একটা টং দোকানে চা খেতে মজাই লাগে। নানা কিসিমের লোকজন এখানে আসে। নানা রঙের লোক এখানে দেখি। এলাকার সব লোকেরাই টং দোকানে হালকা নাস্তা, চা-বিস্কুট খেয়ে যাচ্ছে। বুড়ো দোকানদার। মুখে পাকা দাড়ি মাথায় গামছা জাতীয় একটা পাগড়ির মত পেঁচানো। গায়ে শুধু গেঞ্জি। কাস্টমারদের খোঁজ-খবর হচ্ছে। কার কি অসুখ-বিসুখ। সুবিধা-অসুবিধা সবই তার নখদর্পনে। আমি একজন অতি অপরিচিত তা তিনি চোখমুখ দেখেই টের পেয়েছেন। এক কাপ চা খেয়ে ভালোই লাগলো। পাঁচ টাকা দিয়ে চলে আসব। আর তখনি খেয়াল হল ওখানে আরও কিছুক্ষণ থাকা যেতে পারে। এখানে একটা কদম গাছ আছে। বেশ বড় কদম গাছ। তিন চারজন কিশোর গাছে উঠার চেষ্টা করছে। বর্ষাকাল বলে কদম ফুলে গাছ ছেয়ে আছে। চেংড়া চটুল একজনকে কাছে ডাকতেই চলে এল। ‘কি নাম তোমার?’‘রিংকু।’‘এখানে বাসা কোথায়?’‘ঐ বালুর চরে।’ একটু দূরে আঙুল ইশারায় বলল। শহরতলীতে ঝিল ভরাট করে সত্যিই বালুর চরের মত দেখাচ্ছে। ওখানে নতুন ঘরবাড়ি, দোকানপাট, হালকা মুদি-দোকান সবই আস্তে আস্তে গড়ে উুঠছে। আসলেই বড় ফাঁকা জায়গা। ঢাকা শহরের মধ্যে এমন জায়গা হঠাৎ পাওয়া দুষ্কর। ধারে পাশে কোন বিদ্যালয় স্কুল নেই। সবাই দূরের স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে। এখান থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়া মানে অনেক দূরে রওয়ানা হওয়া। বড়জনের নাম হাসান, ও দ্রুত কদম গাছে উঠে গেল। কদম ফুলের প্রতি একটা আকর্ষণ আমার ভিতরে কাজ করে। সবাই অনেক ফুল নিল। আমাকে রিংকু নেমেই তিনটি ফুল দিয়ে গেল। আমি বললাম, ‘ফুল আমি চাইনি তো?’‘এমনিতেই দিলাম। আপনার মনে হয় ফুল দরকার।’‘আমার ফুল দরকার কি করে বুঝলে?’ও হেসে দিল। মুখের হাসিতেই অনেক কিছু প্রকাশ পায়। ও চলে গেল। আসলেই এই গাছে কত লোক উঠে নামে। কিন্তু কোন বয়স্ক লোক সেই ফুল পাড়ার দৃশ্যের জন্য গাছ তলায় এমন হা করে দাঁড়িয়ে থাকে না। আমি দাঁড়িয়েছি আবার ফুল পাড়ার জন্য বাহবা দিয়েছি। ওতেই ওরা বুঝে ফেলেছে-যে ফুলটা কিশোর-কিশোরীর দরকার সেটা আমারও দরকার। ফুল তিনটা হাতে আমার কিযে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে সেই কিশোর কালে ফিরে গেছি। কদম ফুলের রেণু মেখে কি যে মজা। সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম। প্রথম যেতাম ঝর্ণা আপা আর টুম্পার কাছে। দুজনকে ঘুরে ঘুরে ফুলের রেণু দেখাতাম। মনে মনে আনন্দ পেতাম। ঝর্ণা আপা ফুল পেলে খুব আনন্দ করত। ফুলের রেণু গায়ে এবং গালে মেখে সেই চিহ্ন দীর্ঘক্ষণ রেখে দিত। ঝর্ণা আপা এমনিতে ধবধবে ফর্সা। ফুলের রেণু গায়ে-গালে মাখলে অপসরা অপসরা লাগত। আমরা শুধু ঝর্ণা আপার সৌন্দর্য দেখার জন্যই দু’দিন বাদে বাদে কদম ফুল নিয়ে হাজির হতাম। আমরা ছোট বলে ঝর্ণা আপা আমাদের ফুল নিত। ফুল পেয়ে আমাকে গাঢ় চুম্বন খেত। আমি চুমু দেয়ার জন্য আরেকটা গাল বাড়িয়ে দিতাম। ঝর্ণা আপা তখন লাল হয়ে যেত-দুষ্টু কোথাকার! ভারী শয়তান তো।!