ঢাকা ০৫:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৩ হাজার আটক, কবে থামবে ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৫১:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫
  • ২০ বার

চট্টগ্রামে একের পর এক দুর্ঘটনা ও ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার কারণ হচ্ছে সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার অবাধ চলাচল। একসময় গলিপথে সীমাবদ্ধ থাকা এই যান এখন প্রধান সড়কগুলোতেও অবাধে ছুটছে। নগরের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার দেখা মেলে না। অভ্যন্তরীণ কিছু সড়কে চলাচলকারী সাশ্রয়ী বাহন হিসেবে পরিচিত এই যান এখন নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীতে নিয়মিত চলাচলকারীরা জানান, ধীরগতির এ বাহন দ্রুতগামী গাড়ির সঙ্গে মিশে গিয়ে সিগন্যাল পয়েন্টে জ্যাম সৃষ্টি করে; হঠাৎ রাস্তার মাঝে থেমে যাত্রী ওঠা-নামা করে, বড় গাড়ির লেনে ঢুকে পড়ে- সব মিলিয়ে এগুলো এখন বড় উৎপাত। প্রতিটি মোড়ে ব্যাটারি-চালিত রিকশা যানজট সৃষ্টি করছে।

বেপরোয়া এই যানের কারণে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ও হতাহতের খবর পাওয়া যায়। সবশেষ গত ১৮ এপ্রিল রাতে চকবাজার থানার কাপাসগোলা এলাকায় একটি ব্যাটারি-চালিত রিকশা উল্টে গিয়ে পড়ে হিজড়া খালে। রিকশায় থাকা দুই নারী বেঁচে গেলেও, তাদের কোলে থাকা ৬ মাস বয়সী শিশু সেহরিজ নিখোঁজ হয়। পরদিন সকালে চাক্তাই খাল থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শোক। পাশাপাশি ক্ষোভের সঞ্চারও হয়।

এরপর নগরজুড়ে ব্যাটারি-চালিত রিকশার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। টানা কয়েকদিনের অভিযানে বিভিন্ন এলাকা থেকে জব্দ করা হয়েছে প্রায় তিন হাজার অটোরিকশা। নগর পুলিশের আওতাধীন ট্রাফিক বিভাগের ডাম্পিং স্টেশন মনসুরাবাদ ও সদরঘাটে জায়গা প্রায় পুরোটা ভরে গেছে জব্দকৃত রিকশায়। এদিকে, অভিযান কঠোর হলেও সরেজমিনে চকবাজার, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, চাক্তাই, কাজীর দেউড়ি, হালিশহর ও পতেঙ্গা এলাকা ঘুরে দেখা যায় এখনো সড়কে বেপরোয়াভাবে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।

সবশেষ আজ (বুধবার) নগরের চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ট্রাফিক বিভাগের অভিযান ও গাড়ি আটকের বিরুদ্ধে রাস্তা অবরোধ করে চালকরা বিক্ষোভ করে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

নগরবাসীর অভিযোগ, কিছু এলাকায় স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এসব রিকশা নির্বিঘ্নে চলছে। কোনো কোনো চালক জানান, আটক হলে জরিমানা দিয়েও তারা রাস্তায় থাকে। আবার প্রতিবারই দুর্ঘটনার পর প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেয়। আটকের পাশাপাশি অনেক চালককে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এসব রিকশা আবার নিয়মমাফিক ছাড়িয়ে নেওয়া হয় এবং কয়েকদিনের মধ্যেই পুনরায় চলাচল শুরু করে।

চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন কী পরিমাণ ব্যাটারি-চালিত রিকশা চলে, তার সঠিক কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংখ্যাটি ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এই বিশাল সংখ্যক রিকশা চালাচ্ছেন মূলত অপ্রশিক্ষিত, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞ কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকেরা। ফলে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে কয়েকগুণ।

চকবাজার এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন অফিসে যেতে রাস্তায় বের হলে দেখি ব্যাটারি-চালিত রিকশার লাইন। তারা কখনো হঠাৎ থেমে যায়, আবার উল্টো পথে চলে আসে। গত সপ্তাহে এক রিকশা আমার বাইকের সামনে ধাক্কা দেয়। আমি পড়ে গিয়ে হাতের কনুইতে চোট পাই। এসব রিকশা চালক আইনও মানে না। তাদের যেন কেউ থামাতে পারছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফারজানা আফরোজ বলেন, আমি প্রায় সময় বাসে করে কালুরঘাট থেকে ২ নম্বর গেট যাই। কিন্তু ব্যাটারি রিকশার কারণে বাসগুলো প্রতিটি সিগন্যালে আটকে থাকে। সময়মতো ক্লাসে পৌঁছানো মুশকিল হয়ে যায়। অথচ মূল সড়কে এই রিকশাগুলোর থাকারই কথা নয়। প্রশাসন মাঝেমধ্যে ধরপাকড় করে, আবার ওরা ফিরে আসে আগের মতোই।

সার্জেন্ট পদমর্যাদার এক ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর কোনো লাইসেন্স নেই, চালকেরা অধিকাংশ সময় অপ্রশিক্ষিত। এসব যানবাহন প্রধান সড়কে চলাচল করার উপযোগী নয়। শহরের যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ এই রিকশা। অনেক সময় দেখা যায়, একটি রিকশা উল্টো পথে গিয়ে পুরো মোড় আটকে দিয়েছে। জরিমানা করলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। আমাদের দরকার স্পষ্ট নীতিমালা, যার মাধ্যমে এসব যান নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশ ট্রাফিক বিভাগের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) নেছার উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করা হয়েছে। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে। কারণ অভিযান চলমান রয়েছে। অভিযানে আটক গাড়িগুলোর বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

৩ হাজার আটক, কবে থামবে ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য

আপডেট টাইম : ০৬:৫১:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

চট্টগ্রামে একের পর এক দুর্ঘটনা ও ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার কারণ হচ্ছে সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার অবাধ চলাচল। একসময় গলিপথে সীমাবদ্ধ থাকা এই যান এখন প্রধান সড়কগুলোতেও অবাধে ছুটছে। নগরের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার দেখা মেলে না। অভ্যন্তরীণ কিছু সড়কে চলাচলকারী সাশ্রয়ী বাহন হিসেবে পরিচিত এই যান এখন নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীতে নিয়মিত চলাচলকারীরা জানান, ধীরগতির এ বাহন দ্রুতগামী গাড়ির সঙ্গে মিশে গিয়ে সিগন্যাল পয়েন্টে জ্যাম সৃষ্টি করে; হঠাৎ রাস্তার মাঝে থেমে যাত্রী ওঠা-নামা করে, বড় গাড়ির লেনে ঢুকে পড়ে- সব মিলিয়ে এগুলো এখন বড় উৎপাত। প্রতিটি মোড়ে ব্যাটারি-চালিত রিকশা যানজট সৃষ্টি করছে।

বেপরোয়া এই যানের কারণে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ও হতাহতের খবর পাওয়া যায়। সবশেষ গত ১৮ এপ্রিল রাতে চকবাজার থানার কাপাসগোলা এলাকায় একটি ব্যাটারি-চালিত রিকশা উল্টে গিয়ে পড়ে হিজড়া খালে। রিকশায় থাকা দুই নারী বেঁচে গেলেও, তাদের কোলে থাকা ৬ মাস বয়সী শিশু সেহরিজ নিখোঁজ হয়। পরদিন সকালে চাক্তাই খাল থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শোক। পাশাপাশি ক্ষোভের সঞ্চারও হয়।

এরপর নগরজুড়ে ব্যাটারি-চালিত রিকশার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। টানা কয়েকদিনের অভিযানে বিভিন্ন এলাকা থেকে জব্দ করা হয়েছে প্রায় তিন হাজার অটোরিকশা। নগর পুলিশের আওতাধীন ট্রাফিক বিভাগের ডাম্পিং স্টেশন মনসুরাবাদ ও সদরঘাটে জায়গা প্রায় পুরোটা ভরে গেছে জব্দকৃত রিকশায়। এদিকে, অভিযান কঠোর হলেও সরেজমিনে চকবাজার, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, চাক্তাই, কাজীর দেউড়ি, হালিশহর ও পতেঙ্গা এলাকা ঘুরে দেখা যায় এখনো সড়কে বেপরোয়াভাবে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।

সবশেষ আজ (বুধবার) নগরের চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ট্রাফিক বিভাগের অভিযান ও গাড়ি আটকের বিরুদ্ধে রাস্তা অবরোধ করে চালকরা বিক্ষোভ করে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

নগরবাসীর অভিযোগ, কিছু এলাকায় স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এসব রিকশা নির্বিঘ্নে চলছে। কোনো কোনো চালক জানান, আটক হলে জরিমানা দিয়েও তারা রাস্তায় থাকে। আবার প্রতিবারই দুর্ঘটনার পর প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেয়। আটকের পাশাপাশি অনেক চালককে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এসব রিকশা আবার নিয়মমাফিক ছাড়িয়ে নেওয়া হয় এবং কয়েকদিনের মধ্যেই পুনরায় চলাচল শুরু করে।

চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন কী পরিমাণ ব্যাটারি-চালিত রিকশা চলে, তার সঠিক কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংখ্যাটি ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এই বিশাল সংখ্যক রিকশা চালাচ্ছেন মূলত অপ্রশিক্ষিত, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞ কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকেরা। ফলে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে কয়েকগুণ।

চকবাজার এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন অফিসে যেতে রাস্তায় বের হলে দেখি ব্যাটারি-চালিত রিকশার লাইন। তারা কখনো হঠাৎ থেমে যায়, আবার উল্টো পথে চলে আসে। গত সপ্তাহে এক রিকশা আমার বাইকের সামনে ধাক্কা দেয়। আমি পড়ে গিয়ে হাতের কনুইতে চোট পাই। এসব রিকশা চালক আইনও মানে না। তাদের যেন কেউ থামাতে পারছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফারজানা আফরোজ বলেন, আমি প্রায় সময় বাসে করে কালুরঘাট থেকে ২ নম্বর গেট যাই। কিন্তু ব্যাটারি রিকশার কারণে বাসগুলো প্রতিটি সিগন্যালে আটকে থাকে। সময়মতো ক্লাসে পৌঁছানো মুশকিল হয়ে যায়। অথচ মূল সড়কে এই রিকশাগুলোর থাকারই কথা নয়। প্রশাসন মাঝেমধ্যে ধরপাকড় করে, আবার ওরা ফিরে আসে আগের মতোই।

সার্জেন্ট পদমর্যাদার এক ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর কোনো লাইসেন্স নেই, চালকেরা অধিকাংশ সময় অপ্রশিক্ষিত। এসব যানবাহন প্রধান সড়কে চলাচল করার উপযোগী নয়। শহরের যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ এই রিকশা। অনেক সময় দেখা যায়, একটি রিকশা উল্টো পথে গিয়ে পুরো মোড় আটকে দিয়েছে। জরিমানা করলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। আমাদের দরকার স্পষ্ট নীতিমালা, যার মাধ্যমে এসব যান নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশ ট্রাফিক বিভাগের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) নেছার উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করা হয়েছে। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে। কারণ অভিযান চলমান রয়েছে। অভিযানে আটক গাড়িগুলোর বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।