ঢাকা ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিএনপির ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই অভ্যুত্থান

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:১৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৯ বার

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পরিক্রমা তুলে ধরে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। ফ্যাসিবাদ যাতে আর ফিরে না আসে, এ বিষয়ে ঘোষণাপত্রে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনা সরকারের শুরু থেকে ক্ষমতাচ্যুতি পর্যন্ত গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার নিশ্চিতের বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া ন্যূনতম সময়ে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারে মানুষের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রকে ‘প্রোক্লেমেশন’ না বলে ‘ডিক্লারেশন’ বলে উল্লেখ করেছে দলটি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে বিএনপির খসড়া ঘোষণাপত্র পর্যালোচনায় এসব তথ্য জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি চায়, তাহলে তারা এই ঘোষণাপত্র তুলে দেবেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা গত ৩১ ডিসেম্বর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের

ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ নিয়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর আপত্তিতে তা আটকে যায়। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। পাশাপাশি ঘোষণাপত্র প্রণয়ন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ডাকে গত ১৬ জানুয়ারি সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। ওই বৈঠকে ঘোষণাপত্র নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। পরে এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে একাধিক বৈঠক করেছে বিএনপি। বৈঠকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এতদিন পরে এসে ঘোষণাপত্রের যৌক্তিকতা, প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না- এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে চূড়ান্তভাবে ছাত্রদের প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে বাস্তবতার নিরিখে খসড়ায় প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তারই আলোকে দলটি এই খসড়া ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করেছে।

খসড়া ঘোষণাপত্র নিয়ে ইতোমধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিচ্ছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গতকাল শুক্রবার ১২ দলীয় জোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। এ দিন বৈঠক হয়েছে খেলাফত ইসলামীর সঙ্গেও। পর্যায়ক্রমে যুগপতের অন্য শরিকদেরও মতামত নেওয়া হবে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে পৃথকভাবে রাজপথে সক্রিয় থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী অন্য দলগুলোর সঙ্গে বসবে বিএনপি। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে চায় তারা। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, খসড়া ঘোষণাপত্রের মৌলিক পরিবর্তন করতে চায় না বিএনপি। তবে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে টুকটাক পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন প্রয়োজন হলে করা হবে।

ছাত্রদের ও বিএনপির করা খসড়া ঘোষণাপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল থাকলেও কিছু পার্থক্য রয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে ছাত্ররা স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ আর বিএনপি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলেছে। ঘোষণাপত্রে বিএনপি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা হওয়ার কথা বলেছে, যেটি ছাত্রদের ঘোষণাপত্রে নেই। ছাত্রদের ঘোষণাপত্রে সংবিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের মতামত ও প্রত্যাশা প্রতিফলনে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ করার পথ সুগম করেছিল। এ ছাড়া বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন করে বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। তাই আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।

বিএনপির খসড়া ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদের পতনের পর সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিমকোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আকাক্সক্ষা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়, সেহেতু জনগণ, সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার করা যায়।

ছাত্ররা নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার চান। তাদের খসড়ায় বলা হয়েছে, আমরা সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ নিশ্চিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবে- এমন অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। অন্যদিকে বিএনপি ন্যূনতম সময়ে জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচিত জাতীয় সংসদে সাংবিধানিক সংস্কারের পক্ষে। খসড়ায় বলা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ ন্যূনতম সময়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে দুই খসড়ায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ছাত্রদের খসড়ায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং অবৈধ ও অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। বিএনপি বলেছে, ফ্যাসিবাদের পতনের নিমিত্তে ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সব শ্রেণি-পেশার আপামর জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে অবৈধ, অনির্বাচিত, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

ছাত্রদের খসড়ায় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের পরিসংখ্যান না থাকলেও বিএনপির ঘোষণাপত্রে সেটি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এতে হয়েছে, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র আন্দোলনে সমাজের সব স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং রাজপথে নারী-শিশুসহ দুই সহস্রাধিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়; অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে।

আওয়ামী শাসনামলে নির্যাতনের শিকারদের নিয়েও ভিন্নতা রয়েছে খসড়ায়। ছাত্রদের খসড়ায় বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী আমলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র ছাত্র ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়। বিএনপির ঘোষণাপত্রে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

খসড়ায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের দাবি জানানো হয়েছে। তবে অপরাধের কার্যকাল নিয়ে ভিন্নতা রয়েছে। ছাত্রদের খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী আপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচারের দাবি জানাচ্ছি। বিএনপি বলেছে, বাংলাদেশের জনগণ বিগত ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধসমূহের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের অবসানে একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন বলে মনে করেন ছাত্ররা। ঘোষণাপত্রে তারা বলেছে, ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সব ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। ছাত্ররা তাদের ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে বলেছে, এই ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বিএনপির ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই অভ্যুত্থান

আপডেট টাইম : ১০:১৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পরিক্রমা তুলে ধরে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। ফ্যাসিবাদ যাতে আর ফিরে না আসে, এ বিষয়ে ঘোষণাপত্রে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনা সরকারের শুরু থেকে ক্ষমতাচ্যুতি পর্যন্ত গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার নিশ্চিতের বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া ন্যূনতম সময়ে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারে মানুষের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রকে ‘প্রোক্লেমেশন’ না বলে ‘ডিক্লারেশন’ বলে উল্লেখ করেছে দলটি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে বিএনপির খসড়া ঘোষণাপত্র পর্যালোচনায় এসব তথ্য জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি চায়, তাহলে তারা এই ঘোষণাপত্র তুলে দেবেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা গত ৩১ ডিসেম্বর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের

ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ নিয়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর আপত্তিতে তা আটকে যায়। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। পাশাপাশি ঘোষণাপত্র প্রণয়ন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ডাকে গত ১৬ জানুয়ারি সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। ওই বৈঠকে ঘোষণাপত্র নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। পরে এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে একাধিক বৈঠক করেছে বিএনপি। বৈঠকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এতদিন পরে এসে ঘোষণাপত্রের যৌক্তিকতা, প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না- এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে চূড়ান্তভাবে ছাত্রদের প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে বাস্তবতার নিরিখে খসড়ায় প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তারই আলোকে দলটি এই খসড়া ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করেছে।

খসড়া ঘোষণাপত্র নিয়ে ইতোমধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিচ্ছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গতকাল শুক্রবার ১২ দলীয় জোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। এ দিন বৈঠক হয়েছে খেলাফত ইসলামীর সঙ্গেও। পর্যায়ক্রমে যুগপতের অন্য শরিকদেরও মতামত নেওয়া হবে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে পৃথকভাবে রাজপথে সক্রিয় থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী অন্য দলগুলোর সঙ্গে বসবে বিএনপি। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে চায় তারা। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, খসড়া ঘোষণাপত্রের মৌলিক পরিবর্তন করতে চায় না বিএনপি। তবে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে টুকটাক পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন প্রয়োজন হলে করা হবে।

ছাত্রদের ও বিএনপির করা খসড়া ঘোষণাপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল থাকলেও কিছু পার্থক্য রয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে ছাত্ররা স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ আর বিএনপি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলেছে। ঘোষণাপত্রে বিএনপি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা হওয়ার কথা বলেছে, যেটি ছাত্রদের ঘোষণাপত্রে নেই। ছাত্রদের ঘোষণাপত্রে সংবিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের মতামত ও প্রত্যাশা প্রতিফলনে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ করার পথ সুগম করেছিল। এ ছাড়া বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন করে বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। তাই আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।

বিএনপির খসড়া ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদের পতনের পর সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিমকোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আকাক্সক্ষা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়, সেহেতু জনগণ, সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার করা যায়।

ছাত্ররা নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার চান। তাদের খসড়ায় বলা হয়েছে, আমরা সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ নিশ্চিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবে- এমন অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। অন্যদিকে বিএনপি ন্যূনতম সময়ে জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচিত জাতীয় সংসদে সাংবিধানিক সংস্কারের পক্ষে। খসড়ায় বলা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ ন্যূনতম সময়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে দুই খসড়ায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ছাত্রদের খসড়ায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং অবৈধ ও অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। বিএনপি বলেছে, ফ্যাসিবাদের পতনের নিমিত্তে ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সব শ্রেণি-পেশার আপামর জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে অবৈধ, অনির্বাচিত, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

ছাত্রদের খসড়ায় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের পরিসংখ্যান না থাকলেও বিএনপির ঘোষণাপত্রে সেটি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এতে হয়েছে, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র আন্দোলনে সমাজের সব স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং রাজপথে নারী-শিশুসহ দুই সহস্রাধিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়; অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে।

আওয়ামী শাসনামলে নির্যাতনের শিকারদের নিয়েও ভিন্নতা রয়েছে খসড়ায়। ছাত্রদের খসড়ায় বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী আমলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র ছাত্র ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়। বিএনপির ঘোষণাপত্রে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

খসড়ায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের দাবি জানানো হয়েছে। তবে অপরাধের কার্যকাল নিয়ে ভিন্নতা রয়েছে। ছাত্রদের খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী আপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচারের দাবি জানাচ্ছি। বিএনপি বলেছে, বাংলাদেশের জনগণ বিগত ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধসমূহের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের অবসানে একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন বলে মনে করেন ছাত্ররা। ঘোষণাপত্রে তারা বলেছে, ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সব ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। ছাত্ররা তাদের ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে বলেছে, এই ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে।