তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে আট বাংলাদেশির মৃত্যুর চাঞ্চল্যকর ঘটনায় মানব পাচার চক্রের দেশীয় ২২ সদস্যের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চক্রের অধিকাংশ সদস্যের বাড়ি গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলায়। ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে দেশি ও আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র। ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে নৌকাডুবিতে আট বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনার দুই মাস পর শুক্রবার বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়েছে।
সন্ধ্যায় বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসির আরাফাত খান যুগান্তরকে বলেন, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে সজল বৈরাগী মারা গেছেন। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহায়তায় সজলের বাবা সুনীল বৈরাগী মামলা করেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। মামলাটি এপিবিএন তদন্ত করবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, লিবিয়া থেকে নৌকায় সাগরপথে ইউরোপ যাত্রাকালে ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিসীয় উপকূলে নৌকাডুবিতে ৯ জন মারা যায়। তাদের আটজনই বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে পাঁচজন মাদারীপুরের ও তিনজন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ৫২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নিয়ে একটি নৌকা লিবিয়ার উপকূল থেকে ইউরোপের উদ্দেশে যাওয়ার পথে সেটিতে আগুন ধরে যায়। মৃতরা হলেন-মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ির নয়ন বিশ্বাস (১৮), উপজেলার খালিয়ার মামুন শেখ (২৪) ও সজল বৈরাগী (২৫), উপজেলার বাজিতপুর নতুনবাজারের কাজী সজীব (১৯) ও উপজেলার কেশরদিয়া কবিরাজপুরের কায়সার খলিফা (৩৫), গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাগদীর রিফাত শেখ (২৫), উপজেলার দিগনগরের রাসেল শেখ (১৯) এবং গঙ্গারামপুর গোহালার ইমরুল কায়েস ওরফে আপন (২৪)।
এ ঘটনার পর থেকে ছায়াতদন্ত শুরু করে এপিবিএন। নিহতের স্বজনদের মাধ্যমে সংস্থাটি জানতে পারে-গত বছরের ৯ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে আট বাংলাদেশিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। মানব পাচার চক্র প্রত্যেকের কাছ থেকে গড়ে ১৪ লাখ করে টাকা নিয়েছে। তবে সমুদ্রপথে ইতালি পাঠানোর বিষয়টি জানতেন না ভুক্তভোগীর স্বজনরা। দুই মাস ধরে অনুসন্ধানে এপিবিএন এখন পর্যন্ত মানব পাচার চক্রে ২২ জন জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। তবে এ চক্রে শতাধিক সদস্য সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে বলে প্রাথমিক ধারণা তদন্তসংশ্লিষ্টদের। নাম প্রকাশ না করে এপিবিএন’র এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তিউনিসিয়ায় আট বাংলাদেশি নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মানব পাচার চক্রের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা আমরা পেয়েছি। তাদের মধ্যে চারজন গোপালগঞ্জের এবং তিনজন মাদারীপুরের বাসিন্দা। তদন্তের স্বার্থে আসামিদের নাম বলা যাচ্ছে না। অবিলম্বে আসামিদের গ্রেফতার করা হবে।
ডিএমপির বিমানবন্দর থানায় করা মামলা সূত্রে জানা গেছে. সজল বৈরাগী বৈধ পথে ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। বিবাদী গোপালগঞ্জের যুবরাজ কাজী প্রস্তাব দেয় তার বাবা মোশারফ কাজী বৈধপথে ইতালি পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। বিনিময়ে তাকে ১৪ লাখ টাকা দিতে হবে। এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গত বছরের ১৭ নভেম্বর প্রথম কিস্তিতে আড়াই লাখ টাকা ও পাসপোর্ট দেয় যুবরাজ কাজীকে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ইতালি যাওয়ার কথা বলে সজল বৈরাগীকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যায় যুবরাজ। বিমানবন্দরের মেইন গেটে ঢোকার আগেই গাড়ি থেকে সজলের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেয় এবং বিমানবন্দরে সারারাত অবস্থান করে। পরদিন ভোর ৬টায় বিমানে ইতালির উদ্দেশে দুবাই রওয়ানা করে। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি যুবরাজ কাজীর গোপালগঞ্জের বাসায় গিয়ে সুনীল বৈরাগী নগদ আরও সাড়ে ছয় লাখ টাকা দেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও দীর্ঘদিন ছেলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি সুনীল বৈরাগী। এরপর তিনি ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পান।
সুনীল বৈরাগীর ছোট ছেলে সজীব বৈরাগী মোবাইল ফোনে জানান, ‘তার বাবা মামলা করতে ঢাকায় গেছেন। বাসায় ফেরেননি।’ তিনি আরও বলেন, তার ভাই সজলের মৃত্যুর পর থেকে মানব পাচার চক্রটি আত্মগোপনে চলে গেছে।