বিশ্বে প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্র ১৬০৫-এ বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্থে। প্রথম ইংরেজি দৈনিক ‘লন্ডন গেজেট’ এর আবির্ভাব ১৬৫৫’তে। ভারতে তখন ছাপাখানাই হয়নি। আজকের বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়ানমার, মেলান অখন্ড বিশাল দেশটাতে কোথায় কী হচ্ছে জানার উপায় নেই। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভারতে সংবাদপত্রের মুক্তি অন্য কোথাও নয়, এই বাংলাতেই। সেই গর্ব ঢাকা-কলকাতার।
সংবাদপত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা জেমস অগাস্টাস হিকির নাম। তাঁর প্রেস থেকে তাঁরই সম্পাদনায় ১৭৮০’র ২৯ জানুয়ারি হাতে এল সাপ্তাহিক ইংরেজি সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’। প্রথম সম্পাদকীয়তে তিনি লিখলেন, ‘আই টেক প্লেজার ইন এনস্লেভিং মাই বডি ইন অর্ডার টু পারচেজ ফ্রিডম অব মাই মাইন্ড অ্যান্ড সোল’। দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ, আমি আমার মন আর আত্মার স্বাধীনতার জন্যই এই পত্রিকার প্রকাশের পরিশ্রম স্বীকার করছি। নির্ভীক, স্বাধীন সাংবাদিকতার লক্ষ্যে হিকির মত ছিল, ‘ওপেন ট্যু অন, মেলিস ট্যু নান’। সাংবাদিকতার সার্থকতা খুঁজতে বিদ্বেষহীন, মুক্ত মনকেই তিনি সঙ্গী করেছিলেন। হিকির আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক। রাজনীতিকরা কথাটা মানলে অনেক সমস্যাই সহজে মিটে যায়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরে আর কাজে সেই ছাপটা স্পষ্ট। তিনি বিশ্ববন্ধুত্বে বিশ্বাসী। বিরোধ থাকলে মেটাতে চান আলোচনায়। বাংলাদেশে পাকিস্তানের সন্ত্রাস রফতানিতে তিনি ক্ষুব্ধ। প্রতিবাদে মুখর। তবুও সম্পর্ক ছিঁড়তে চান না। তাঁর বক্তব্য, ঝগড়াঝাঁটি চলবে, যোগাযোগও থাকবে। চিন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ। তা সত্ত্বেও চিনকে কাছে টানতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। চিন দেরিতে হলেও বুঝেছে বাংলাদেশের গুরুত্ব। মাও জে দঙের পর ১৯৭৮-এ চিনের হাল ধরে দেং জিয়াও পেং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংস্কারে মনোযোগী হন। বিদেশি বিনিয়োগ, বাজার অর্থনীতিতে আগ্রহী হয়েও বাংলাদেশের দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত পাননি। ২০১৩তে রাষ্ট্রপতি হয়ে শি চিনফিং পাকিস্তানকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনাটা মাথায় ঢুকেছে।
তিন বছর পর ১৪ অক্টোবর চিনফিং সফর করলেন ঢাকা। তাঁর আপ্যায়নে আন্তরিক ছিলেন হাসিনা। চিনফিংয়ের উদারতা অতুলনীয়। বাংলাদেশ যা চেয়েছে তাই দিয়েছেন। উন্নয়নে সহযোগিতার দরাজ হাত। ঋণ ২৪০০ কোটি ডলার। ভারত দিয়েছিল ২০০ কোটি ডলার। হিসেবে তার ১২ গুণ। দেওয়ার প্রতিযোগিতায় ভারত পিছিয়ে। আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, কোরিয়া অবাক। চিনের বদন্যতার কারণ খুঁজতে ব্যস্ত। পাকিস্তানের ভাবনা অন্য। চিন যদি এ ভাবে বাংলাদেশের দিকে ঝোঁকে তাদের কী হবে। এত দিন দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের একমাত্র ভরসা ছিল পাকিস্তান। দানে কার্পণ্য করেনি। প্রকল্পের টাকা সন্ত্রাসী পোষণে খরচ হচ্ছে জেনেও নীরব থেকেছে। কারণ একটাই, ভারত চাপে থাকুক। কাশ্মীরের উরিতে পাকিস্তানি জঙ্গিদের হামলার পর আন্তর্জাতিক স্তরে কোণঠাসা পাকিস্তান। আমেরিকা, রাশিয়া ভারতের পাশে। পাকিস্তানকে চিনের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় অব্যাহত।
বাংলাদেশে ১,৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের দায়িত্ব নিচ্ছে চিন। জ্বালানি, কৃষি, শিল্পায়নে চিনের সাহায্যের অভাব হবে না। চিনের বিনিয়োগে চট্টগ্রামে আলাদা পার্ক তৈরি হচ্ছে। ২৭টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে সই হয়েছে। সেখানেই থেমে থাকেনি চিন। বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বিস্তারের দিকেও নজর। দক্ষিণ এশিয়ায় বাফার স্টেট বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানে সার্কের অন্যান্য দেশের থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশকে সামরিকভাবে সক্রিয় করে তুললে ভারতের উদ্বেগ বাড়বে। পাকিস্তান স্বস্তি পাবে। নভেম্বরে ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হওয়ার কারণ শুধু ভারত নয়। বাংলাদেশ, ভুটান, আফগানিস্তানেরও আপত্তি ছিল। সার্কের পর্যবেক্ষক চিন। পাকিস্তান চাইছে, চিনকে পুরোপুরি সার্কের সদস্য করে নিতে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সুযোগটা চিনেরও অপচ্ছন্দ নয়।