ঢাকা ০১:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উৎসবমুখর পরিবেশে কুমারী পূজা উদযাপন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৩১:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪
  • ৩ বার

ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমী তিথিতে কুমারীরূপে দেবী দুর্গার আরাধনা করলেন বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। শুক্রবার কুমারী পূজাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মঠ ভক্ত ও অনুসারীদের আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে। তৈরি হয় হাজারো ভক্তের দীর্ঘ লাইন। এ সময় ভক্তরা উলুধ্বনি দেন এবং কুমারী দেবী ও দুর্গা দেবীর জয়ধ্বনি করেন। ঢাক, ঢোল, ঘণ্টা, শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো প্রাঙ্গণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিরাপত্তা জোরদার করেছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয় কুমারী পূজা। শেষ হয় বেলা ১২টায়। অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বাতাসÑএই পাঁচ উপকরণে দেওয়া হয় কুমারী মায়ের পূজা। অর্ঘ্য দেওয়ার পর দেবীর গলায় পরানো হয় পুষ্পমাল্য। দেবী মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর করা হয় প্রসাদ বিতরণ।

পূজা শুরুর আগে পর্দায় ঢাকা মণ্ডপে অধিষ্ঠিত করা হয় ‘কুমারী মাকে’। পরে খুলে দেওয়া হয় পর্দা। তখন হাজারো ভক্ত জয়ধ্বনি দিয়ে তাকে বরণ করে নেন। লাল শাড়ি পরে আসা কুমারী মায়ের দুই হাতে ছিল দুটি পদ্মফুল। এছাড়াও গয়না, পায়ে আলতা, ফুলের মালা এবং অলংকারে সাজানো হয় দেবীরূপে। পূজার সময় পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের ফাঁকে ফাঁকে বাজানো হয় ঢাক-ঢোলের বাদ্য, কাঁসর-ঘণ্টা ও শঙ্খ।

পূজার কার্যক্রম শেষে কুমারী মায়ের নাম জানান রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাÍানন্দ মহারাজ। তিনি বলেন, এ বছর কুমারী মা হয়েছেন সংহিতা ভট্টাচার্য। তার বয়স ৮ বছর, জš§ ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। শাস্ত্রমতে এদিন তার নামকরণ করা হয় কুবজিকা। সংহিতার বাবার নাম সঞ্জয় ভট্টাচার্য, মা অর্পিতা ভট্টাচার্য। কক্সবাজারের রামুর একটি স্কুলের কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থী সংহিতা। ঢাকার রামপুরার বনশ্রী এলাকায় তাদের বাসা। কুমারী দেবী সংহিতা ভট্টাচার্য বলেন, আমি সবাইকে আশীর্বাদ করেছি। সবার কল্যাণ হোক।

স্বামী পূর্ণানন্দ মহারাজ বলেন, কুমারী পূজা মাতৃভাবে ঈশ্বরেরই আরাধনা। কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা করে তাতে জগজ্জননীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন। দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছরের এক কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। যেকোনো জাতের মেয়েকেই কুমারী রূপে পূজা করা যেতে পারে। তবে স্বত্বগুণসম্পন্না, শান্ত, পবিত্র, সত্যশীল এসব দৈবী সম্পদের অধিকারিণী কুমারীই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণের বিধি রয়েছে।

কুমারীকে সমগ্র মাতৃজাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি উলে­খ করে তিনি আরও বলেন, আমরা খুব স্বচ্ছন্দ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কুমারী পূজা করেছি। আমরা কোনো নিরাপত্তার অভাব অনুভব করিনি। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি।

১৯০১ সালে ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতার বেলুড় মঠে কুমারী পূজার ঐতিহ্য সূচনা করেছিলেন। সেবার দুর্গাপূজার সময় স্বামী ৯ জন কুমারীকে পূজা করেছিলেন। তখন থেকে প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে। পূজার আগ পর্যন্ত কুমারীর পরিচয় গোপন রাখা হয়। এ ছাড়া নির্বাচিত কুমারীপরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন আচার-অনুষ্ঠান করতে পারেন। শাস্ত্র অনুসারে, সাধারণত ১ থেকে ১৬ বছরের সুলক্ষণা কুমারীকে পূজা করা হয়। তবে যতটা কম বয়সিকে করা যায়, সেটাই ভালো।

হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা কুমারী কন্যাকে মাতৃভাবে জীবন্ত প্রতিমা কল্পনা করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে কুমারী পূজা করেন। ভক্তদের মতে, এ পূজা একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানববন্দনা আর নারীর মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। নারীর সম্মান, মানুষের সম্মান আর ঈশ্বর আরাধনাই কুমারী পূজার অন্তর্নিহিত শিক্ষা।

হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহালয়ার দিন ‘কন্যারূপে’ ধরায় আসেন দশভুজা দেবী দুর্গা, বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। তার এই ‘আগমন ও প্রস্থানের’ মধ্যে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব। এবার দেবী দুর্গার আগমন হয়েছে দোলায় বা পালকিতে এবং গমন ঘোটক বা ঘোড়ায়।

এদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কুমারী পূজার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজধানীর গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে কঠোর অবস্থানে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা সব ধরনের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এড়াতে তৈরি করেছিলেন কয়েক স্তরে নিরাপত্তা বেষ্টনী।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

উৎসবমুখর পরিবেশে কুমারী পূজা উদযাপন

আপডেট টাইম : ১০:৩১:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪

ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমী তিথিতে কুমারীরূপে দেবী দুর্গার আরাধনা করলেন বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। শুক্রবার কুমারী পূজাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মঠ ভক্ত ও অনুসারীদের আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে। তৈরি হয় হাজারো ভক্তের দীর্ঘ লাইন। এ সময় ভক্তরা উলুধ্বনি দেন এবং কুমারী দেবী ও দুর্গা দেবীর জয়ধ্বনি করেন। ঢাক, ঢোল, ঘণ্টা, শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো প্রাঙ্গণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিরাপত্তা জোরদার করেছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয় কুমারী পূজা। শেষ হয় বেলা ১২টায়। অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বাতাসÑএই পাঁচ উপকরণে দেওয়া হয় কুমারী মায়ের পূজা। অর্ঘ্য দেওয়ার পর দেবীর গলায় পরানো হয় পুষ্পমাল্য। দেবী মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর করা হয় প্রসাদ বিতরণ।

পূজা শুরুর আগে পর্দায় ঢাকা মণ্ডপে অধিষ্ঠিত করা হয় ‘কুমারী মাকে’। পরে খুলে দেওয়া হয় পর্দা। তখন হাজারো ভক্ত জয়ধ্বনি দিয়ে তাকে বরণ করে নেন। লাল শাড়ি পরে আসা কুমারী মায়ের দুই হাতে ছিল দুটি পদ্মফুল। এছাড়াও গয়না, পায়ে আলতা, ফুলের মালা এবং অলংকারে সাজানো হয় দেবীরূপে। পূজার সময় পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের ফাঁকে ফাঁকে বাজানো হয় ঢাক-ঢোলের বাদ্য, কাঁসর-ঘণ্টা ও শঙ্খ।

পূজার কার্যক্রম শেষে কুমারী মায়ের নাম জানান রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাÍানন্দ মহারাজ। তিনি বলেন, এ বছর কুমারী মা হয়েছেন সংহিতা ভট্টাচার্য। তার বয়স ৮ বছর, জš§ ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। শাস্ত্রমতে এদিন তার নামকরণ করা হয় কুবজিকা। সংহিতার বাবার নাম সঞ্জয় ভট্টাচার্য, মা অর্পিতা ভট্টাচার্য। কক্সবাজারের রামুর একটি স্কুলের কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থী সংহিতা। ঢাকার রামপুরার বনশ্রী এলাকায় তাদের বাসা। কুমারী দেবী সংহিতা ভট্টাচার্য বলেন, আমি সবাইকে আশীর্বাদ করেছি। সবার কল্যাণ হোক।

স্বামী পূর্ণানন্দ মহারাজ বলেন, কুমারী পূজা মাতৃভাবে ঈশ্বরেরই আরাধনা। কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা করে তাতে জগজ্জননীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন। দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছরের এক কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। যেকোনো জাতের মেয়েকেই কুমারী রূপে পূজা করা যেতে পারে। তবে স্বত্বগুণসম্পন্না, শান্ত, পবিত্র, সত্যশীল এসব দৈবী সম্পদের অধিকারিণী কুমারীই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণের বিধি রয়েছে।

কুমারীকে সমগ্র মাতৃজাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি উলে­খ করে তিনি আরও বলেন, আমরা খুব স্বচ্ছন্দ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কুমারী পূজা করেছি। আমরা কোনো নিরাপত্তার অভাব অনুভব করিনি। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি।

১৯০১ সালে ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতার বেলুড় মঠে কুমারী পূজার ঐতিহ্য সূচনা করেছিলেন। সেবার দুর্গাপূজার সময় স্বামী ৯ জন কুমারীকে পূজা করেছিলেন। তখন থেকে প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে। পূজার আগ পর্যন্ত কুমারীর পরিচয় গোপন রাখা হয়। এ ছাড়া নির্বাচিত কুমারীপরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন আচার-অনুষ্ঠান করতে পারেন। শাস্ত্র অনুসারে, সাধারণত ১ থেকে ১৬ বছরের সুলক্ষণা কুমারীকে পূজা করা হয়। তবে যতটা কম বয়সিকে করা যায়, সেটাই ভালো।

হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা কুমারী কন্যাকে মাতৃভাবে জীবন্ত প্রতিমা কল্পনা করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে কুমারী পূজা করেন। ভক্তদের মতে, এ পূজা একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানববন্দনা আর নারীর মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। নারীর সম্মান, মানুষের সম্মান আর ঈশ্বর আরাধনাই কুমারী পূজার অন্তর্নিহিত শিক্ষা।

হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহালয়ার দিন ‘কন্যারূপে’ ধরায় আসেন দশভুজা দেবী দুর্গা, বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। তার এই ‘আগমন ও প্রস্থানের’ মধ্যে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব। এবার দেবী দুর্গার আগমন হয়েছে দোলায় বা পালকিতে এবং গমন ঘোটক বা ঘোড়ায়।

এদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কুমারী পূজার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজধানীর গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে কঠোর অবস্থানে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা সব ধরনের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এড়াতে তৈরি করেছিলেন কয়েক স্তরে নিরাপত্তা বেষ্টনী।