ঢাকা ০৭:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গত অর্থবছরে দেশে উৎপাদন ৪২ হাজার টন কমল অত্যধিক তাপপ্রবাহ, নাব্যতা সংকটসহ নদী দূষণে অভ্যন্তরীণ নদী মুখি হচ্ছে না ইলিশ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৯:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫
  • ২৩ বার

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ঘাটতির সাথে তাপমাত্রার পারদ লাগাতার স্বাভাবিকের ওপরে অবস্থানের পাশাপাশি সীমান্তের ওপারে উজানে নদ-নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে নাব্যতা সংকট বৃদ্ধি সহ শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে এবার বরিশাল অঞ্চল ও সংলগ্ন উপকূলভাগে ইলিশের বিচরণ আশংকাজনক-হারে কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরফলে ইলিশ উপকূল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পরিবর্তে গভীর সমুদ্রে চলে যাবার শঙ্কার কথা বলেছেন অনেকে। এমনকি প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণেই ইলিশের উৎপাদন আগের অর্থ বছরের ৫.৭১ লাখ থেকে গত অর্থ বছরে প্রায় ৪২ হাজার টন হ্রাস পেয়ে ৫.২৯ লাখ টনে স্থির ছিল বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, দেশে উৎপাদিত ও আহরিত ইলিশের ৭০ভাগই বরিশালে। মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ‘আমাদের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ইলিশ উৎপাদনে ভবিষ্যতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক নানা সমস্যা বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে’। মনুষ্য সৃষ্ট নানামুখী বিরূপ প্রভাবের সাথে গত কয়েকবছর ধরে গ্রীষ্মের শুরু থেকেই স্বাভাবিকের বেশী তাপপ্রবাহ ইলিশের ইতোপূর্বের বিচরণ স্থল সহ গতিপথ ও আবাস্থলের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে অবস্থান পরিবর্তনের ফলে উপকূল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ বিচরনস্থল গুলোতে এবার ইলিশের উপস্থিতি আশংকাজনক হারে কম থাকায় আহরণ ঘাটতির ফলে বাজারেও বিরূপ প্রভাব লক্ষণীয়।

মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট-এর একাধিক বিজ্ঞানীর মতে, ইলিশ বিচরণের জন্য যেখানে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন, সেখানে তা ৩৪-৩৫ ডিগ্রী অতিক্রম করছে। রোববার বরিশালে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ৫.৩ ডিগ্রী বেশী, ৩৮.৩ ডিগ্রীতে উঠে যায়। এদিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৭.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা ছিল স্বাভাবিকের ২.৫ ডিগ্রী ওপরে। । মূলত লাগতার বৃষ্টির ঘাটতি স্থলভাগের সাথে নদ-নদীর পানির তাপমাত্রাকেও বৃদ্ধি করছে। এমনকি অত্যধিক তাপ প্রবাহে জেলেরা মাছ ধরে নদীতেও নামতে পারছে না সাথে সীমান্তের ওপারে উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর তলদেশ ভরাট করে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে আরো তরান্বিত করছে। এরসাথে অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্যবর্জ্য অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে অত্যন্ত স্পর্শকাতর মাছ ইলিশের বিচরণকে নিরুৎসাহিত করছে।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এবার গত কয়েকমাস ধরে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি সহ জীব বৈচিত্র্যের নানা পরিবর্তনের সাথে ‘হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল’ নানা সমস্যায় ইলিশের বিচরনস্থল পরিবর্তন হচ্ছে। ইতোপূর্বে খেপুপাড়া, গলাচিপা, রাংগাবালী, মনপুরা,ঢালচর, চরকুকরী-মুকরি, চর কচ্ছপিয়া ও সংলগ্ন এলাকায় ইলিশের মূল বিচরনস্থলে উপস্থিতি এবার এখনো লক্ষণীয় মাত্রায় কম। উজানে কালাবদরের শ্রীপুর,লাহারহাট, মেঘনার ইলিশ ও হিজলাতেও একই পরিস্থিতি। এর পেছনে উজানে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সাথে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে পদ্মা-মেঘনা ও এর শাখা নদ-নদীগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সহ প্রবাহ হ্রাস এবং পানির দূষণও কাজ করছে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীগন মনে করছেন।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট-এর জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. আশরাফুল আলমের মতে, অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে নদ-নদীতে ইলিশের প্রধান খাবার ফাইটো প্লাঙ্কটন ও জু-প্লাঙ্কটনের ঘাটতি অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় প্রকটাকার ধারন করেছে। তারমতে, যেখানে প্রতি লিটার পানিতে ফাইটো প্লাঙ্কটন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার থাকার কথা, সেখানে তা দেড় হাজারের নিচে এবং জিও প্লাঙ্কটন ১৫শর স্থলে কোন কোন নদীতে ২-৩শতে নেমে এসেছে। ফলে খাবারের অভাবেও ইলিশ সাগর উপক’ল অতিক্রম করে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে আসছেনা।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সীমান্তের ওপার হয়ে উজানের সব নদ-নদীর প্রায় ৭০ ভাগ পানি মেঘনা ও এর শাখা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সীমান্তের ওপারে বিবেকহীন নিয়ন্ত্রণে প্রবাহ যেমনি বাধা গ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্যের কারণে দূষণের মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। পাশাপাশির গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহের ফলেও ভরা বর্ষা ছাড়া ইলিশ সাগর থেকে নদী মুখি হচ্ছে না।

 

 

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, জীবনচক্রে অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। পূর্ণাঙ্গ ইলিশ প্রতিদিন স্রোতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলে উপকূলের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারি ক্ষেত্রসমুহে বিচরণ করে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারি ক্ষেত্রসমুহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়িয়ে জাটকা হিসেব কিছুটা বড় হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্বতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২-১৮ মাস অবস্থানে প্রজননক্ষম হয়ে ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারি ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।

 

 

কিন্তু লাগাতর বৃষ্টির অভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে প্রবাহ হ্রাসে নদ-নদীর তলদেশ ভরাটে পানির উষ্ণতা ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সাম্প্রতিককালে উপক’ল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে বিচরণে ইলিশ ক্রমাগত নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীগন মনে করছেন।

এবার গত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত কোন বৃষ্টি হয়নি বরিশালে। এপ্রিলে কিছু বৃষ্টি হলেও তা ছিল স্বাভাবিকের প্রায় ৪৫% কম। আবহাওয়া বিভাগ মে মাসে ২৪৫-৩১০মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের কথা বললেও মাসের প্রথম ১০ দিনে কোন বৃষ্টি হয়নি বরিশালে।

অপরদিকে, বরিশালের হিজলা সংলগ্ন মেঘনার উজানে চাঁদপুর থেকে সাগর মোহনা পর্যন্ত দেড়শর’ও বেশী ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করে মৎস্যগবেষনা ইন্সটিটিউট’এর আশরাফুর আলম জানান, ‘এরফলে ইলিশের গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে। আবার যেখানে নদীর গভীরতা বেশী সেখানে নৌপথের মূল চ্যানেল হওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে পারছে না’। তবে গত কয়েক মাসের ঘাটতি পর মূল বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে, তা ইলিশ সহ উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য ইতিবাচক ফল দেবে বলে আশা করছেন এ মৎস্য বিজ্ঞানী।

বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক ড. সাজেদুল ইসলামের সাথে আলাপ করা হলে তিনিও ‘ইলিশের বংশ বিস্তারে অবাধ বিচরণ ও নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করণে, নদ-নদীর সুষ্ঠু প্রবাহ নিশ্চিত করা সহ দূষণ রোধের পাশাপাশি হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারীর’ আহবান জানিয়েছেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

গত অর্থবছরে দেশে উৎপাদন ৪২ হাজার টন কমল অত্যধিক তাপপ্রবাহ, নাব্যতা সংকটসহ নদী দূষণে অভ্যন্তরীণ নদী মুখি হচ্ছে না ইলিশ

আপডেট টাইম : ১২:০৯:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ঘাটতির সাথে তাপমাত্রার পারদ লাগাতার স্বাভাবিকের ওপরে অবস্থানের পাশাপাশি সীমান্তের ওপারে উজানে নদ-নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে নাব্যতা সংকট বৃদ্ধি সহ শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে এবার বরিশাল অঞ্চল ও সংলগ্ন উপকূলভাগে ইলিশের বিচরণ আশংকাজনক-হারে কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরফলে ইলিশ উপকূল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পরিবর্তে গভীর সমুদ্রে চলে যাবার শঙ্কার কথা বলেছেন অনেকে। এমনকি প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণেই ইলিশের উৎপাদন আগের অর্থ বছরের ৫.৭১ লাখ থেকে গত অর্থ বছরে প্রায় ৪২ হাজার টন হ্রাস পেয়ে ৫.২৯ লাখ টনে স্থির ছিল বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, দেশে উৎপাদিত ও আহরিত ইলিশের ৭০ভাগই বরিশালে। মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ‘আমাদের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ইলিশ উৎপাদনে ভবিষ্যতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক নানা সমস্যা বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে’। মনুষ্য সৃষ্ট নানামুখী বিরূপ প্রভাবের সাথে গত কয়েকবছর ধরে গ্রীষ্মের শুরু থেকেই স্বাভাবিকের বেশী তাপপ্রবাহ ইলিশের ইতোপূর্বের বিচরণ স্থল সহ গতিপথ ও আবাস্থলের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে অবস্থান পরিবর্তনের ফলে উপকূল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ বিচরনস্থল গুলোতে এবার ইলিশের উপস্থিতি আশংকাজনক হারে কম থাকায় আহরণ ঘাটতির ফলে বাজারেও বিরূপ প্রভাব লক্ষণীয়।

মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট-এর একাধিক বিজ্ঞানীর মতে, ইলিশ বিচরণের জন্য যেখানে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন, সেখানে তা ৩৪-৩৫ ডিগ্রী অতিক্রম করছে। রোববার বরিশালে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ৫.৩ ডিগ্রী বেশী, ৩৮.৩ ডিগ্রীতে উঠে যায়। এদিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৭.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা ছিল স্বাভাবিকের ২.৫ ডিগ্রী ওপরে। । মূলত লাগতার বৃষ্টির ঘাটতি স্থলভাগের সাথে নদ-নদীর পানির তাপমাত্রাকেও বৃদ্ধি করছে। এমনকি অত্যধিক তাপ প্রবাহে জেলেরা মাছ ধরে নদীতেও নামতে পারছে না সাথে সীমান্তের ওপারে উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর তলদেশ ভরাট করে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে আরো তরান্বিত করছে। এরসাথে অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্যবর্জ্য অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে অত্যন্ত স্পর্শকাতর মাছ ইলিশের বিচরণকে নিরুৎসাহিত করছে।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এবার গত কয়েকমাস ধরে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি সহ জীব বৈচিত্র্যের নানা পরিবর্তনের সাথে ‘হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল’ নানা সমস্যায় ইলিশের বিচরনস্থল পরিবর্তন হচ্ছে। ইতোপূর্বে খেপুপাড়া, গলাচিপা, রাংগাবালী, মনপুরা,ঢালচর, চরকুকরী-মুকরি, চর কচ্ছপিয়া ও সংলগ্ন এলাকায় ইলিশের মূল বিচরনস্থলে উপস্থিতি এবার এখনো লক্ষণীয় মাত্রায় কম। উজানে কালাবদরের শ্রীপুর,লাহারহাট, মেঘনার ইলিশ ও হিজলাতেও একই পরিস্থিতি। এর পেছনে উজানে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সাথে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে পদ্মা-মেঘনা ও এর শাখা নদ-নদীগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সহ প্রবাহ হ্রাস এবং পানির দূষণও কাজ করছে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীগন মনে করছেন।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট-এর জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. আশরাফুল আলমের মতে, অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে নদ-নদীতে ইলিশের প্রধান খাবার ফাইটো প্লাঙ্কটন ও জু-প্লাঙ্কটনের ঘাটতি অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় প্রকটাকার ধারন করেছে। তারমতে, যেখানে প্রতি লিটার পানিতে ফাইটো প্লাঙ্কটন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার থাকার কথা, সেখানে তা দেড় হাজারের নিচে এবং জিও প্লাঙ্কটন ১৫শর স্থলে কোন কোন নদীতে ২-৩শতে নেমে এসেছে। ফলে খাবারের অভাবেও ইলিশ সাগর উপক’ল অতিক্রম করে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে আসছেনা।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সীমান্তের ওপার হয়ে উজানের সব নদ-নদীর প্রায় ৭০ ভাগ পানি মেঘনা ও এর শাখা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সীমান্তের ওপারে বিবেকহীন নিয়ন্ত্রণে প্রবাহ যেমনি বাধা গ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্যের কারণে দূষণের মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। পাশাপাশির গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহের ফলেও ভরা বর্ষা ছাড়া ইলিশ সাগর থেকে নদী মুখি হচ্ছে না।

 

 

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, জীবনচক্রে অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। পূর্ণাঙ্গ ইলিশ প্রতিদিন স্রোতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলে উপকূলের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারি ক্ষেত্রসমুহে বিচরণ করে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারি ক্ষেত্রসমুহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়িয়ে জাটকা হিসেব কিছুটা বড় হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্বতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২-১৮ মাস অবস্থানে প্রজননক্ষম হয়ে ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারি ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।

 

 

কিন্তু লাগাতর বৃষ্টির অভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে প্রবাহ হ্রাসে নদ-নদীর তলদেশ ভরাটে পানির উষ্ণতা ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সাম্প্রতিককালে উপক’ল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে বিচরণে ইলিশ ক্রমাগত নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীগন মনে করছেন।

এবার গত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত কোন বৃষ্টি হয়নি বরিশালে। এপ্রিলে কিছু বৃষ্টি হলেও তা ছিল স্বাভাবিকের প্রায় ৪৫% কম। আবহাওয়া বিভাগ মে মাসে ২৪৫-৩১০মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের কথা বললেও মাসের প্রথম ১০ দিনে কোন বৃষ্টি হয়নি বরিশালে।

অপরদিকে, বরিশালের হিজলা সংলগ্ন মেঘনার উজানে চাঁদপুর থেকে সাগর মোহনা পর্যন্ত দেড়শর’ও বেশী ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করে মৎস্যগবেষনা ইন্সটিটিউট’এর আশরাফুর আলম জানান, ‘এরফলে ইলিশের গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে। আবার যেখানে নদীর গভীরতা বেশী সেখানে নৌপথের মূল চ্যানেল হওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে পারছে না’। তবে গত কয়েক মাসের ঘাটতি পর মূল বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে, তা ইলিশ সহ উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য ইতিবাচক ফল দেবে বলে আশা করছেন এ মৎস্য বিজ্ঞানী।

বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক ড. সাজেদুল ইসলামের সাথে আলাপ করা হলে তিনিও ‘ইলিশের বংশ বিস্তারে অবাধ বিচরণ ও নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করণে, নদ-নদীর সুষ্ঠু প্রবাহ নিশ্চিত করা সহ দূষণ রোধের পাশাপাশি হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারীর’ আহবান জানিয়েছেন।