আইন ছাড়াই গঠন হচ্ছে ইসি

দেশে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়োগে কোনো আইন নেই। আইন প্রণয়ন ছাড়াই ইসি নিয়োগ দেওয়ায় সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। আগামী নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদরা। তাদের মতে, আইনের আওতায় রাষ্ট্রপতি ইসি গঠন করলে বিতর্কের অবসান হবে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংবিধান-স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ। সেখানে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইসি গঠন করা হয়। সেদেশের নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সংবিধানে ইসি গঠনের আইন প্রণয়ণের কথা বলা হলেও বিগত ৪৫ বছরে তা করেনি কোনো সরকার।

বিগত সরকারগুলো নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিয়েছে। অতীতের মতো এবারও আইন ছাড়া নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এতে রাজনৈতিক বিতর্কের পাশাপাশি আইনি জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে আইন প্রণয়নের বিষয়টি পরিকল্পনায় নেই বলেও সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে। শাসক দলের মতে, সংবিধান অনুযায়ীই রাষ্ট্রপতি ইসি নিয়োগ দেবেন। কাজেই কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হবে না।

ইসি গঠনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ চায় ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন গঠন এবং এই কমিশনকে শক্তিশালী করতে মোট ২০টি প্রস্তাবও দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক সংকট চলছে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী ইসি গঠনে সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। তাহলে আর বিতর্ক থাকবে না। এদিকে আগামী ইসি নিয়োগ একই প্রক্রিয়ায় করা হলে মার্চেই আদালতে বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হবে বলেও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, ইসি এর আগে দুই দফায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে তাগিদ দেয়। আইনের খসড়াও তৈরি করে দেয় নির্বাচন কমিশন। প্রথম প্রস্তাব পাঠানো হয় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষের দিকে ২০০৮ সালে। সর্বশেষ প্রস্তাব পাঠানো হয় বর্তমান সরকারের শুরুর দিকে, ২০০৯ সালে। ২০১১ সালের শেষ দিকে আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও এ আইন করার জন্য আইন কমিশনকে তাগিদ দেয়। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় বা আইন কমিশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও যোগ্য ইসি। সেই তাগিদ থেকেই সংবিধানে এ বিষয়টি যুক্ত করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘[প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া] বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ অর্থাৎ সংবিধানে ইসি নিয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে।

১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালের নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এর আগে-পরে ক্ষমতাসীন দলগুলো দলীয় বিবেচনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৫ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এমএ আজিজের নিয়োগকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়।

অনেকটা মনোনয়নের ভিত্তিতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অন্য নির্বাচন কমিশনারদের এ পর্যন্ত নিয়োগ করা হয়েছে। ফলে ইসির স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বর্তমান ইসিও এসব প্রশ্নের বাইরে নয়। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর নতুন ইসি কিভাবে গঠিত হবে তা নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা।

এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ২০১২ সালে যেভাবে বর্তমান ইসি গঠন করা হয়েছিল, এবারও সেভাবে হবে। সংবিধানের আলোকে ইসি গঠনে আইন প্রণয়ন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আসেনি। তাই তেমন পরিকল্পনাও নেই।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব। আমরাও তাই চাই। এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন একটি খসড়া আইন তৈরি করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও সরকারকে দিয়েছিলেন। তাতে সুন্দর একটি কাঠামো আছে। আমি মনে করি, সেটি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা দরকার। এ আইন হলে সবাই উপকৃত হবে। এ বিষয়ে সবার ঐকমত্য প্রয়োজন।

ড. শাহদীন মালিক বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন আইন ছাড়াই নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়োগ হয়েছে। কেউ কোনো চ্যালেঞ্জ করে রিট করেননি। আইন না করে এবারো যদি সার্চ কমিটি করে সেই প্রক্রিয়ায় ফেব্রুয়ারিতে ইসি নিয়োগ হয়, তাহলে মার্চে অবশ্যই আদালতে তা চ্যালেঞ্জ হবে।

তিনি বলেন, আগে আইন প্রণয়ন করে তারপর ইসি নিয়োগ দেওয়া উচিত। তা না হলে নির্বাচন কমিশন ও তাদের করা নির্বাচন প্রশ্নের মুখোমুখি হবে। বেশির ভাগ দেশেই ইসি নিয়োগের জন্য আইন রয়েছে। এ আইন করতে কোনো নোবেল পুরস্কার পাওয়া আইনজীবীর প্রয়োজন হবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সবাই শুধু বাছাই কমিটির (সার্চ) কথা বলছেন। আপনারা কেন আইন তৈরির কথা বলেন না?

স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। এজন্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন একান্ত প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, নিজেদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই হয়তো কোনো সরকার এই আইন করেনি। গত বছর রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করে নিয়োগ দিয়েছেন। এবার কী হবে, সেটি দেখার বিষয়। তবে আইন করা প্রয়োজন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়টি আরও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। এজন্য একটি শক্তিশালী আইন জরুরি। তিনি আরও বলেন, কেউ বলতে পারেন, যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হচ্ছে সেটিও ভালো। তবে সংবিধানের আলোকে কমিশনার নিয়োগে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী আইন হলে বিতর্ক অনেক কমবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে এ বিষয়ে আইন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম; কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর