দেশি-বিদেশি চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত জামায়াতের কব্জা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছে বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতের কারণেই পরপর দু’টি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ‘সহিংস’ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। তাদের কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনগণের সমর্থন পায়নি বিএনপি। তাই এখন জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ ছাড়া কোনো উপায়ন্তর নেই।
এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমরা যখনই কোনো কর্মসূচি দেই, তখনই জামায়াত অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে। এরপরে কোনো কর্মসূচিতে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের জোট থেকে বের করে দেবো, অথবা আমরা তাদের কাছ থেকে সরে আসবো।
সূত্র জানায়, নানা সমালোচনা ও দেশি-বিদেশি চাপ উপেক্ষা করেও দু’টি কারণে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেছিলো বিএনপি। প্রথমত যে কোনো ধরনের আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে না জামায়াত। দ্বিতীয়ত, আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বেশিরভাগ যোগান জামায়াতের কাছ থেকে পায় দলটি।
কিন্তু পর পর দু’টি আন্দোলনে নজিরবিহীন ‘নাশকতা’ ছাড়া বিএনপিকে আর কিছুই দিতে পারেনি জোটসঙ্গী জামায়াত। চোরাগোপ্তা হামলা, পেট্রোলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, রেলে নাশকতা, সরকারি অফিসে অগ্নিসংযোগ, বিদ্যুৎ স্টেশন জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ সন্ত্রাস ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড ছিলো বিএনপির জন্য জামায়াতের ‘উপহার’।
২০১৩ সালের সহিংস আন্দোলনের পর ২০১৪ সালের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ব্রিটেনের হাউস অব কমন্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপিকে পরামর্শ দেয়।
সূত্রমতে, বন্ধুভাবাপন্ন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওই পরামর্শ তখন আমলে নেননি বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তারা ভেবেছিলেন, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে শক্ত করে একটা চাপ দিতে পারলেই সরকার বাধ্য হবে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে। সে লক্ষ্যেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ঘোষণা করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
কিন্তু ওই অবরোধ কর্মসূচিতে দেশের কোথাও জামায়াতিরা মাঠেন নামেনি। বরং রাতের অন্ধকারে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে বিএনপির আন্দোলনকে বিতর্কিত করেছে। কোথাও কোথাও নিজেদের এই অপকর্মের সঙ্গী করেছে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের।
সূত্র জানায়, টানা ৯২ দিনের ব্যর্থ আন্দোলন শেষে খালি হাতে ঘরে ফেরার পরই বিএনপির মূল ধারার নেতারা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দেন। তারা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, জামায়াত ছাড়লে বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়বে।
জানা গেছে, খুব কাছের কয়েকজন নেতার দেওয়া এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান না করলেও তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেননি খালেদা জিয়া। তবে জামায়াতের কব্জা থেকে বিএনপিকে মুক্ত করতে হলে এই মুহূর্তে করণীয় কী সে বিষয়ে জানতে চান তিনি।
গত মে মাসের মাঝামাঝি গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি ঘরোয়া মিটিংয়ে অংশ নেওয়া এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি বাংলানিউজকে বলেন, ‘চিন্তা কইরেন না, আজ হোক, কাল হোক এটি (জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ছাড়াছাড়ি) হবেই।’
এ প্রসঙ্গে মাহবুবর রহমান বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট বা সম্পর্ক আজীবনের জন্য নয়। বিশেষ এক মুহূর্তে বিশেষ প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে জোট বাঁধতে হয়েছিলো। সময়ের প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে জোট নাও থাকতে পারে।
জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সফরের দ্বিতীয় দিন তার সঙ্গে একান্ত বৈঠকে যে তিনটি প্রশ্নে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিব্রত হন, তার প্রত্যেকটিই ছিলো জামায়াতকেন্দ্রিক।
সূত্র মতে, বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে ১০ ট্রাক অস্ত্র, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক বাতিল এবং ভারতের বর্ধমানে জঙ্গি হামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে কথা শোনাতে পারতেন না নরেন্দ্র মোদি।
তাছাড়া, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশে পাচ্ছে না বিএনপি। সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও ১৪ ও ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিএনপির পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না।
সূত্র জানায়, বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে জামায়াতের কব্জা থেকে দলকে মুক্ত করার পথ খুঁজছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তবে এ ব্যাপারে শেষ কথাটি বলবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।