বেসরকারি টিভি চ্যানেলের জন্য সুখবর

ডক্টর শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ:বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো গভীর সঙ্কটের মুখে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক চ্যানেলের পক্ষে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে বাধাহীন অনুষ্ঠান প্রচারের পাশাপাশি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশী বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হওয়ার ফলেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যা হোক, অবশেষে সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে।
গত ৫ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে মিডিয়া ইউনিটি নামে নবগঠিত সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিযোগে বলা হয়েছিল, এ দেশের কিছু পণ্যের বিজ্ঞাপন ভারতের টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ায় বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলের আয় কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশী টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। তেমনি অবস্থায় বেকার হয়ে যাবেন অনেক সাংবাদিক, কলাকুশলী ও শ্রমিক-কর্মচারী। আনুমানিক একটা হিসাব দিয়ে মিডিয়া ইউনিটির নেতারা জানিয়েছেন, বিজ্ঞাপন প্রচারের নামে এ পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ ভারতে পাচার হয়ে গেছে। আরো বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অপেক্ষায় রয়েছে।
বিষয়টিকে মানিলন্ডারিং হিসেবে অভিহিত করে তারা বলেছেন, এর মাধ্যমে এক দিকে দেশীয় টিভিকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, অন্য দিকে অবৈধ পথে পাচার করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। তা ছাড়া সরকারও তার প্রাপ্য ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ জন্যই টাকা পাচার বন্ধের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে মিডিয়া ইউনিটি।
এক দিন পর সংবাদ সম্মেলন করেছে ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন। দেশের খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা এর সদস্য। মূল কথায় সংগঠনের নেতারাও ভারতীয় টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন প্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তারাও নভেম্বর মাসের মধ্যে ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের এবং দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে এ দেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন।
আমরা বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাংবাদিক ও কর্মকর্তাসহ কলাকুশলীদের দাবি ও মূল কথার সাথে একাত্ম এবং ভারতীয় বাংলাদেশী কোম্পানির বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করার জন্যও দাবি জানাই। আমরা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে গভীরে যাওয়ার তাগিদ দিতে চাই। বস্তুত পরিস্থিতি হঠাৎ এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এর পেছনে প্রধান কারণ পড়শি দেশের একটি মহলের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যাতে বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়। বিগত কয়েক বছরে অবস্থা এমন হয়েছে। বর্তমানে মনেই হয় না, বাংলাদেশে এখনো শিল্প-সংস্কৃতির স্বতন্ত্র বা স্বাধীন কোনো জগৎ আছে। অথচ নানাভাবে তৎপর আছেন দেশের সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্টজনেরা বিভিন্ন অঙ্গনে।
ভারতীয় মহলবিশেষের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে এ দেশেরই একটি বিশেষ গোষ্ঠী বহু বছর ধরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। অনেকের মতে, তাদের কারণেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ টিভি অনুষ্ঠান মানসম্পন্ন হতে পারেনি। মিডিয়া ইউনিটির নেতারাও বলেছেন, অনুষ্ঠান ভালো নয় বলেই বাংলাদেশের দর্শকেরা ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
এখন থেকে মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণের অঙ্গীকার করেছেন তারা, যাতে দেশী দর্শকদের ফিরিয়ে আনা যায় স্বদেশের টিভি চ্যানেলের দিকে। কথাটির তাৎপর্য লক্ষ করা দরকার। কারণ একই কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানিও তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে। এটাই স্বাভাবিক ব্যবসায় প্রসারের জন্য গ্রাহক বা ক্রেতা আকৃষ্ট করতে।
যে দর্শক তথা সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, সে দর্শকেরা এ দেশের নিম্নমানের গতানুগতিক অনুষ্ঠান দেখে না বললেই চলে। এ জন্যই বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিও ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং একতরফা দোষারোপের কোনো সুযোগ নেই। প্রতিবিধানের জন্য বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলকে অবশ্যই নিজেদের অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে হবে।
এ ব্যাপারে আমরা অবশ্য আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের সাথে সংশ্লিষ্টরা বিলম্বে হলেও বুঝতে পেরেছেন, কেন ভারতীয় টিভির বাধাহীন বিস্তার ঘটেছে এ দেশে এবং কেন বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল কঠিন প্রতিযোগিতা ও চাপের মুখে পড়েছে। এর ফলে এক দিকে বাংলাদেশী চ্যানেলের বিজ্ঞাপন আয় অনেক কমে গেছে, অন্য দিকে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল অর্থ।
বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য শুধু নয়, বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাহীন করার স্বার্থেও সরকারের উচিত ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রচার ও প্রাধান্যের অবসান ঘটানো। এটা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর