যুদ্ধাপরাধের অভিযোগমুক্ত প্রথম জামায়াত আমির

স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী যাদেরকে তাদের নেতা বানিয়েছে তাদের মধ্যে মকবুল আহমাদই প্রথম নেতা যার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা বা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নেই। তবে জামায়াত একান্ত বাধ্য হয়েই তাকে নেতা নির্বাচিত করেছে। কারণ দলটির যারা আলোচিত নেতা ছিলেন ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন একজন। ফাঁসির রায়ের পর দুইজনের শুনানি অপেক্ষায় আছে আপিল বিভাগে। এই অবস্থায় মকবুল আহমাদই সবচেয়ে ‘জ্যেষ্ঠ’ জামায়াত নেতা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামায়াত নেতা মকবুল আহমাদের বিষয়ে আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অভিযোগ পাইনি। যেহেতু অভিযোগ পাইনি সুতরাং তদন্তের প্রশ্নই উঠে না।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল জামায়াত। কেবল বিরোধিতাই করেনি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানান সহযোগিতাও করেছে দলটির নেতারা। জামায়াত ও তাদের সেই সময়ের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ গড়ে তুলে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর আত্মগোপনে যান সংগঠন দুটির নেতারা।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একে একে জামায়াত নেতারা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেন। এ সময় মাওলানা আবদুর রহিম দলের ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের সহায়তার অভিযোগ আছে।

এরপর ১৯৭৫র পর ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে জামায়াতকে প্রকাশ্যে রাজনীতির সুযোগ দেন। ১৯৭৮ সালে দলের আমির গোলাম আযম দেশে ফেরেন। তখন গোলাম আযম পাকিস্তানের নাগরিক। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকায় প্রকাশ্যে আমিরের দায়িত্ব নিতে পারেননি গোলাম আযম। তবে তিনিই ছিলেন দলটির মূল নেতা। এ সময় ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করেন আব্বাস আলী খান। তার বিরুদ্ধেও পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করার অভিযোগ আছে। পরবর্তী সময় গোলাম আযমকে আমির ঘোষণা করা হয়।

এসময় একজন পাকিস্তানি নাগরিককে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের আমির ঘোষণা করায় যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন শুরু হয়।

২০০০ সালে গোলাম আযম রাজনীতি থেকে অবসর নিলে আমির নির্বাচিত হন মতিউর রহমান নিজামী। ২০০৩, ২০০৬ ও ২০০৯ সালের রুকন সম্মেলনে তিনি আমির নির্বাচিত হন। চলতি বছরের ১১ মে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন আমির।

এভাবে প্রকাশ্য রাজনীতি শুরুর পর থেকে জামায়াতে আমির বা সেক্রেটারি জেনারেলহ শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে যারাই ছিলেন তাদের প্রায় সবাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চিহ্নিত দোসর ছিলেন।

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত। শুরু হয় বিচার ঠেকাতে দেশব্যাপী সহিংসতা। দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগে রায় ঘোষণার তা আরও বেড়ে যায়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব সহিংসতার মামলায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের প্রায় সব নেতা হয় কারাগারে, নয়তো আত্মগোপনে চলে যায়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে প্রকাশ্য কর্মসূচিতে নেই জামায়াত।

তাই প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে সাত বছর সম্মেলন করতে পারেনি জামায়াত। ২০১০ সালের জুন মাসে নিজামীসহ শীর্ষ জামায়াত নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে মকবুল আহমাদ ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এবার আমির নির্বাচনের আগে থেকেই গুঞ্জন ছিল যুদ্ধাপরাধের অভিযোগমুক্ত কাউকে আমির নির্বাচন করতে পারে জামায়াত। যে কারণে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমির নির্বাচনের প্যানেলে অভিযোগ আছে এমন কাউকে রাখা হয়নি। এমনকি জনপ্রিয়তা থাকলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকেও প্যানেলে রাখা হয়নি।

জামায়াতের সূত্র জানিয়েছে, গঠনতন্ত্রের ১৫(৩) ধারা অনুযায়ী দলের মজলিসে শূরা গত ১০ আগস্ট আমির নির্বাচনের প্যানেল গঠন করে। প্যানেলে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, নায়েবে আমির সাবেক এমপি মুজিবুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান। প্যানেল নির্বাচনে মকবুল আহমাদ মজলিসে শূরার সর্বোচ্চ ভোট পান, দ্বিতীয় হন শফিকুর রহমান, তৃতীয় স্থানে ছিলেন মুজিবুর রহমান। ঢাকাটাইমস

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর