশাল আম, জাম আর বেল গাছের সারি। কলের (টিউব-ওয়েল) পাশেই ছিলো কলা গাছের ঝোপ। খালের কিনারায় শীতের সবজি, বাঁশ বাগান…
একবার আমার ভাই (দাদা) একঝাঁক পোনা মাছের পেছনে সারারাত ছুটে ভোর বেলায় বাড়ি ফিরেছেন পোনা সমেত। আম্মাকে খুব ভালোবাসতেন ভাই, তিনিও আম্মা ডাকতেন আমার মতোই। আম্মা নাকি পোনা মাছ খেতে চেয়েছিলেন। এতো মাছ আমাদের বিলে পাওয়া যেতো, আত্মীয় স্বজনকে বিলিয়েও শেষ হতো না, জিয়ল মাছ বাড়ির উঠানে গর্ত করে জিইয়ে রাখা হতো। মাছ লবণ দিয়ে মাখিয়ে কখনো না সিদ্ধ করে দিনের পর দিন সংরক্ষিত করা হতো আপদকালের জন্য।
খাবার ঘরে আর যাবারের (ধান রাখার পাত্র বিশেষ) ঘরে পেঁয়াজ, রসুন থোকা থোকা ফুলের মতো মালা বানিয়ে তোড়া করে সাজিয়ে রাখা হতো। ভুলে যাই কীভাবে, নিজের চোখে দেখা…
বিদ্যুৎ ছিলো না, মাটির কলসে পানি ধরে রাখা হতো। সেই পানি ছিলো বরফের মতোই শীতল। আমাদের বাড়িতে বিশাল আকারের নারকেল গাছ ছিলো কয়েকটা, কিছু ছোট আকারেরও ছিলো, চাইলে আমরা নিজেরাও চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে বা বাশের কুটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিচে নামিয়ে ফেলতে পারতাম। সুপারি গাছ ছিলো প্রচুর।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ, সংগঠিতকরণ ও নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে গোটা উপজেলায় শুধু আমাদের বাড়িটাই পাকিস্থানি আর্মি পুড়িয়ে দিয়েছিল। তার পরেও অসাধারণ ছিলো আমার দেখা আমাদের গ্রামের বাড়ি। হাওরের ঠিক সামনেই ছিল আমাদের বসত। কোন ধরনের বাঁধ বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় ভাঙনের কবলে পড়ে আজ আর তেমন বিশেষ কিছুই নেই। আমি যা দেখেছি তাও নেই। সবচেয়ে বেশি যেটা নেই, সেটা হচ্ছে আমাদের জৌলুস আর ভাটির সংস্কৃতি…
বিকেল পেড়িয়ে সূর্য ডোবার আগের মুহূর্তে অদ্ভুত একটা সোনালী আলোর আভা ছড়িয়ে পড়তো, গোধূলি লগ্নে। এই আলোতে সব কিছুই খুব সুন্দর দেখায়, কেউ কেউ একে “কন্যা সুন্দর আলো” বলে। শুনেছি এই সময় ছাড়া বিয়ের কনে দেখানো হতো না। কনে দেখা হতো খোলা উঠোনে বর পক্ষের মুরুব্বিদের সামনে। মুরুব্বিদের প্রধান্য ছিলো পছন্দ অপছন্দ ও বিয়ের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে। পান-চিনি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে (পাড়া প্রতিবেশী ও নিকট আত্নীয় পরিজন) উপস্থাপন করা হতো নতুন সম্বন্ধের কথা। সমাজের অনুমতি নেয়া হতো।
বাড়ির বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েদের সপরিবারে দাওয়াত করে বাপের বাড়ি আনা হতো। গাঁয়ে হলুদের দিনে গীত গাইতে দেখেছি পাড়ার ভাবিদের, মেয়েদের। সাধারণত কলাগাছ পুঁতে বিয়ের গেইট সাজানো হতো। গ্রামের প্রবেশ পথে গ্রামের তরুণ যুবারা, বিয়ে বাড়ির আগে গ্রামের জামাইরা, বিয়ে বাড়ির সামনে কনের ছোট ভাই-বোনেরা আর সব শেষে নতুন জামাইকে অতিক্রম করতে হতো বাড়ির ভাবিদের গেইট, তবেই শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ।
ঐতিহ্যবাহী পাক্কন পিঠা, ডুবা পিঠা, পাপড়, মিষ্টি এবং অতি অবশ্যই শরবত সহযোগে বরযাত্রীদের স্বাগত জানানো হতো। আমাদের বাংলা ঘরেই (বৈঠকখানা) হতো পাড়ার সব বিয়ের আয়োজন। কনের জন্য আনা উপহার তথা বাজার-সদাই সবার সামনে কনের অভিভাবকদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হতো। আমি যৌতুক নিতে বা এটা নিয়ে কোন দর কষাকষি হতে দেখিনি, তবে শুনেছি কনেপক্ষ আগেই বলে দিতো, জামাইকে তারা কী কী উপহার দিতে পারবে। সেই ক্ষেত্রে বাইসাইকেল, টেলিভিশন, ক্যাসেট প্ল্যায়ার সাথে ব্যাটারি, সোনালী হাতঘড়ি ছিলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ক্যাসেট প্লেয়ারকে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে কেউ দেখেছে কি না জানি না, তবে আমি দেখেছি। বিয়ে বাড়িতে লাঠিখেলার দল আনতেই হবে। পালকি ছাড়া কনে শ্বশুরবাড়ি কীভাবে যাবে?
বাড়িতে অতিথি এলে ডাবের পানি কিংবা লেবু শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। বাজারের সময় না থাকলে বাড়িতে থাকা মোরগ জবাই করা হতো। নিতান্তই অপারগ হলে বৈদা (ডিম) তো আছেই। গৃহস্তের অমঙ্গল হবে বিধায় শুধু পানি কখনই দেয়া হতো না। জলখাবারের অনুষঙ্গ কিছু না থাকলে খই মুড়ি, নাড়ু, কদমা কিংবা গুড় থাকবেই থাকবে।
সূর্য উঠার আগে এখানে দিন শুরু হতো, নামাজ পড়ে মুনি (শ্রমিক) নিয়ে জমিতে (বন্দ বলা হয়) যেতো কৃষক। পেট ভরে ভাত খেয়ে তবেই দিন শুরু। ক্ষেতের লাইলে (আইল) বসে কখনোবা সুখটান দিতো হুক্কায়। দুপুরের খাবার বাড়ি থেকে আসবে। সাধারণত বাড়ির ছোট ছোট শিশু কিশোরেরা এই দ্বায়িত্ব পালন করতো সানন্দে। পরন্ত বিকালে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতো সবাই। নদীতে গোসল করে গায়ে তেল মেখে সন্ধ্যায় বাজারে গিয়ে ক্ষণিকের আড্ডায় ভুলে যেতো সারাদিনের ক্লান্তি। মাগরিবের নামাজের পড় থেকেই রাতের খাবারের তোড়জোড় শুরু হয়ে যেতো, আর এশার নামাজের পর কারো সাড়া শব্দ পাওয়া ছিলো মুশকিল।
নতুন ধান উঠতে না উঠতেই হাওর হয়ে যেতো বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর। পানিবন্দি ভাটির মানুষের তখন ছুটি, কোন কাজ নয়। যাত্রাপালা হতো এখানে সেখানে। দল বেঁধে যেতো সবাই। কেউবা নিজেদের উদ্যোগে নাটক মঞ্চস্থ করতো। বাড়ির মেয়েদের নাইওর আনা হতো। মেলা হতো কোথাও কোথাও, আর সেই উপলক্ষে সেখানে বিরাজ করতো ঈদ বা পূজা পার্বণের আমেজ।
চাষের জন্য একমাত্র ভরসা ছিলো হালের লাঙ্গল। ধান কাটার জন্য উজান থেকে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ থেকে শ্রমিক আনা হতো এখানে। মাথায় করে ধানের আটি আসতো উঠানে। ড্রামের উপর পিটিয়ে ধান ঝড়ানো হতো। তার পর হালের গরু দিয়ে মাড়িয়ে অবশিষ্ট ধান সংগ্রহ করে খড় গুলো শুকিয়ে খেড়ের লাস (খড়ের গাঁদা) বানানো হতো। এটাও ছিলো একটা দেখার মতো উৎসব।
একে অপরের সহযোড়িতায় এগিয়ে আসতো। আরেকটা বিশেষত্ব ছিলো, যে বাড়িতে খেড়ের লাস বসতো, তারা দুপুরের খাবারের আয়োজন করতো। সেখানে সাধারণত খুব ছোট ছোট টুকরো মুরগির মাংস আর সাথে প্রচুর আলু, সরুয়া (ঝোল), ঝাল সেইরকম…
মিষ্টি আলু আর ছোট দেশীয় জাতের আলু, খুব হতো আমাদের এখানে। আলু উঠিয়ে নেয়ার পর গ্রামের বাচ্চারা সেখান থেকে কুড়িয়ে পেতো আরো অনেক আলু, সেগুলো পুড়িয়ে খেতে যে কি মজা…
এপর্যন্ত যা বলেছি, সেটা এই প্রজন্মের কাছে হয়তো গালগপ্প মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই ছিলো আমাদের ভাটির একটি ছোট্ট গ্রামের দৈনন্দিন জীবনাচার। কালের পরিক্রমায় প্রযুক্তির আগ্রাসন ও নগরায়নের প্রভাবে সব উলটপালট হয়ে গেছে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ে আজ স্বস্থির বড় অভাব। এখন আমরা বাজার থেকেই সব কিনে খাই। ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান শুনি না। বিদ্যুতের অনাচারে পলাতক জোছনা। ইঞ্জিনের শব্দে নদীতে কান পাতা দায়…