মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রবেশপথেই রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাবি্বর ব্যবহৃত গাড়িটি। তার পাশেই হাজার সপ্তাহ ধরে জ্বলছে শিখা চিরন্তন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার শিকার নিরীহ মানুষদের সম্পর্কে মিথ্যা মৃত্যু সনদ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ডা. ফজলে রাবি্ব। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক চিকিৎসাসেবার প্রতিবাদে ‘বেস্ট প্রফেসর অব কম্বাইন্ড পাকিস্তান’ পুরস্কার গ্রহণেও অসম্মতি জানিয়েছিলেন তিনি। পরিণতিতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলো তাকে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ঠিক আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সৈন্যসহ রাজাকার-আলবদররা তাকে সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। পরিবারের পক্ষ থেকে ডা. ফজলে রাবি্বর গাড়িটি দান করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
এমন অনেক দানে ধন্য জাদুঘরটিতে সংগৃহীত হয়েছে বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংগ্রামী জীবনের হাজারও স্মারক। অথচ শুরুতে উদ্যোক্তারা মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহ নিয়েই সবচেয়ে চিন্তিত ছিলেন বলে জানালেন জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত সংগৃহীত স্মারকের সংখ্যা ১৮ হাজার। স্থানাভাবে এগুলোর মধ্যে মাত্র এক হাজার ৩০০ প্রদর্শনের জন্য রাখা গেছে। তবে আগারগাঁওয়ে নির্মীয়মাণ নিজস্ব ভবনে জাদুঘর স্থানান্তরের পর সংগৃহীত প্রায় সব স্মারকই প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যাবে।
মফিদুল হক জাদুঘর প্রতিষ্ঠার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা আটজন_ সারওয়ার আলী, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, রবিউল হুসাইন, জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, আক্কু চৌধুরী, সারা যাকের ও আমি মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পূর্তির আগে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলাম। আমরা এই আটজন ট্রাস্টি নানা সূত্রে একই বন্ধুমহলের, আমাদের বন্ধুত্বও অনেক দিনের। জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। কিন্তু আমরা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করি তারও কয়েক বছর আগে। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হই তখন সময়টা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে কোনো উদ্যোগের জন্যই ছিল প্রতিকূল। সরকারিভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অস্বীকৃতি ও বিকৃতি চলছিল। আমাদের ভাবনায় ছিল কোথায় জায়গা পাওয়া যাবে, কোথা থেকে পাব অর্থকড়ি? সব কিছু ছাপিয়ে মনে এলো কেমন করে সংগৃহীত হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক? ততদিন পর্যন্ত স্বজন হারানো যে মানুষগুলো তাদের প্রিয়জনের স্মৃতিচিহ্ন আগলে রেখেছেন, তারা কেন তা তুলে দেবেন জাদুঘরের কাছে? এখনও সেগুনবাগিচার যে বাড়িতে জাদুঘরের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, সেই বাড়িটা পাওয়ায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ভাবনাটা অনেক সহজ হয়ে গেল। আমরা ঠিক করলাম প্রথমে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিষ্ঠার পর আমরা যাব জনগণের কাছে।’
১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত আজকের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। তারপর বাড়তে থাকল কার্যক্রম। মফিদুল হক বলেন, ‘এরপর আমরা কয়েক মাস দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছি। বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে আমরা কার্যক্রম শুরু করি। দেখলাম দেশের মানুষ খুব আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আহ্বান জানালাম তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের যে স্মৃতিচিহ্ন আছে তা যেন জাদুঘরকে দান করেন। আর্থিক অনুদানও দিয়েছেন বহুজন। নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেউ দিয়েছেন কোটি টাকা, কেউ আবার কষ্টে জমানো টাকাটাও তুলে দিয়েছেন।’মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেক ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ‘আমরা কয়েকজন ট্রাস্টি জাদুঘরটি পরিচালনার কাজ করলেও এটি প্রকৃতপক্ষে জনগণের জাদুঘর। গত ১২ জুন জাদুঘরের পথচলার হাজার সপ্তাহ পূর্ণ হয়েছে। এই এক হাজার সপ্তাহ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের হাতে হাত রেখে চলার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।’ তিনি জাদুঘরের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই জনগণের এই জাদুঘরকে একটি ভবনের মধ্যে আটকে না রেখে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এ লক্ষ্যেই নেওয়া হয় আউটরিচ কর্মসূচি ও ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর।’
