আসন্ন রমজানে ও গ্রীষ্মে পুরোপুরি লোডশেডিংমুক্ত থাকবে না দেশ। রমজানে (মার্চ মাসে) গড়ে ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট এবং গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল-মে মাসে) গড়ে ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকবে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে সচেষ্ট সরকার। তবে আর্থিকসহ নানা কারিগরি সংকটে এ সময়কালে চাহিদার সবটুকু বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে না। সহনীয় লোডশেডিং থাকবে। কিন্তু সেটা শুধু গ্রামে নয়। লোডশেডিংয়ে শহর-গ্রামের ভারসাম্য থাকবে। আসন্ন গ্রীষ্মে ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। এসব তথ্য জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
বিদ্যুৎ ভবনে গতকাল বিকালে আসন্ন রমজান ও সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহসংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে উপদেষ্টা এসব কথা জানান। এ সময় জ্বালানি সচিব, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উপদেষ্টা জানান, গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ১৮০০ মেগাওয়াট। তবে রমজানে লোডশেডিং মুক্ত রাখতে চেষ্টা করা হবে বলে জানান তিনি।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানির সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় রমজানে দেশ লোডশেডিং মুক্ত রাখতে কোন ধরনের জ্বালানির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে? এমন প্রশ্নে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাসের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। রমজানে লোডশেডিং মুক্ত রাখতে আমরা অতিরিক্ত চার কার্গো গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করব। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। রোজার মাসের জন্য ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, গ্রীষ্মে মূলত সেচের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। সেচে আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ দিতে চাই। নয়তো খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি ব্যবস্থপনায় সংকট তৈরি হবে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে এ বছর গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি জোর দেওয়া হবে, জানান উপদেষ্টা।
ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রাথমিক জ্বালানি সমস্যার কারণে লোডশেডিং করতে হয়। প্রথম মিটিং করেছি অর্থ সংস্থানের জন্য। রোজা ও গ্রীষ্ম মৌসুমে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। রোজার মাসে যে পরিমাণ জ্বালানি প্রয়োজন হবে, সেটা আমদানির অর্থ প্রদানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পরে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছি যাতে করে জ্বালানি আমদানি করতে বৈদেশিক মুদ্রারও সংকট না হয়।
লোডশেডিংয়ের কারণ সম্পর্কে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, আর্থিক কারণে নয়, অপচয়ের কারণে লোডশেডিং হবে। কুলিং লোডের (এসির লোড) কারণে লোডশেডিং হবে। তিনি বলেন, গ্রীষ্মে কুলিং লোডের পরিমাণ হচ্ছে ৬ হাজার মেগাওয়াট। আমরা যদি এসি তাপমাত্রা ২৫/২৬ রেখে চালাই, তাহলে তিন হাজার মেগাওয়াট সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে টেলিভিশনগুলোতে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে। লোডশেডিং নানা কারণে হয়। টেকনিক্যাল কারণ ছাড়া লোডশেডিং যেন না হয়, সে জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা বলেন, এবার লোডশেডিং করার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করা হবে না। ঢাকা থেকে লোডশেডিং শুরু হবে। শহর গ্রামে সমান লোডশেডিং হবে। এসির কুলিং লোড নিয়ন্ত্রণ করা বাস্তবসম্মত হবে কিনা এমন এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করব মানুষকে সচেতন করতে যাতে এসি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় রেখে চালায়।
বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিপুল অঙ্কের বকেয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ সরবরাহ যাতে বন্ধ করতে না হয়, সে জন্য তাদের বকেয়াও পরিশোধ করা হবে। সম্পূর্ণ হয়তো করা যাবে না।
আদানি পাওয়ার যে বকেয়া পায়, সেটা না দিলে তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে কিনা এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, আমরা আশা করব, রমজান ও গ্রীষ্মে তারা নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। আমরা তাদের বকেয়া অর্থ পরিশোধের চেষ্টা করছি। সেটা সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক পরিশোধ করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেসব কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া গেছে কিনা? এ প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, বড় সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনায় যে কমিটি কাজ করছে, তাদের আইনি সহায়তা প্রয়োজন। সেটি নিয়ে কাজ চলছে। এ ছাড়া ট্যারিফ পুনর্মূল্যায়নে করা কমিটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের বিদ্যুতের দামের বিষয়ে একটি বেঞ্চমার্ক নির্ধারণ করেছে। আমরা মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের বেঞ্চমার্ক করেছি। ইউনিট প্রতি মূল্য ধরা হয়েছে ৮ টাকা ৪০ পয়সা। এখন এই বেঞ্চমার্ক ধরে অন্যান্য কেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এর পরও সবার প্রতি অনুরোধ, একান্ত প্রয়োজন না হলে বাজার-সদাই রাতে না করা। তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যুতের সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট বলা হলেও প্রকৃত ক্ষমতা ১৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো। এরপরও আমরা নির্দেশনা দিয়েছি প্রকৃত সক্ষমতা নির্ধারণ করতে।