ঢাকা ০৩:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গুম করে গাড়ি-ট্রেনের নিচে ফেলে হত্যা করা হতো

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:২০:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
  • ২১ বার

গুম করা ব্যক্তিদের হত্যার জন্য গাড়ির নিচে ফেলে দিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আবার লাশ ফেলার জন্য ব্যবহার করা হতো রেললাইন। ক্রসফায়ারে হত্যার পর তাতে অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করা হতো। তাদের মধ্যে কিছু সদস্য অপরাধবোধ থেকে সেই অর্থ মসজিদের দান করে দিতেন। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিশ্লেষণ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও আঁকা ছবি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি জমা দেয় কমিশন।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণের পাশাপাশি আরও দুটি বিষয় এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমত, দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ভেতরে একটি নীরব ‘সহমতের সংস্কৃতি’ গড়ে ওঠে। আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে গড়ে ওঠা এমন একটি ঐকমত্য। সব বিষয়ে দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষার অজুহাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয় বা কেবল কয়েকজন কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতার ফল নয়। বরং এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ফল, যেখানে এসব অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরস্কৃতও করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয়পক্ষই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরও এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি বহাল আছে এবং পূর্ববর্তী কাঠামো অনেক ক্ষেত্রে আগের মতোই কাজ করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে নিবাপত্তা বাহিনীর ভেতরে যেসব সদস্য গুম, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কিংবা প্রতিষ্ঠানগত জবাবদিহির মতো বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বা ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন; তাদেরকে প্রায়শই ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।

গুমের বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর নেমে আসত শাস্তি। সহকর্মীরাও ভয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক এড়িয়ে চলতেন। চল্লিশের কোঠায় একজন অফিসারের বরাতে গুম কমিশন জানিয়েছে, তৎকালীন সরকারের নির্ধারিত অবস্থান মেনে না চলার কারণে কীভাবে সহকর্মীদের কাছ থেকে তাকে পরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তার প্রতিটি নতুন পোস্টিংয়ের আগেই সহকর্মীদের সতর্ক করে দেওয়া হতো যাতে তাকে যেন বিশ্বাস না করে। তার পরিবারিক যোগাযোগের ওপরও নজরদারি করা হতো। প্রশাসনিক অস্ত্র ব্যবহার করে তার পেশাগত অগ্রগতি নষ্ট করে দেওয়া হয়।

গুমের পর নির্যাতনের ফলে স্থায়ীভাবে পঙ্গু হওয়া এক ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মারধরের সময় দুটি যন্ত্র ভেঙে ফেলে এবং তারপর তৃতীয় একটি যন্ত্র দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে যায়। সহিংসতার মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, উপস্থিত দুই নারী কর্মকর্তা কাঁদতে কাঁদতে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পঁচিশের কাছাকাছি এক তরুণ সৈনিককে যখন এক গোপন বন্দিশালায় পোস্টিং দেওয়া হয়, তিনি নির্যাতন দেখে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ভুক্তভোগীরা গুম কমিশনকে জানিয়েছেন, ক্রসফায়ারের আগে কর্মকর্তারা মিটিং করতেন। অনেক ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তারা মতও বদলাতেন। মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করতেন।

তবে ক্রসফায়ারের দেওয়ার অস্বীকারও করেন কিছু কর্মকর্তা। একজন কর্মকর্তা এমন একটি চিঠি লিখেছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। সেই চিঠি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ২০১৫ সালে লেখা সেই চিঠি ২০২৪ সালে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের ফাইলে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন হাসিনা। ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠির অনুবাদ করলে অর্থ দাড়ায়: ‘আমাকে র‌্যাব কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একটি অভিযানে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, আমি বলেছিলাম যদি এই অভিযানে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বা গুলি চালনার পরিকল্পনা থাকে, যা দেশের আইনে অনুমোদিত নয়, তাহলে আমি তেমন কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারি না।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বোচ্চ দমনমূলক পরিবেশেও যে অবৈধ আদেশ অস্বীকারের জন্য অল্প কিছু হলেও স্থান ছিল, কর্মকর্তাদের বিবেকবোধও যে পরিস্ফুটিত হতে পারত, এটির বিরল স্মারক হিসেবে কাজ করে।

গুম কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, অত্যন্ত যতœ সহকারে কর্মকর্তাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা লিপিবদ্ধ করা হতো। শুধু তাদের নিজেদের নয়, বরং এসব নথিতে তাদের বিস্তৃত আত্মীয় পরিজনেরও, এমনকি স্ত্রীর খালার রাজনৈতিক পরিচয়ও পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি, ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ, যেমন দুর্নীতি, শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অসদাচরণের কথাও সেখানে উল্লেখ ছিল।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন জুনিয়র কর্মকর্তাকে তার ঊর্ধ্বতন জিজ্ঞেস করেন র‌্যাবে পোস্টিংকালে তিনি কাউকে হত্যা করেছেন কি না, করলে কয়জনকে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে তিনি নিজ হাতে দুজনকে হত্যা করেছেন এবং আরও চারটি হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। এ ধরনের অভিযানের পর নিয়মিতভাবে অর্থ বিতরণ করা হতো। ফলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে আরও জিজ্ঞেস করেন অভিযানের পর প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি কী করেছেন। উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি সেই টাকা নিজ গ্রামের মসজিদে দান করে দিয়েছেন।

কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, এক সিনিয়র কর্মকর্তা এক অধস্তন কর্মকর্তার কথা আমাদের বলেছেন যে, গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার পর ওই অধস্তন কর্মকর্তা ক্রমশ ধার্মিকতা দেখাতে শুরু করে। তিনি তাকে বলেন, বর্তমানে তিনি যে নামাজ আদায় করছেন, তাতে তার আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালন হচ্ছে বটে; কিন্তু যে অপরাধ সে করেছে মানুষের প্রতি, তার ঋণ আদায় হচ্ছে না। তিনি বলেন, অন্যের হক ক্ষতিগ্রস্ত হলে, আল্লাহ কারও পক্ষ হয়ে তা মাফ করেন না। যে অন্যায় করেছে, তাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। শুধু নামাজ পড়ে দায় শেষ হয়ে যায় না।

পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টররাও জানিয়েছেন, তাদেরকে এমন সব নথিতে স্বাক্ষর করতে হতো, যা তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সহভাগী করে তুলত। অনেকেই মনে করতেন এটি অন্যায়; কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস তাদের ছিল না। ফলে এটি স্পষ্ট যে, এই সংকট গোটা নিরাপত্তা কাঠামোর ভেতরে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল।

কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, নিখোঁজদের ভাগ্য সম্পর্কে জানা সম্ভব কেবল তখনই, যখন ভুক্তভোগীদের অপহরণ ও তাদের সর্বশেষ পরিণতির সময় যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা সাক্ষ্য দেন। কিন্তু যখন সেই ব্যক্তিদেরই ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, তখন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো থেকে সত্য উদ্ঘাটনের সম্ভাবনাটিই কেড়ে নেওয়া হয়। আর এই বঞ্চনা যখন ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদলের পরও অব্যাহত থাকে, তখন তা এক বিশেষভাবে মর্মান্তিক ও অন্যায্য পরিণতিকে নির্দেশ করে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

গুম করে গাড়ি-ট্রেনের নিচে ফেলে হত্যা করা হতো

আপডেট টাইম : ১০:২০:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

গুম করা ব্যক্তিদের হত্যার জন্য গাড়ির নিচে ফেলে দিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আবার লাশ ফেলার জন্য ব্যবহার করা হতো রেললাইন। ক্রসফায়ারে হত্যার পর তাতে অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করা হতো। তাদের মধ্যে কিছু সদস্য অপরাধবোধ থেকে সেই অর্থ মসজিদের দান করে দিতেন। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিশ্লেষণ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও আঁকা ছবি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি জমা দেয় কমিশন।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণের পাশাপাশি আরও দুটি বিষয় এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমত, দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ভেতরে একটি নীরব ‘সহমতের সংস্কৃতি’ গড়ে ওঠে। আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে গড়ে ওঠা এমন একটি ঐকমত্য। সব বিষয়ে দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষার অজুহাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয় বা কেবল কয়েকজন কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতার ফল নয়। বরং এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ফল, যেখানে এসব অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরস্কৃতও করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয়পক্ষই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরও এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি বহাল আছে এবং পূর্ববর্তী কাঠামো অনেক ক্ষেত্রে আগের মতোই কাজ করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে নিবাপত্তা বাহিনীর ভেতরে যেসব সদস্য গুম, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কিংবা প্রতিষ্ঠানগত জবাবদিহির মতো বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বা ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন; তাদেরকে প্রায়শই ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।

গুমের বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর নেমে আসত শাস্তি। সহকর্মীরাও ভয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক এড়িয়ে চলতেন। চল্লিশের কোঠায় একজন অফিসারের বরাতে গুম কমিশন জানিয়েছে, তৎকালীন সরকারের নির্ধারিত অবস্থান মেনে না চলার কারণে কীভাবে সহকর্মীদের কাছ থেকে তাকে পরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তার প্রতিটি নতুন পোস্টিংয়ের আগেই সহকর্মীদের সতর্ক করে দেওয়া হতো যাতে তাকে যেন বিশ্বাস না করে। তার পরিবারিক যোগাযোগের ওপরও নজরদারি করা হতো। প্রশাসনিক অস্ত্র ব্যবহার করে তার পেশাগত অগ্রগতি নষ্ট করে দেওয়া হয়।

গুমের পর নির্যাতনের ফলে স্থায়ীভাবে পঙ্গু হওয়া এক ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মারধরের সময় দুটি যন্ত্র ভেঙে ফেলে এবং তারপর তৃতীয় একটি যন্ত্র দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে যায়। সহিংসতার মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, উপস্থিত দুই নারী কর্মকর্তা কাঁদতে কাঁদতে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পঁচিশের কাছাকাছি এক তরুণ সৈনিককে যখন এক গোপন বন্দিশালায় পোস্টিং দেওয়া হয়, তিনি নির্যাতন দেখে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ভুক্তভোগীরা গুম কমিশনকে জানিয়েছেন, ক্রসফায়ারের আগে কর্মকর্তারা মিটিং করতেন। অনেক ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তারা মতও বদলাতেন। মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করতেন।

তবে ক্রসফায়ারের দেওয়ার অস্বীকারও করেন কিছু কর্মকর্তা। একজন কর্মকর্তা এমন একটি চিঠি লিখেছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। সেই চিঠি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ২০১৫ সালে লেখা সেই চিঠি ২০২৪ সালে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের ফাইলে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন হাসিনা। ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠির অনুবাদ করলে অর্থ দাড়ায়: ‘আমাকে র‌্যাব কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একটি অভিযানে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, আমি বলেছিলাম যদি এই অভিযানে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বা গুলি চালনার পরিকল্পনা থাকে, যা দেশের আইনে অনুমোদিত নয়, তাহলে আমি তেমন কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারি না।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বোচ্চ দমনমূলক পরিবেশেও যে অবৈধ আদেশ অস্বীকারের জন্য অল্প কিছু হলেও স্থান ছিল, কর্মকর্তাদের বিবেকবোধও যে পরিস্ফুটিত হতে পারত, এটির বিরল স্মারক হিসেবে কাজ করে।

গুম কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, অত্যন্ত যতœ সহকারে কর্মকর্তাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা লিপিবদ্ধ করা হতো। শুধু তাদের নিজেদের নয়, বরং এসব নথিতে তাদের বিস্তৃত আত্মীয় পরিজনেরও, এমনকি স্ত্রীর খালার রাজনৈতিক পরিচয়ও পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি, ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ, যেমন দুর্নীতি, শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অসদাচরণের কথাও সেখানে উল্লেখ ছিল।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন জুনিয়র কর্মকর্তাকে তার ঊর্ধ্বতন জিজ্ঞেস করেন র‌্যাবে পোস্টিংকালে তিনি কাউকে হত্যা করেছেন কি না, করলে কয়জনকে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে তিনি নিজ হাতে দুজনকে হত্যা করেছেন এবং আরও চারটি হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। এ ধরনের অভিযানের পর নিয়মিতভাবে অর্থ বিতরণ করা হতো। ফলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে আরও জিজ্ঞেস করেন অভিযানের পর প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি কী করেছেন। উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি সেই টাকা নিজ গ্রামের মসজিদে দান করে দিয়েছেন।

কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, এক সিনিয়র কর্মকর্তা এক অধস্তন কর্মকর্তার কথা আমাদের বলেছেন যে, গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার পর ওই অধস্তন কর্মকর্তা ক্রমশ ধার্মিকতা দেখাতে শুরু করে। তিনি তাকে বলেন, বর্তমানে তিনি যে নামাজ আদায় করছেন, তাতে তার আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালন হচ্ছে বটে; কিন্তু যে অপরাধ সে করেছে মানুষের প্রতি, তার ঋণ আদায় হচ্ছে না। তিনি বলেন, অন্যের হক ক্ষতিগ্রস্ত হলে, আল্লাহ কারও পক্ষ হয়ে তা মাফ করেন না। যে অন্যায় করেছে, তাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। শুধু নামাজ পড়ে দায় শেষ হয়ে যায় না।

পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টররাও জানিয়েছেন, তাদেরকে এমন সব নথিতে স্বাক্ষর করতে হতো, যা তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সহভাগী করে তুলত। অনেকেই মনে করতেন এটি অন্যায়; কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস তাদের ছিল না। ফলে এটি স্পষ্ট যে, এই সংকট গোটা নিরাপত্তা কাঠামোর ভেতরে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল।

কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, নিখোঁজদের ভাগ্য সম্পর্কে জানা সম্ভব কেবল তখনই, যখন ভুক্তভোগীদের অপহরণ ও তাদের সর্বশেষ পরিণতির সময় যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা সাক্ষ্য দেন। কিন্তু যখন সেই ব্যক্তিদেরই ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, তখন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো থেকে সত্য উদ্ঘাটনের সম্ভাবনাটিই কেড়ে নেওয়া হয়। আর এই বঞ্চনা যখন ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদলের পরও অব্যাহত থাকে, তখন তা এক বিশেষভাবে মর্মান্তিক ও অন্যায্য পরিণতিকে নির্দেশ করে।