ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল বুধবার প্রকাশিত হয়েছে। দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এবারের স্লোগান ছিল ‘অব্কি বার ৪০০ পার’; কিন্তু সেই স্লোগান বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। বরং এবার তিনশ’রও গণ্ডি পেরোতে পারেনি বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ। উলটো আগের লোকসভা নির্বাচনের থেকে এবার অনেকাংশে ভালো ফল করেছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ‘ইন্ডিয়া’। ফলাফল প্রকাশ্যে আসার পর দেশটির বড় দুই দলই সরকার গঠন নিয়ে জোর তৎপর হয়েছে। পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে দুই জোটেই চলছে আলোচনা, হচ্ছে ম্যারাথন বৈঠক।
নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডু কি বিরোধী দলের সঙ্গে হাত মেলাবেন? এমন নানা আলোচনা চলছে ভারতের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর। এ প্রেক্ষাপটে ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
ভারতের এবারের নির্বাচনে কয়েকটি বিষয় আমার দৃষ্টি কেড়েছে। একটি হলো মোদির ‘ম্যাজিক’ সেভাবে কাজ করেনি। এখানে একটা বিষয় বলা যেতেই পারে, বিজেপির হিন্দুত্ববাদ নীতি বা হিন্দুত্ব মতবাদ, সেটার গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে যে একটা সীমা বা লিমিট আছে, এটা আমার মনে হয় এবার পরিষ্কার হয়েছে। মানে এটি একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু বড় আকারে, বিশেষ করে যদি বিরোধী দলগুলো ঠিকমতো জোট তৈরি করতে পারে, তাহলে দেখা যাচ্ছে জনগণও বলে দেয়, ধর্ম নিয়ে যে রাজনীতি, ভারতেও সেটার একটা সীমা বা লিমিট আছে। এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে, যেহেতু আমরা দেখছি অযোধ্যায় যে জায়গায় মন্দির নিয়ে এত হইচই হলো, সেখানেই দেখা গেল বিজেপি হেরে গেল। অযোধ্যার নির্বাচনটা বিশেষভাবে উলেখযোগ্য এ কারণে যে, যারা জিতেছে, তারা মূলত একটা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের দল-সমাজবাদী পার্টি।
আর দ্বিতীয় যে বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটা হলো, ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে-এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, সেখানে একটা বড় বিভাজনও তৈরি হয়েছে। বড়লোকেরা যতখানি লাভবান হয়েছে, অনেকেই বলেন এক শতাংশ যারা ধনী, তারাই লাভবান হয়েছেন; কিন্তু জনগণের বড় অংশের তেমন উপকার হয়নি। অর্থাৎ উন্নয়নের মধ্যেই একটা বিভাজন তৈরি হয়েছে। তবে উন্নয়ন হয়েছে, এটাও ঠিক। নরেন্দ্র মোদি এটাও ভেবেছিলেন যে, উন্নয়নকে সামনে নিয়েই তিনি বড় আকারে জয় তথা ৪০০ সিট পেয়ে যাবেন; কিন্তু সেটা তো হলোই না, নিজের দলটিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হলো। এখন সরকার গঠন করতে হলে তাকে জোট বা অ্যালায়েন্সে যেতে হবে। এতে বোঝা যাচ্ছে, যে বিভাজনটা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে বেকারত্ব বেড়েছে, যারা ধনী হয়েছে তারাও সেটিকে যেভাবে প্রকাশ করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে; সেটি জনগণ পছন্দ করেনি। সেটিরও একটা বার্তা এ নির্বাচনের মাধ্যমে পাওয়া গেছে। এ দুটি কারণ আমার মনে হয় মৌলিক।
এখন প্রশ্ন হলো, বিরোধী দলগুলো যদি জোটের পরিধি আরও বাড়াতে পারত, তাহলে কী হতো? এখানে মনে রাখতে হবে, চন্দ্রবাবু নাইডু, যিনি তেলেগু দেশম পার্টির নেতা, সেই দলটি গতবার কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গেই ছিল, এবার থাকেনি। অন্য কথায়, বিরোধী দলের জোট বড় আকারের হলে কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে, বিজেপি আরও ঝামেলায় পড়তো। এখন দেখা দরকার এই জোট বা অ্যালায়েন্স কতদূর যায়। কারণ বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশে যে দল দুটি আছে, তারা কী পোর্টফোলিও পাবে, তা দেখতে হবে। তারা কেমন দরকষাকষি করবে, তাও দেখতে হবে। কারণ গত দুই নির্বাচনে যা হয়নি, এবার দেখা যাচ্ছে নির্ভর করতে হচ্ছে এ দুটি দলের ওপর। কাজেই সে জায়গায় আমি মনে করি, উগ্রবাদী বা হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন হয়তো আসবে। অবশ্য এখন পরিবর্তন আসবে কিনা, সেটা দেখতে হবে।
তবে কোনো সন্দেহ নেই, ভারতের জনগণ বড় আকারেই রাজনীতির যে সীমা বা লিমিট আছে, তা প্রকাশ করেছে। এবং উন্নয়নটাই যে বড় কথা অর্থাৎ উন্নয়নের সুফল যদি সবার মধ্যে না গিয়ে যদি শুধু এক শতাংশের মধ্যে যায়, সেক্ষেত্রে কী প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, তা আমার মনে হয় এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ দেখাতে চেষ্টা করেছে। এখন দেখার বিষয় এই জোট বা অ্যালায়েন্স ক্ষমতায় এসে নতুনত্ব কিছু দেখাতে পারে কিনা।