আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। কৃতিত্ব ও সাফল্যের জন্য নারীর প্রতি সম্মান জানানোর দিবস; নারীর অধিকার সচেতনতার দিবস। প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ^ব্যাপী দিবসটি উদযাপন করা হয়। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রতি বছরই একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘ঋড়ৎ ধষষ ড়িসবহ ধহফ মরৎষং : জরমযঃং, ঊয়ঁধষরঃু, ঊসঢ়ড়বিৎসবহঃ.’ বাংলায় বলা হচ্ছে, ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন : নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ এ বছরের প্রতিপাদ্যে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে পুরুষের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণের হার অনেক কম।
তার কারণ, শ্রমবাজারে প্রবেশে নারীকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু উন্নয়নে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ দরকার। নারী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগের এক আলোচনা সভায় বক্তাদের আলোচনায় এসব তথ্য ওঠে আসে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৭৫.৯ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গ্রামে এই হার ৭৬ শতাংশ এবং শহরে ৭৫.৬ শতাংশ। বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যানে বরিশালে নারী নির্যাতনের হার সর্বোচ্চ ৮১.৫ শতাংশ, সবচেয়ে কম সিলেটে ৭২.১ শতাংশ। বিবিএস এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ-২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা, মব জাস্টিস, ঘরে বাইরে নারীরা বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার
হচ্ছেন। এ সংকট নিরসনে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তিমি সানজানা বলেন, যে কোনো পরিবর্তনে বা ক্রান্তিকালে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় নারী ও শিশু। বর্তমানেও তাই দেখা যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৫টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারি মাসে ৭২ জন কন্যা, এবং ১১৭ জন নারীসহ ১৮৯ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩০ জন কন্যাসহ ৪৮ জন। তিনজন কন্যাসহ ১১ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, একজন কন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুরুটা হয়েছিল শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকে এটা জাতিসংঘ স্বীকৃত বাৎসরিক দিবস হয়ে ওঠে। ১৯০৮ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের একটি পোশাক কারখানার নারী পোশাক শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি ও শ্রমের দাবিতে আন্দোলন করেন। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল পুরুষের সমান মজুরি, দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং অনেককে আটক করে। ১৯০৮ সালের একই দিনে নিউইয়র্কে পোশাক শ্রমিক ইউনিয়নের নারীরা আরেকটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। ১৪ দিন ধরে চলা এ সম্মেলনে যোগ দেন প্রায় ২০ হাজার নারী শ্রমিক। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রম, শিশুশ্রম বন্ধের দাবিতে তারা এ সমাবেশ করেন। কর্মক্ষেত্রে এই আন্দোলন নারীদের ঐক্যবদ্ধতার একটি বড় উদাহরণ।
এর এক বছর পর আমেরিকা সোম্যালিস্ট পার্টি সর্বপ্রথম নারী দিবসের ঘোষণা করে। এরপর ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ক্লারা জেটকিন নারীর ভোটাধিকার এবং একটি নারী দিবস ঘোষণার দাবি জানান। ১৯১১ সালে অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯১৩ সালে রাশিয়ার নারীরা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার নারী দিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। ২০১১ সালে পালিত হয় দিবসটির শতবর্ষ।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রঙ বেগুনি, সবুজ এবং সাদা। কেন এই রঙ? বেগুনি রঙ দিয়ে ন্যায়বিচার এবং মর্যাদাকে বুঝানো হয়। সবুজ আশার প্রতীক। আর সাদা হলো বিশুদ্ধতার প্রতীক। বিশে^র একেক প্রান্তে নারী দিবস একেক লক্ষ্যে উদযাপিত হয়। রাশিয়াসহ বিশে^র অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। চীনের অনেক স্টেটে কাউন্সিলের বিবেচনায় ৮ মার্চ নারীদের অর্ধ দিবস ছুটি দেওয়া হয়। ইতালিতে এই দিনে নারীদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।
প্রতি বছর এই দিবসে উঠে আসে বিশ^ব্যাপী নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কতটা এগিয়েছেন। শুধু দক্ষিণ এশিয়াই না, বিশ^ব্যাপী নারীরা তাদের কাজে, জীবনযাপনে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হন। তবুও তারা সমাজের সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস শুধু একটি দিন উদযাপনের জন্য নয়। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশ তথা জাতীর উন্নয়নে চাই নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। নারী দিবসে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়েও সচেতনতা তৈরিতে কাজ করা হয়।