সেই রক্তপাত ছিল না তাজিয়া মিছিলে

মিছিলের মাঝে কিছু তরুণ এক গোছা ছুরি-কাঁচি দিয়ে বারবার পিঠে আঘাত করছেন আর বলছেন, ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’। তাদের পিঠ, পরনের কাপড় রক্তাক্ত। মিছিলের শেষ পর্যন্ত তারা নেচে নেচে এভাবে আঘাত করেই যান।

আশুরার এই চিরাচরিত দৃশ্য এবার দেখা যায়নি তাজিয়া মিছিলে। দেখা যায়নি কোনো বল্লম, তলোয়ার কিংবা লাঠি।

কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মরণে পুরান ঢাকার হোসেনি দালান থেকে বের হয় পবিত্র আশুরার তাজিয়া মিছিল। নিরাপত্তার কারণে এবার ধারালো অস্ত্র ও লাঠি বহন নিষিদ্ধ ছিল বলে তাজিয়া মিছিল ছিল ভিন্ন রকম।

বুধবার সকাল ১০টায় পুরান ঢাকার হোসনি দালান রোড থেকে কালো পোশাক পরে ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’, ‘হায় আমার ঈমাম’, ‘আমার ছালাম লও ওহে নানা জান/তোমার হোসেন যায় কারবালার ময়দান’ ধ্বনিতে হাজারো ভক্ত-অনুরাগীর অংশগ্রহণে তাজিয়া মিছিল শুরু হয়। এরপর বকশিবাজার, আজিমপুর, নিউমার্কেট, সাইন্সল্যাব হয়ে বেলা দেড়টায় ধানমন্ডির জিগাতলায় গিয়ে শেষ হয় মিছিল।

মিছিল আয়োজনকারী হোসনি দালান ইমামবাড়ার ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ফারুক হোসেন বলেন, ‘নিরাপত্তার কারণে এবার তাজিয়া মিছিলে ‘হায় হোসেন’ বলে ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি নিয়ে নিজেদের শরীর রক্তাক্ত করার রীতি পালন করা হয়নি। আসলে ঈমার হোসেনের কষ্ট অনুভব করতেই এটা করা হতো।’

জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে আনেককে দেখা গেছে শিন্নি বিতরণ করতে। কেউ আবার জিলাপি ও পানি বিলাচ্ছেন। অনেকে একটি গাড়িতে কবুতর ও মুরগি রাখছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুরান ঢাকা থেকে তাজিয়া মিছিলে আসা মিলন হায়দার বলেন, অনেকে মানত করে কবুতর ও মুরগি দিয়ে থাকে। তিন দিন পর (১৫ অক্টোবর) মিরপুর-১২ নম্বরে এগুলো দিয়ে শিন্নি রেঁধে বিতরণ করা হবে।

তাজিয়া মিছিল শেষে নিশান বহন করা বাঁশ ও বিভিন্ন সরঞ্জাম ধানমন্ডি লেকে ভেজানো হয়। এ সময় অনেককে পানিতে নেমে গোসল করতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে আব্বাস আলি বলেন, ‘আমি এবারই প্রথম এসেছি। আমি এখানে গোসল করেছি আমার বোনের যেন ছেলে হয়, সে নিয়ত করে।’

তাজিয়া মিছিলে অংশ নেয়া এহসান আহমেদ বলেন, ‘যেকোনো পবিত্র জিনিস আমরা পানিতে ফেলি। সেভাবেই আমরা মিছিল শেষে পবিত্র জিনিসগুলো পানিতে ফেলি। পানি সব সময়ই পবিত্র থাকে। যার যার বাঁশ নিয়ে যাবে, আবার আগামী বছর এ বাঁশে নিশান লাগানো হবে।’

মিছিলে আসা জোহরা বেগম বলেন, ‘ইসলামকে জিন্দা করার জন্য কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেন শহীদ হয়েছেন। সে সময় কোনো শোক পালন করা হয়নি। তাই প্রতি বছর এই দিনটিতে আমরা শোক পালন করি।’ গত বছর নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন উল্লেখ করে জোহরা বলেন, ‘কিন্তু এবার সেটা নেই। শিশু, তরুণ থেকে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে অংশ ‍নিতে পেরেছে।’

গত বছর আশুরার আগের রাতে হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় বোমা হামলায় দুজন নিহত ও বহু লোক আহত হয়। ওই ঘটনার কারণে এবার মিছিলে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মিছিলের সামনে-পিছনে ও পাশে পাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য ছিলেন। জিগাতলা এলাকায় বাসার ছাদেও পুলিশ সদস্যদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

লালবাগ থানার এসআই ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা সর্বো্চ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য এবার মিছিলে ধারালো অস্ত্র ও লাঠি বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’ সুশৃঙ্খলভাবে মিছিল শেষ হওয়ায় আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান তিনি।

হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালার ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। কারবালার বিয়োগান্তক সেই ঘটনাকে স্মরণ করে শোক ও ত্যাগের প্রতীক হিসেবে এই দিনে তাজিয়া মিছিল, বিশেষ মোনাজাত, কোরআন খানি, দোয়া মাহফিল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পবিত্র আশুরা পালন করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর