নেদারল্যান্ডস ও ভারতের সব চেয়ে জনপ্রিয় ফুল ‘জারবেরা’র চাষ হচ্ছে মানিকগঞ্জে। জেলার পাটুরিয়ার ধুতরা বাড়ি এলাকার ইঞ্জিনিয়ার আফতাব উদ্দিন খান প্রদর্শনী প্রকল্পের মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরু করলেও এখন তিনি বাণিজ্যিকভাবে এই ফুলের চাষ করছেন। এই ফুলের মাধ্যমে বছরে তিনি আয় করছেন প্রায় ১৫ লাখ টাকা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রোজালিন, ফিরোজা, ব্যালাঞ্চ, ডেনা, ইলেন, ডুনি, কুল্ড কী নেই- এই বাগানে। প্রথমে চার রকমের ফুল দিয়ে বাগানের কার্যক্রম শুরু হলেও এখন এই বাগানে চার রঙের শোভা পাচ্ছে ১৩ প্রজাতির ফুল।
২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে পাটুরিয়া আরসিএল মৌরের পূর্ব পাশে জারবেরা ফুলের চাষ শুরু করেন আফতাব উদ্দিন খান। এই বাগান সংরক্ষণে দিন-রাত কাজ করছেন পাঁচ কর্মচারী। বাগানের পরির্চযা, ফুল তোলা, ফুল র্যাপিং করাসহ ঢাকায় পাঠানোর যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেন তারা। আর সার্বিক তদারকির দায়িত্বে আছেন একজন ইনচার্জ। বাগানের প্রয়োজনে কখন কি দরকার, সেদিক খেয়াল রাখেন তিনি।
যেভাবে শুরু: মানিকগঞ্জের শিবালয়ের ধুতরা বাড়ি মৌজার পাটুরিয়া আরসিএল মৌর এলাকায় ব্যবসায়ী আফতাফ উদ্দিন খানের বিশাল এই জমিটি এক সময় পরিত্যক্ত ছিল। একদিন পরিচিত এক ব্যক্তির সাথে তিনি আলাপ করলেন বাগান তৈরি করার। এরপর গোলাপ, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে করা হয় প্রদশর্নী বাগান। এ জন্য নিয়োগ দেয়া হয় পাঁচজন কর্মচারী। এরপর তাদের মাথায় আসে কীভাবে বিদেশি ফুল জারবেরর চাষ করা যায়। এ নিয়ে কথা হয় আফতাব উদ্দিন খানের সহযোগী বর্তমানে বাগানের ইনচার্জ আমিরুজ্জামান চৌধুরীর সাথে। তিনি তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন জারবেরার বাগান তৈরি করতে।
এ ব্যপারে এক্সপেক্টা বাগানের ইনচার্জ আমিরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ২০১৩ সালে স্যার আমাকে বাণিজ্যকভাবে ফুল বিক্রির কথা জানালেন। তিনি বললেন, কীভাবে ফুল বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়। এ জন্য তিনি আমাকে প্রজেক্ট দেয়ার কথা জানালেন। আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা বিশেষ করে যশোরের গতখালী ঘুড়ে এসে স্যারকে জারবেরা ফুলের প্রজেক্ট করার কথা বললাম। এই ফুল চাষে কীভাবে লাভবান হওয়া যায়- সে বিষয়টি স্যারকে বুঝালাম। এরপর স্যার আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাগানের ইনচার্জ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বললেন, জারবেরা ফুলের বাগান আমাকে করতে হবে। এ জন্য তিনি আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করার কথা জানালেন। এরপর আমি আবার চলে গেলাম যশোরের গতখালীতে। সেখানে সার্বিক বিষয়টি বুঝে কোথায় জারবেরা ফুলের চারা পাওয়া যায়, সেটা জানলাম। এরপর বিষয়টি আবার স্যারকে জানালাম। স্যার আমাকে চারা ক্রয় করার সব ধরনের ব্যবস্থা করতে বললেন। আমি চলে গেলাম ভারতের মহারাষ্ট্রের পৌনেতে। সেখানে কেএফ বায়োপ্ল্যান নামে একটি প্রতিষ্ঠান টিস্যু আকৃতির এই চারা এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে ওখান থেকেই চারা এনে পরীক্ষামূলক এক বিঘা জমিতে জারবেরা ফুলের আবাদ শুরু করলাম। এ সময় আমি পৌনেতে গিয়ে জানতে পারলাম নেদারল্যান্ডের ফরিস্ট এবং ভারতের মহারাষ্ট্রের কুমার যৌথভাবে প্রজেক্ট করছে।
তিনি বলেন, আমি ভারতের পৌনেতে চারা আনতে যাওয়ার আগে বৃষ্টি ঠেকাতে পলি শেড তৈরি কাজ শেষ করা হলো। এতে সব মিলিয়ে খরচ হলো ১৫ লাখ টাকা। প্রথম অবস্থায় এক বছরে জারবেরা ফুল বিক্রি বাবদ আয় হয় ১২ লাখ টাকা। এরপর ফুল বিক্রির ১২ লাখ টাকা দিয়ে আরো একটি শেড তৈরি করা হয়। এখন মোট আড়াই বিঘা জমির উপর দুটি শেডের নিচে ১০ হাজার পিস চারা রোপন রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে এই বাগান থেকে ১৩ কালারের প্রায় ১২ হাজার জারবেরা ফুল তোলা হয়।3
বাগান তৈরি ও জারবেরা ফুলের বড় শত্রু: পানি সহনশীল না হওয়ায় জারবেরা ফুল চাষ করতে হলে প্রথমে তৈরি করতে হয় উপরের পলি শেড। এরপর বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে লম্বা আকারে তৈরি করতে হয় বেড। একটি বেড থেকে অন্য আরেকটি বেড়ের দূরত্ব থাকে ২৪ ইঞ্চি। আর রোপন করা একটি চারা থেকে অন্য আরেকটি চারার দূরত্ব থাকে ১৩ ইঞ্চি। তিন বছরের এই প্রজেক্ট, প্রধানত শীতকালে এই জারবেরা ফুলের চাষ ভাল হয়। ঈদ, পূজা, বিশ্ব ভালবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ, ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চে এই ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। ফুলের বাজার ভাল থাকলে প্রতি পিচ বিক্রি হয় ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। এছাড়া এই ফুল বাকি সময়ে বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ টাকায়।
এই জারবেলা ফুলের সবচেয়ে বড় শত্রু লাল মাকুর। বালাই হিসেবে এই লাল মাকুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে জারবেরা ফুলের। এই পোকার হাত থেকে রক্ষায় ককোডাস, পটাশ, টিএসপি ও দস্তা সংমিশ্রনের সার ব্যবহার করতে হয়।
এক্সপেক্টা ফ্লাওয়ার গার্ডেনের কর্মচারী শান্ত মিয়া বলেন, এই বাগান থেকে সপ্তাহে ৪ দিন জারবেরা ফুল তোলা হয়। একেক দিন ২ থেকে ৩ হাজার পিস ফুল তোলা হয়। সেই হিসাবে সপ্তাহে ১০ থেকে ১২ হাজার পিস জারবেরা ফুল বাগান থেকে তোলা হয়। বাগান থেকে ফুল তুলে প্রথমে র্যাপিং করা হয়। এরপর ফুলের গার্ডার তৈরি করা হয়। পরে বাস দিয়ে বাসকেট তৈরি করে বিআরটিসি বাসে পাঠানো হয় ফুল বাজার ঢাকার শাহবাগে। এরপর ব্যবসায়ীরা ফুল হাতে পেয়ে বাজার মূল্যে আমাদের পরিশোধ করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলিমুজ্জামান মিয়া বলেন, নেদারন্যান্ড ও ভারতে জনপ্রিয় ফুল জারবেরা। এই ফুল চাষ লাভজনক হলেও বিভিন্ন খাতে অত্যাধিক খরচ হওয়ায় বাংলাদেশের চাষিরা জারবেরা ফুল চাষে আগ্রহ দেখান না। তবে এই ফুল চাষে কোন চাষি আগ্রহ দেখালে তাকে সরকারিভাবে স্বল্প শোধে ঋণ দেয়া হবে।