বছর ঘুরে আবারও চলে এসেছে ডিসেম্বর। বছরের শেষ মাস। বছরজুড়ে বিশ্বব্যাপী ঘটেছে নানান ঘটনা। এই বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটেছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এমন সব ঘটনা নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জামিউর রহমান
ভারতের নির্বাচন
বিশ্বের বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারত। এ বছর দেশটির ১৮তম সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সাত দফায় সম্পন্ন হয়েছে। ম্যারাথন এই ভোট শুরু হয়েছিল ১৯ এপ্রিল, শেষ হয় ১ জুন। এবারের লোকসভা নির্বাচন শুরু ভারতের নয়, বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচন। এতে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৭ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ। এবারের নির্বাচনে টানা তৃতীয় দফায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। জোটের শরিক দলগুলোর সমর্থন নিয়েই প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছে তাকে। ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৪০ আসনে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। আর প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পেয়েছে ৯৯টি আসন। কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। তবে জোটগতভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২ আসনের বেশি পেয়েছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। তারা পেয়েছে ২৯৩টি আসন। অন্যদিকে ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩২ আসন।
মার্কিন নির্বাচন
কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ জয় পেয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালে ইলেকটোরাল কলেজে জয় পেলেও পপুলার ভোটে হেরেছিলেন, এবার ইলেকটোরাল-পপুলার উভয় ক্ষেত্রে এগিয়ে থেকেই জয় পেয়েছেন। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জরিপে দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হলেও আগের দুই নির্বাচনের মতো লড়াই হয়নি এবার। ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর প্রথম থেকেই এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৯৫ ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প, কমলা পেয়েছেন ২২৬। জয়ের জন্য ট্রাম্পের প্রয়োজন ছিল ২৭০ ভোট। ২০০৪ নির্বাচনের পর প্রথম রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জিতলেন ট্রাম্প। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, ট্রাম্প প্রায় ৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। কমলা পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ছয় শতাংশ ভোট। সাতটি দোদুল্যমান রাজ্যের ওপর এ নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করার কথা ছিল। এর মধ্যে পাঁচটিতে (জর্জিয়া, মিশিগান, পেলসিলভানিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, উইসকনসিন) ইতোমধ্যে ট্রাম্পকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি দুই অঙ্গরাজ্য, নেভাদা ও অ্যারিজোনাতেও এগিয়ে আছেন তিনি। মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ, সিনেটে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফিরে পেয়েছে রিপাবলিকান পার্টি। নির্বাচনের আগে ১০০ আসনের সিনেটে ৫১-৪৯ ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল ডেমোক্র্যাটদের। এবার সিনেটের ৩৪টি আসনে নির্বাচন হয়েছে, এর মধ্যে ডেমোক্র্যাটদের দখলে ছিল ২৩টি আসন, রিপাবলিকানদের ১১টি।
ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যু
এই বছর ১৯ মে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদোল্লাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারে থাকা সবাই নিহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যা ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দুর্ঘটনার পর পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পাহাড়ি ও তুষারাবৃত এলাকায় ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় অনুসন্ধানী দল। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানানো হয়, সেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। এর আগে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়া এলাকায় একটি ‘হিট সোর্স’ (উত্তপ্ত স্থান) শনাক্ত করেছিল তুরস্কের পাঠানো ড্রোন।
হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ের মৃত্যু
এই বছর ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ে ইসরায়েলি হামলায় ‘নিহত’ হয়েছেন। এক বিবৃতিতে হামাস জানায়, ইরানের রাজধানী তেহরানে তার বাসস্থানে ‘জায়নবাদী গুপ্ত হামলায়’ এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে তারা। হামাস বলছে, ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়। ৩১ জুলাই ইরানের স্থানীয় সময় রাত দুইটার দিকে বিমান হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয় বলে জানা গেছে। এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হামাস, যদিও ইসরায়েলের তরফ থেকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
ইসমাইল হানিয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ইসমাইল আবদেল সালাম হানিয়ে, যার ডাকনাম আবু আল-আবদ, জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে। তিনি হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইসরায়েল ১৯৮৯ সালে তাকে তিন বছর বন্দি করে রাখে। এর পর তাকে মারজ আল-জুহুর নামের ইসরায়েল এবং লেবাননের মধ্যকার একটি নোম্যানস ল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়। সেখানে তিনি ১৯৯২ সালে বেশ কয়েকজন হামাস নেতার সঙ্গে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পুরো একটি বছর কাটিয়েছিলেন। নির্বাসনে থাকার পর তিনি গাজায় ফিরে আসেন এবং ১৯৯৭ সালে হামাস আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের অফিসের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, যা তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে। ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হামাস তাকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করে এবং একই মাসের ২০ তারিখ তাকে নিযুক্ত করা হয়। এক বছর পর ফিলিস্তিনের জাতীয় কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হানিয়েকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করেন। কারণ ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আব্বাসের ফাতাহ আন্দোলনের প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করে। সেই সহিংসতায় অনেকে মারা যান। ২০১৭ সালের ৬ মে থেকে তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
গাজায় গণহত্যা
গাজায় গত বছরের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া গণহত্যায় এখন পর্যন্ত ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। এই গণহত্যা ইতোমধ্যে এক বছর পূর্ণ করেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, গাজায় প্রায় ১ লাখ মানুষ আহত হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছেন। ২০১৬ সালে সেখানে প্রেসিডেন্ট হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ফিলিস্তিনের আন্দোলন পুরোপুরি দমিয়ে দিতে এক নতুন ধরনের দ্বিরাষ্ট্র সমাধান সামনে আনেন। সেখানে ফিলিস্তিনের নাম হবে ‘নিউ প্যালেস্টাইন’। তবে এই নতুন রাষ্ট্রের আত্মনিয়ন্ত্রণ, সামরিক বা সার্বভৌম কোনো অধিকার থাকবে না। এসব বিষয় তদারকি করবে ইসরায়েল। এই কথিত সমাধানের পাশাপাশি আরব দেশগুলোকে এতে সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এতে বেশ কয়েকটি দেশ পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসে। ফিলিস্তিনি শোক চাপা পড়তে থাকে। সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। সেদিন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ইসরায়েলে এক অভিযান চালায়। এতে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, ১১৩৯ জন নিহত ও প্রায় ২৫০ জন বন্দি হন হামাসের হাতে। এর পর থেকে গণহত্যা চালানো শুরু করে ইসরায়েল। গত এক বছরে গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশই বাস্তুচ্যুত। জাতিসংঘের ভাষ্যমতে, তাদের বেশির ভাগই একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি পরিবার ভূমধ্যসাগরের উপকূলে বিস্তৃত তাঁবু শিবিরে ভিড় করেন বিদ্যুৎ, পানি কিংবা শৌচাগারের সন্ধানে। ক্ষুধা ও রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ জানায়, সবকিছু আবার মেরামত করতে প্রায় ১৫ বছর সময় লাগতে পারে; এতে খরচ হতে পারে প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ৭৫ হাজার টন বোমা ফেলেছে। এই বোমাগুলো বৃহত্তম ও ধ্বংসাত্মক এবং ৪০ ফুটের বেশি ব্যাসের গর্ত তৈরি করেছে। ইসরায়েলি আক্রমণ গোটা গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদ ও গির্জা মুছে ফেলেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজমি ধ্বংস করেছে।
গাজায় চালানো হামলার সংক্ষিপ্ত চিত্র
-২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বিশ্ববাসী। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনে হামাস ইসরায়েলে এক ঝটিকা সামরিক অভিযান চালায়। এতে এক হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং প্রায় ২৫০ জনকে বন্দি করে হামাস।
-গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পরদিন ৮ অক্টোবর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। ১৯ নভেম্বর হুতিরা প্রথম আক্রমণ শুরু করে।
-ইসরায়েলের কাঠামোগত গণহত্যায় ৪২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে; যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। প্রায় এক লাখ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে।
-প্রায় ২৩ লাখ মানুষের আবাসস্থল গাজার আয়তন মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। গাজার ৬০ শতাংশের বেশি কৃষিজমি বোমা ফেলে নষ্ট করা হয়েছে। এ ছোট্ট ভূখণ্ডে আনুমানিক ৭৫ হাজার টন বোমা ফেলা হয়েছে।
-হামলায় গাজার ৬১১টি মসজিদ সম্পূর্ণ এবং ২১৪টি মসজিদ আংশিক ধ্বংস হয়েছে। গাজার তিনটি চার্চই ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়েছে। ১১৪টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
-চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল সরাসরি লেবাননে আক্রমণ করে। ২৭ সেপ্টেম্বর হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করা হয়। লেবাননে এখন পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।