২০১৯ সালে ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে ক্রিকেটার মোশাররফ রুবেলের। প্রায় দেড় বছরের চিকিৎসায় সুস্থ হয়েও উঠছিলেন তিনি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এমআরআইয়ে জানতে পারেন যে টিউমারটি আবার বাড়তে শুরু করেছে। তারপর থেকে চলছিল কেমোথেরাপি। অবস্থা কিছুটা ভালোর দিকে যাওয়ায় হাসপাতাল থেকে বাসায়ও ফিরেছিলেন রুবেল। এরপর আবারও ভর্তি হন হাসপাতালে। অতঃপর ২০২২ সালের আজকের এ দিনে (১৯ এপ্রিল) হাসপাতালেই জীবনের ইনিংস শেষ হয় ৪০ বছর বয়সী রুবেলের। মৃত্যুর সময় তিনি স্ত্রী ও পাঁচ বছর বয়সী এক সন্তান রেখে যান।
১৯৮১ সালে ঢাকায় জন্ম নেওয়া রুবেলের পারিবারিক নাম খন্দকার মোশাররফ হোসেন। রুবেল ডাকনামেই বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে পরিচিতি ছিল তার। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মোশাররফ রুবেলের অভিষেক ঘটে ২০০১/০২ মৌসুমে। ঢাকা ডিভিশনের হয়ে অভিষেকের পর থেকেই নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে দ্রুতই ঢাকাই ক্রিকেটে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন রুবেল।
ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মোশাররফ রুবেল জাতীয় দলের পাইপলাইনে চলে আসেন। ২০০৮ সালে দেশসেরা স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের অবসরের পর জাতীয় দলে ডাক পান এই বাঁহাতি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোম সিরিজে ওয়ানডে অভিষেক হয় তার। তবে তিন ম্যাচেই বল হাতে ব্যর্থ হওয়ায় বাদ পড়েন রুবেল।
জাতীয় দলে ফেরার চেষ্টার মাঝেই রুবেল নিয়েছিলেন একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কাঁপিয়ে দিয়ে ভারতের বিদ্রোহী ফ্রাঞ্চাইজি টি টোয়েন্টি লিগ আইসিএলে খেলতে চলে যান জাতীয় দলের ১২ ক্রিকেটার। তাদের নিয়ে আলাদা একটা দলই টুর্নামেন্টে ছিল। ঢাকা ওয়ারিয়র্স নামের সেই দলে ছিলেন তিনিও। বিদ্রোহী লিগে যাওয়ার আগে রুবেল জাতীয় দল থেকে অবসরের চিঠি দেন। আইসিএলে খেলতে যাওয়ায় বিসিবি রুবেলদের ১০ বছরের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে।
তবে এই নিষেধাজ্ঞা টেকেনি বেশিদিন। আইসিএল থেকে ফিরে আসায় বিসিবি রুবেলসহ বাকিদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরেন তিনি।
মোশাররফ রুবেল ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরে শুরুটা দুর্দান্ত করেছিলেন। ২০১৩ সালে বিপিএলের প্রথম মৌসুমে ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের অন্যতম সেরা পারফর্মার ছিলেন তিনি। বিপিএল ফাইনালে ২৬ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ফাইনালের ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পেয়েছিলেন মোশাররফ রুবেল। গ্লাডিয়েটর্সকে চ্যাম্পিয়ন করে রুবেল আবার ডাক পান জাতীয় দলে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে বাংলাদেশ দলে ডাক পান তিনি। তবে রুবেলের জন্য বড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল।
২০১৩ এর বিপিএলে ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের বিপক্ষে ওঠে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ। অভিযোগের তীর উঠেছিল মোশাররফ রুবেলের দিকেও।
উল্লেখ্য, তিনিই সেই দলের খেলোয়াড় ও অফিসিয়ালদের মধ্যে প্রথম যিনি এই অনিয়মের বিষয়টি প্রকাশ করেন। সাময়িক নিষেধাজ্ঞার পর তিনি আবার ফেরেন ঘরোয়া ক্রিকেটে।
মোশাররফ রুবেল বাংলাদেশের ঘরোয়া সার্কিটের নিয়মিত পারফর্মারদের মধ্যে অন্যতম। যেকোনো দল তার ওপর বাজি ধরতে রাজি হতো। বাঁহাতি স্পিনের পাশাপাশি রুবেলের ব্যাটিংয়ের হাতও মন্দ ছিল না। তাই জাতীয় দল থেকে আবার ডাক আসে রুবেলের।
২০১৬ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে ডাক পান রুবেল। প্রায় ৮ বছরের দীর্ঘ বিরতি শেষে জাতীয় দলে ডাক পেয়ে নজির সৃষ্টি করেন রুবেল। ৩৫ বছর বয়সে জাতীয় দলে ফিরেই নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন রুবেল সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে ৩ উইকেট নিয়ে দলের জয়ে অবদান রেখে। তবে ছন্দপতন ঘটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে। বয়সের কারণে রুবেল হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজের রিফ্লেক্স। তাই বাজে ফিল্ডিংয়ের জন্য আবার বাদ পরে যান। ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফর্ম করেও আর খোলেনি জাতীয় দলের দরজা।
জাতীয় দলের হয়ে মোশাররফ রুবেল ৫টি ওয়ানডে খেলে ৪টি উইকেট নিয়েছেন। সেরা বোলিং ফিগার ২৪/৩। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত খেলা এই ক্রিকেটার প্রথম শ্রেণীর ১১২টি ম্যাচ খেলে উইকেট নিয়েছেন ৩৯২টি। ইনিংসে ৫ উইকেট ১৯ বার, ম্যাচে তিনবার নিয়েছেন ১০ উইকেট। লিস্ট এ ক্রিকেটেও ১০৪ ম্যাচ খেলে ১২০ উইকেট পেয়েছেন তিনি। এছাড়াও ৫৬টি টোয়েন্টি ম্যাচে রুবেলের ঝুলিতে আছে ৬০টি উইকেট।
ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার রুবেল ব্যাট হাতেও মন্দ করেননি। ১১২ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১৬২ ইনিংস খেলে রুবেলের সংগ্রহ ৩৩০৫ রান। ব্যাট হাতে ২টি সেঞ্চুরি ও ১৬টি হাফ সেঞ্চুরিও করেছেন এই ব্যাটার। তার সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি ১২৫*। লিস্ট এ ক্রিকেটেও ১০৪ ম্যাচে ৮ হাফ সেঞ্চুরিতে ১৭৯২ রান করেছেন প্রয়াত এই অলরাউন্ডার।