কদম ফুল নিয়ে হাঁটছি। অতীতের মত রোমাঞ্চ হচ্ছে। কোন অংশেই কমতি নেই। কি যে ভালো লাগছে। তিনটি ফুল কাকে কাকে দিব স্থির করেছি। ভাবতে ভাবতেই শিল্পীদের ওখানেই হাজির। শিল্পীরা তিন বোন একটু দরিদ্র কিন্তু ওদের মনটা অনেক বড়। ছোট্ট তিনটি কদম ফুল পেয়ে পুরে পরিবার আনন্দে ভাসছে। সবাই সেই ফুল নিয়ে বেড়াচ্ছে। ছেলে-বুড়ো-শিশু সবাই। মহানবী (সা.) ফুল ভালোবাসতেন তাই আমরা ফুলের প্রতি এত অনুরাগী।শিল্পী ফুলের রেণু গালে মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর আম্মু ফুলটা ফুলদানিতে টেবিলে সাজিয়েছে। ভারী মজা। সামান্য ফুলে এত আনন্দ ভাবতেই পারিনি। একদিন এই ফুল নিয়ে একটা লঙ্কাকা-! ঘটনাটা ঝর্ণা আপাকে নিয়ে আমরা বিকাল বেলা সবাই খেলাধুলা করছি। ঝর্ণা আপাদের ওখানে প্রতি বিকালে একবার জড়ো হই। বড় মামানী ঝর্ণা আপাকে বকছেন। কি ঘটনা জানি না। ঝর্ণা আপা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে কাঁদছেন। কি এমন ঘটনা ঘটেছে? ঘর বন্ধ করে কাঁদতে হবে? আমরা ছোটরা ভালো মত বুঝতে পারছি না। ভয়ে ভয়ে শুধু জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছি। ঝর্ণা আপা বালিশের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছেন। শেফালি খালা বলল, শফিকুল ভাইয়া ঝর্ণা আপাকে কদম ফুল দিয়েছে। তাও আবার গোপনে ঘরের জানালা দিয়ে। ঝর্ণা আপা সেই ফুল নিতে চায়নি। তবু শফিকুল ভাই জোর করে সেই ফুল পড়ার টেবিলে ছুঁড়ে দিয়েছে। ব্যস এতটুকুই।ফুল দিয়েছে তাতে কী? কিন্তু ঝর্ণা আপার কান্না রহস্য আবিষ্কার করতে পারছি না। ফুল দেয়া-নেয়াতে কান্নার কি বিষয় আছে? শুধু কান্নার দৃশ্যের কথাটুকু মনে আছে। রণরঙিনী রুদ্রমূর্তি মামানির হাতে ঝাঁটা। ঝাঁটা নেড়ে নেড়ে চিৎকার করে বলছে- শফিকুল কুত্তা। ‘………’ এর বাচ্চা। এদিক আলি ঝাঁটাপিটা করমু! যে ফুল ঝর্ণা আপার মুখে গালে আমি অহরহই মেখে দিই। সেখানে শফিক ভাইয়া দিলে কি অপরাধ? একটু বড় হওয়ার পর বিষয়টা পরিষ্কার হয়। কিন্তু ফুলের স্মৃতিটা অনেক সুখের অনেক মধুর। ঝর্ণা আপার মতই মিষ্টি সে স্মৃতি। মনে হচ্ছে এই মাত্র আমার গালে আদরে ঝর্ণা আপা কদম ফুলের রেণু মেখে দিলেন।
সংবাদ শিরোনাম