ঢাকা ০৪:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিজের বিয়ে আটকে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া সেই মীম চমকে দিল সবাইকে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৪৪:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫
  • ১৮ বার

দিনমজুর বাবার পক্ষে পড়াশোনার খরচটা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হওয়ায় প্রতিবেশীদের চাপে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছিলেন বাবা মতিয়ার রহমান; কিন্তু মেধাবী মীমের ইচ্ছা পড়াশোনা চালিয়ে বিসিএস দিয়ে প্রশাসনিক ক্যাডার হওয়ার।

ফলে মামার কাছে কান্নাকাটি করে বিয়ের সিদ্ধান্তটা আটকে দেওয়ায় আজ এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে প্রতিবেশীসহ দরিদ্র বাবা-মাকে চমকে দিয়েছে মাছুমা আক্তার মীম।

কিন্তু তার পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া মসৃণ ছিল না। বাবার দিনমজুরির টাকায় চলে সংসার। ৮ শতক বাড়িভিটা ছাড়া কোনো জমিজমা নেই। ফলে দুই বোন, এক ভাইসহ ৫ জনের খাবার জোটাতে হিমসিম অবস্থা। সেখানে মেয়েকে পড়াবেন কিভাবে। কিন্তু মীমের অদম্য মেধাই তাকে নানান দুর্ভোগ আর কষ্টের মধ্য দিয়েই দেখাচ্ছে আলোকবর্তিকা!

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাগভাণ্ডার সোনাতলি এলাকার দিনমজুর পরিবারের মেয়ে মাছুমা আক্তার মীম। পরিবারের কেউ এসএসসির গণ্ডি পেরুতে না পারলেও এই পরিবারের বড় মেয়ে মীম একে একে সব ক্লাশেই ভালো ফল করে যখন এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেল। তখন এলাকার সবার চক্ষু চড়কগাছ!

কিন্তু পাশ করলেই তো হবে না, মেয়েকে পড়াবেন কিভাবে! দিনমজুর পরিবারে টানাটানির সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। সবার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেও মীমের জন্য সেটা ছিল অসম্ভব একটা ব্যাপার। তারপরও মেয়ের ইচ্ছার কারণে এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা লোন করে মেয়েকে রংপুরে ভার্সিটি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য কোচিংয়ে ভর্তি করানো হয়। এরপর মীমের জীবনে শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম।

রংপুরে ম্যাচ ভাড়া, যাতায়াত ও তিন বেলা খাবারের টাকা জোগাবে কে? কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে খেয়ে না খেয়ে চলছে মীমের সংগ্রামী জীবন।

মীমের মা আয়েশা খাতুন জানান, মেয়েটা আমার অনেক কষ্ট করেছে। জুতা দিতে না পারায় শিক্ষকরা ক্লাশে ঢুকতে দেয়নি। ঋণ করে জুতো কিনে দিয়েছি। ড্রেস কিনে দিতেও কষ্ট হয়েছে, অনেক সময় যাতায়াতের টাকা দিতে পারিনি, মেয়ে ৩ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে স্কুলে গেছে ও আসছে। ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতে পারিনি। তারপরও মেয়েটি ভালো রেজাল্ট করেছে। আমাদের গরিবের ঘরে এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! ওর স্বপ্ন যেন পূরণ হয় এই দোয়াই করি।

মীমের বাবা মতিয়ার রহমান জানান, মেয়ে জিপিএ-৫ পাওয়াতে আমি ভীষণ খুশি। এখন রক্ত বিক্রি করে হলেও মেয়েকে পড়াব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভালো রেজাল্ট করে বিসিএস দিতে চায়, আমিও তাই চাই।

মাছুমা আক্তার মীম জানায়, টেস্ট পরীক্ষার পর আমার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। সবাই বলছিল মেয়ে ১৫-১৬ বয়স হয়েছে- এখন বিয়ে দেওয়া দরকার। এ সময় আমি খুব কান্নাকাটি করলাম। মামাকে কেঁদে-কেটে বলায় মামা বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে আটকে দেন। আমার বাবাও কিছুটা রাজি ছিলেন; তারা ছেলে দেখতে যাচ্ছিল! আমার কান্নাকাটি আর মামার অনুরোধের কারণে আমার বিয়েটা বন্ধ হয়ে যায়। এখন পরিবার আমার পাশে আছে। তবে আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক কষ্ট করে এই পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এমনও হয়েছে রংপুরে মেসে থাকাকালীন খাবারের টাকা দিতে না পারায় রোজা রাখতে হয়েছে। এমন কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পড়াশোনাটা কতদূর চালিয়ে যেতে পারবে, সেটাই এখন চ্যালেঞ্জের। এ কারণে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় কাটছে মীমের দিনগুলো।

মীমের শিক্ষক ভূরুঙ্গামারী মহিলা কলেজের কৃষিশিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সফিয়ার রহমান জানান, মীম গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থী। পরিবারে নাজুক অবস্থা। সরকারি বা বেসরকারিভাবে তাকে সহযোগিতা করা হলে মেয়েটি নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে। তার সহযোগিতা দরকার।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

