ঢাকা ০২:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভ্যান চালকের লজ্জা আছে, আমাদের নেই

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৭:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
  • ২৯৮ বার

আমরা মানে ‘বাংলাদেশি বাঙালি’রা মানুষ হিসেবে এতো বেশি পরশ্রীকাতর যে, মর্যাদায়, যোগ্যতায় কিংবা সুযোগে যদি অন্য কোনো বাঙালি এগিয় যায় তবে আমাদের যেন গা জ্বলে। অপরের ভালো আমরা কেউ দেখতে পারি না। এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখি।

এই ধরুন গোপালগঞ্জের ইমাম শেখের কথাই বলি। ভ্যান চালান। সংসারে বাবা, মা, ভাই আর তিন বোন। বাবা আব্দুল লতিফ মানসিক রোগী, মা গৃহিণী। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোন পড়ালেখা করছে। আর এক ভাই ঢাকায় চাকরি করেন। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছোট থেকেই সংসার জোয়াল কাঁধে তুলে নেন তিনি। একটু ভাবুন, তিনি এ জন্য চুরি করতে পারতেন, ডাকাতি করতে পারতেন, যে কোনো প্রকার খারাপ পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারতেন, জঙ্গিও তো হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সৎ পথে ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। একদিন গল্প, সিনেমার মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভ্যানে চড়লেন। রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানাল সে ঘটনা। আর ইমাম শেখ যেন আলাদীনের চেরাগ পেলেন। ভাবলেন, এই সুযোগ জীবনে আর পাওয়া যাবে না। ভ্যান চালাচ্ছেন আর ভাবছেন, প্রধানমন্ত্রী তো এলাকার বড় আপা। আপার কাছে একটা চাকরির কথা বলতে সমস্যা কি। কিন্তু তিনি লজ্জায় বলতে পারলেন না। এতো বড় সুযোগ মিস করেও অবশ্য ইমাম শেখের আফসোস হয়নি।

ভাগ্যবিধাতা হয়তো ইমাম শেখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ছিলেন। ইমাম শেখ চাকরির কথা না বলতে পারলেও দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত পারিবারিক অবস্থা ও জীবন যুদ্ধের কাহিনি শুনে তার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। যোগ্যতা অনুযায়ী বিমান বাহিনীতে দেওয়া হবে সেই চাকরি। যেহেতু তার পড়াশোনা তেমন নেই, তাই শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ীই তাকে চাকরি দেওয়া হবে। এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর হৈ চৈ শুরু হলো। যেন এ মহা অন্যায়! চারদিকে ঠাট্টা, মশকরা আর সমালোচনা। ভ্যান চালককে চাকরি দিতে হবে কেন? তাও আবার বিমান বাহিনীতে! সব পাগল হয়ে গেছে। এ হতেই পারে না – সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকজুড়ে বয়ে গেল সমালোচনার ঝড়।

সরকার, প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও ভ্যান চালক কেউ বাদ যায়নি এই চেঁচামেচি, সমালোচনা থেকে। সবচেয়ে বেশি যে কথাটা শোনা গেল তা হলো, সবাই এখন ভ্যান চালক হতে চায়। অনেকে পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন, কেন ভ্যান চালক হলেন না তার জন্য আফসোস করলেন। ভ্যান চালক হলে বিমান বাহিনীতে চাকরি পেতেন- এ ধরনের ঠাট্টা করলেন।

ইমাম শেখ বিমান বাহিনীর একটি বেকারিতে ৭ হাজার ৯৮৪ টাকার বেতনে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেলেন। কিন্তু ওইসব ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তির কান্নাকাটিতে মনে হলো, বাংলাদেশটা ইমাম শেখকে বুঝি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের পরশ্রীকাতরতা, আমাদের ঈর্ষা মাপার মতো কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি। আমি জানি না, প্রধানমন্ত্রী ইমাম শেখের চাকরির বিষয়টি জানেন কি না। আমার কথা হলো, যদি জানেনও এবং তার সম্মতি নিয়েই ইমামকে চাকরি দেওয়া হয় তাহলে কি তিনি অন্যায় করেছেন? অবশ্যই নয়। আসলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া উচিত।

বেকারত্ব কি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা? আর কোনো দেশে এই সমস্যা নেই? ইমাম শেখের চাকরিতে কি বেকারদের সম্ভাবনাময় পদটি পূর্ণ হয়ে গেলো। আমার কাছে মনে হয়েছে, যারা ইমাম শেখের চাকরিতে কান্নাকাটি করছেন, চিৎকার করছেন তারা প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেলে কী চাইতেন? হয়তো পুরো পরিবারের চাকরি চাইতেন। সর্বোচ্চ সুযোগ কীভাবে কাজে লাগানো যায় সে চেষ্টা করতেন। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর হাত-পা ধরতেন। এদের তো লজ্জা নেই। ইমাম শেখ লজ্জায় প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়েও চাকরির কথা বলতে পারেননি। তাদের সেই লজ্জাটুকু নেই। এ ক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে ইমামের যোগ্যতা তাদের চেয়ে বেশি বলেই আমি মনে করি।

আমাদের পরশ্রীকাতরতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই ধুকতে থাকা একটি পরিবার একটু ভালো থাকার আশ্বাস পেলে ইর্ষা হয়। হিংসা হয়। আমাদের মানসিকতা এমন যে, আমি ভালো না থাকলে কেউ ভালো থাকবে না। তাই ইমাম শেখ চাকরি পেলে আমাদের মনে হয়- সে পেল, আমি পাব না কেন। এই ঈর্ষা সব জায়গায় আছে। এ জন্যই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।’ আমরা বোধহয় এখনো ঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ভ্যান চালকের লজ্জা আছে, আমাদের নেই

আপডেট টাইম : ১১:৪৭:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

আমরা মানে ‘বাংলাদেশি বাঙালি’রা মানুষ হিসেবে এতো বেশি পরশ্রীকাতর যে, মর্যাদায়, যোগ্যতায় কিংবা সুযোগে যদি অন্য কোনো বাঙালি এগিয় যায় তবে আমাদের যেন গা জ্বলে। অপরের ভালো আমরা কেউ দেখতে পারি না। এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখি।

এই ধরুন গোপালগঞ্জের ইমাম শেখের কথাই বলি। ভ্যান চালান। সংসারে বাবা, মা, ভাই আর তিন বোন। বাবা আব্দুল লতিফ মানসিক রোগী, মা গৃহিণী। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোন পড়ালেখা করছে। আর এক ভাই ঢাকায় চাকরি করেন। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছোট থেকেই সংসার জোয়াল কাঁধে তুলে নেন তিনি। একটু ভাবুন, তিনি এ জন্য চুরি করতে পারতেন, ডাকাতি করতে পারতেন, যে কোনো প্রকার খারাপ পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারতেন, জঙ্গিও তো হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সৎ পথে ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। একদিন গল্প, সিনেমার মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভ্যানে চড়লেন। রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানাল সে ঘটনা। আর ইমাম শেখ যেন আলাদীনের চেরাগ পেলেন। ভাবলেন, এই সুযোগ জীবনে আর পাওয়া যাবে না। ভ্যান চালাচ্ছেন আর ভাবছেন, প্রধানমন্ত্রী তো এলাকার বড় আপা। আপার কাছে একটা চাকরির কথা বলতে সমস্যা কি। কিন্তু তিনি লজ্জায় বলতে পারলেন না। এতো বড় সুযোগ মিস করেও অবশ্য ইমাম শেখের আফসোস হয়নি।

ভাগ্যবিধাতা হয়তো ইমাম শেখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ছিলেন। ইমাম শেখ চাকরির কথা না বলতে পারলেও দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত পারিবারিক অবস্থা ও জীবন যুদ্ধের কাহিনি শুনে তার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। যোগ্যতা অনুযায়ী বিমান বাহিনীতে দেওয়া হবে সেই চাকরি। যেহেতু তার পড়াশোনা তেমন নেই, তাই শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ীই তাকে চাকরি দেওয়া হবে। এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর হৈ চৈ শুরু হলো। যেন এ মহা অন্যায়! চারদিকে ঠাট্টা, মশকরা আর সমালোচনা। ভ্যান চালককে চাকরি দিতে হবে কেন? তাও আবার বিমান বাহিনীতে! সব পাগল হয়ে গেছে। এ হতেই পারে না – সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকজুড়ে বয়ে গেল সমালোচনার ঝড়।

সরকার, প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও ভ্যান চালক কেউ বাদ যায়নি এই চেঁচামেচি, সমালোচনা থেকে। সবচেয়ে বেশি যে কথাটা শোনা গেল তা হলো, সবাই এখন ভ্যান চালক হতে চায়। অনেকে পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন, কেন ভ্যান চালক হলেন না তার জন্য আফসোস করলেন। ভ্যান চালক হলে বিমান বাহিনীতে চাকরি পেতেন- এ ধরনের ঠাট্টা করলেন।

ইমাম শেখ বিমান বাহিনীর একটি বেকারিতে ৭ হাজার ৯৮৪ টাকার বেতনে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেলেন। কিন্তু ওইসব ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তির কান্নাকাটিতে মনে হলো, বাংলাদেশটা ইমাম শেখকে বুঝি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের পরশ্রীকাতরতা, আমাদের ঈর্ষা মাপার মতো কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি। আমি জানি না, প্রধানমন্ত্রী ইমাম শেখের চাকরির বিষয়টি জানেন কি না। আমার কথা হলো, যদি জানেনও এবং তার সম্মতি নিয়েই ইমামকে চাকরি দেওয়া হয় তাহলে কি তিনি অন্যায় করেছেন? অবশ্যই নয়। আসলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া উচিত।

বেকারত্ব কি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা? আর কোনো দেশে এই সমস্যা নেই? ইমাম শেখের চাকরিতে কি বেকারদের সম্ভাবনাময় পদটি পূর্ণ হয়ে গেলো। আমার কাছে মনে হয়েছে, যারা ইমাম শেখের চাকরিতে কান্নাকাটি করছেন, চিৎকার করছেন তারা প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেলে কী চাইতেন? হয়তো পুরো পরিবারের চাকরি চাইতেন। সর্বোচ্চ সুযোগ কীভাবে কাজে লাগানো যায় সে চেষ্টা করতেন। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর হাত-পা ধরতেন। এদের তো লজ্জা নেই। ইমাম শেখ লজ্জায় প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়েও চাকরির কথা বলতে পারেননি। তাদের সেই লজ্জাটুকু নেই। এ ক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে ইমামের যোগ্যতা তাদের চেয়ে বেশি বলেই আমি মনে করি।

আমাদের পরশ্রীকাতরতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই ধুকতে থাকা একটি পরিবার একটু ভালো থাকার আশ্বাস পেলে ইর্ষা হয়। হিংসা হয়। আমাদের মানসিকতা এমন যে, আমি ভালো না থাকলে কেউ ভালো থাকবে না। তাই ইমাম শেখ চাকরি পেলে আমাদের মনে হয়- সে পেল, আমি পাব না কেন। এই ঈর্ষা সব জায়গায় আছে। এ জন্যই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।’ আমরা বোধহয় এখনো ঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।