সারওয়ার আলী জানান, ১৯৯৭ সালে নেওয়া আউটরিচ কর্মসূচির আওতায় ঢাকা নগরের শিক্ষার্থীদের পরিবহন যোগে জাদুঘর পরিদর্শনে নিয়ে আসা হয়। তাদের ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। তারা জাদুঘরের গ্যালারি পরিদর্শন করে ও কুইজ পরীক্ষায় অংশ নেয়। একটি বৃহৎ আকারের বাসের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সাজিয়ে ২০০১ সালে তৈরি করা হয়েছে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর। সারাদেশে জেলা-উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের মাধ্যমে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেশের ৫৮টি জেলায় ঘুরে এসেছে। প্রায় আড়াই হাজার স্কুলের ১১ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পেঁৗছাতে পেরেছে জাদুঘরের ভ্রাম্যমাণ সংস্করণ। জাদুঘর ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে সংগ্রহ করছে মুক্তিযুদ্ধের কথ্য ইতিহাসও। জাদুঘরের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়, যে কোনো মানুষের একাত্তরের স্মৃতি শুনে লিখে পাঠানোর জন্য। এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার লেখা পাওয়া গেছে, যা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের কাছে পেঁৗছে দিতে দেশের স্কুলগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার নেটওয়ার্ক শিক্ষক নির্বাচন করা হয়েছে। তারা স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতেও সহায়তা করেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য বজলুর রহমান স্মৃতি পদক প্রবর্তন করা হয়েছে ২০০৮ সাল থেকে। প্রকাশনা বিভাগ থেকে বেরিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণাধর্মী বিভিন্ন বই। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি আয়োজন ছিল ২০১৩ সালের ৪ ও ৫ জুলাই জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড দি ইস্যু অব জাস্টিস’ সম্মেলন।
সেগুনবাগিচার দোতলা ভবনের ছয়টি কক্ষ নিয়ে এখনও চলছে জাদুঘর। নিচতলা থেকে নির্দেশনা মেনে দ্বিতীয় তলার ষষ্ঠ কক্ষ পর্যন্ত যেতে যেতে বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে সাম্যক পরিচয় ঘটে দর্শনার্থীদের। প্রথম কক্ষে পরিচয় ঘটে বাঙালির প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে। কয়েক ধাপ এগিয়ে পাওয়া যাবে ইংরেজ শাসনামলের কথা। মাস্টার দা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ও ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের ইতিহাস। এরপর শুরু হলো পাকিস্তানি শাসনামল। গণতন্ত্র ও অধিকারের দাবিতে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এলো ১৯৭১। তৃতীয় কক্ষে জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব থেকে অস্থায়ী সরকার গঠন ইত্যাদি। সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় যেতে যেতে দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্টার। চতুর্থ কক্ষে দেখা যাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মারকসহ আরও অনেক কিছু। দোতলার চতুর্থ কক্ষ থেকে বের হয়ে পঞ্চম কক্ষে যাওয়ার সময় আছে মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশের ভূমিকার কথা। পঞ্চম কক্ষে তুলে ধরা হয়েছে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, রণকৌশল, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ও গোলা। সর্বশেষ কক্ষে রয়েছে মিরপুর মুসলিমবাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা কঙ্কাল, শহীদদের ব্যবহৃত বস্তুসামগ্রী, চিঠিপত্র, ডায়েরি, নোটবুক ইত্যাদি।
মফিদুল হক ও সারওয়ার আলী_ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দু’জন ট্রাস্টিই আশা প্রকাশ করলেন, আসছে ডিসেম্বরে জাদুঘর যাবে তার নিজস্ব ভবনে। স্থানস্বল্পতা ও সংরক্ষণের কথা চিন্তা করে এতদিন যেসব স্মারক বাক্সবন্দি করে রাখতে হয়েছিল, নিজস্ব ভবনে সেগুলোর জায়গা হবে অনায়াসে। জাদুঘর বিজ্ঞানের নবতর ভাবনার স্পর্শে সরকারি সহযোগিতায় এবং সর্বসাধারণের অর্থায়নে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রায় তিন বিঘা জমির ওপর নির্মিত হয়েছে ভবনটি।