নিজের বিয়ে আটকে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া সেই মীম চমকে দিল সবাইকে

আপডেট টাইম : ০৬:৪৪:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫

দিনমজুর বাবার পক্ষে পড়াশোনার খরচটা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হওয়ায় প্রতিবেশীদের চাপে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছিলেন বাবা মতিয়ার রহমান; কিন্তু মেধাবী মীমের ইচ্ছা পড়াশোনা চালিয়ে বিসিএস দিয়ে প্রশাসনিক ক্যাডার হওয়ার।

ফলে মামার কাছে কান্নাকাটি করে বিয়ের সিদ্ধান্তটা আটকে দেওয়ায় আজ এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে প্রতিবেশীসহ দরিদ্র বাবা-মাকে চমকে দিয়েছে মাছুমা আক্তার মীম।

কিন্তু তার পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া মসৃণ ছিল না। বাবার দিনমজুরির টাকায় চলে সংসার। ৮ শতক বাড়িভিটা ছাড়া কোনো জমিজমা নেই। ফলে দুই বোন, এক ভাইসহ ৫ জনের খাবার জোটাতে হিমসিম অবস্থা। সেখানে মেয়েকে পড়াবেন কিভাবে। কিন্তু মীমের অদম্য মেধাই তাকে নানান দুর্ভোগ আর কষ্টের মধ্য দিয়েই দেখাচ্ছে আলোকবর্তিকা!

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাগভাণ্ডার সোনাতলি এলাকার দিনমজুর পরিবারের মেয়ে মাছুমা আক্তার মীম। পরিবারের কেউ এসএসসির গণ্ডি পেরুতে না পারলেও এই পরিবারের বড় মেয়ে মীম একে একে সব ক্লাশেই ভালো ফল করে যখন এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেল। তখন এলাকার সবার চক্ষু চড়কগাছ!

কিন্তু পাশ করলেই তো হবে না, মেয়েকে পড়াবেন কিভাবে! দিনমজুর পরিবারে টানাটানির সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। সবার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেও মীমের জন্য সেটা ছিল অসম্ভব একটা ব্যাপার। তারপরও মেয়ের ইচ্ছার কারণে এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা লোন করে মেয়েকে রংপুরে ভার্সিটি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য কোচিংয়ে ভর্তি করানো হয়। এরপর মীমের জীবনে শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম।

রংপুরে ম্যাচ ভাড়া, যাতায়াত ও তিন বেলা খাবারের টাকা জোগাবে কে? কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে খেয়ে না খেয়ে চলছে মীমের সংগ্রামী জীবন।

মীমের মা আয়েশা খাতুন জানান, মেয়েটা আমার অনেক কষ্ট করেছে। জুতা দিতে না পারায় শিক্ষকরা ক্লাশে ঢুকতে দেয়নি। ঋণ করে জুতো কিনে দিয়েছি। ড্রেস কিনে দিতেও কষ্ট হয়েছে, অনেক সময় যাতায়াতের টাকা দিতে পারিনি, মেয়ে ৩ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে স্কুলে গেছে ও আসছে। ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতে পারিনি। তারপরও মেয়েটি ভালো রেজাল্ট করেছে। আমাদের গরিবের ঘরে এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! ওর স্বপ্ন যেন পূরণ হয় এই দোয়াই করি।

মীমের বাবা মতিয়ার রহমান জানান, মেয়ে জিপিএ-৫ পাওয়াতে আমি ভীষণ খুশি। এখন রক্ত বিক্রি করে হলেও মেয়েকে পড়াব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভালো রেজাল্ট করে বিসিএস দিতে চায়, আমিও তাই চাই।

মাছুমা আক্তার মীম জানায়, টেস্ট পরীক্ষার পর আমার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। সবাই বলছিল মেয়ে ১৫-১৬ বয়স হয়েছে- এখন বিয়ে দেওয়া দরকার। এ সময় আমি খুব কান্নাকাটি করলাম। মামাকে কেঁদে-কেটে বলায় মামা বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে আটকে দেন। আমার বাবাও কিছুটা রাজি ছিলেন; তারা ছেলে দেখতে যাচ্ছিল! আমার কান্নাকাটি আর মামার অনুরোধের কারণে আমার বিয়েটা বন্ধ হয়ে যায়। এখন পরিবার আমার পাশে আছে। তবে আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক কষ্ট করে এই পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এমনও হয়েছে রংপুরে মেসে থাকাকালীন খাবারের টাকা দিতে না পারায় রোজা রাখতে হয়েছে। এমন কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পড়াশোনাটা কতদূর চালিয়ে যেতে পারবে, সেটাই এখন চ্যালেঞ্জের। এ কারণে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় কাটছে মীমের দিনগুলো।

মীমের শিক্ষক ভূরুঙ্গামারী মহিলা কলেজের কৃষিশিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সফিয়ার রহমান জানান, মীম গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থী। পরিবারে নাজুক অবস্থা। সরকারি বা বেসরকারিভাবে তাকে সহযোগিতা করা হলে মেয়েটি নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে। তার সহযোগিতা দরকার।