কেন্দ্রের হুঁশিয়ারিও গায়ে মাখছেন না এমপিরা

আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্যদের (এমপি) খবরদারি কোনোভাবেই কমছে না। নির্বাচনে কোনো রকম প্রভাব বিস্তার না করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাও অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে। কেন্দ্রের মনোভাব পরিষ্কার করতে দু-এক দিনের মধ্যে আবারও এমপিদের কাছে দলীয় প্রধানের বার্তা পাঠানো হবে।

কেন্দ্রের হুঁশিয়ারি গায়ে না মেখেই নির্বাচনে সরাসরি বা গোপনে প্রার্থী দিচ্ছেন এমপিরা।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমপিরা প্রার্থী না দিলেও প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করছেন। আবার কারো কারো বিরুদ্ধে রয়েছে স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ।

অন্যদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমপিদের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে হেরে যাওয়া প্রার্থীরা উপজেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে চাইছেন।

এমপি নির্বাচনে হেরে উপজেলায় ভোটে দাঁড়িয়েছেন। আবার স্বতন্ত্র এমপিরা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মজবুত করতে উপজেলায় নিজ প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম ধাপের ভোটে ১৫০টি উপজেলার মধ্যে ১৪১টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের অন্তত ৪৬৬ জন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। গড় হিসাবে প্রতি উপজেলায় তিনজনের বেশি আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন

এদিকে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের অন্যতম লক্ষ্য উপজেলা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে না দেওয়া। এ জন্য দলের পক্ষ থেকে মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করতে বার্তা দেওয়া হচ্ছে।

গত মঙ্গলবারও দলের সভাপতি শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার না করতে। নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে হয়, কেউ কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না। প্রশাসন কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলের নির্দেশ উপেক্ষা করাকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রয়োজনে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে চায় সরকার

এদিকে শেষ মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবে বয়কট করেছে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী বিএনপি। আর নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েও ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে প্রকাশ্যে দলীয় সমর্থন না পেলেও এই দুই দলের অনেক নেতা ভোটে অংশ নিচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এতে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিরপেক্ষ ও অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায় সরকার। কেননা নির্বাচনে যে প্রার্থীই বিজয়ী হোক, তাতে আওয়ামী লীগের ক্ষতি নেই। উল্টো নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু করা গেলে সরকারের ভাবমূর্তি ভালো হবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের লক্ষ্য নির্বাচন নিরপেক্ষ করা। যাঁরা জনপ্রিয় তাঁরা ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসবেন। এ কারণেই দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়নি। ভোটের মাঠ উন্মুক্ত থাকবে।’

আওয়ামী লীগের মুখোমুখি আওয়ামী লীগ

উপজেলা নির্বাচনেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনেও ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। উপজেলা নির্বাচনে ভোটার বাড়াতে ‘স্বতন্ত্র কৌশলে’ ক্ষমতাসীন দলের মৌন সমর্থন রয়েছে। আবার প্রার্থী বেশি থাকলে কেন্দ্রে ভোটার টানার পাশাপাশি নির্বাচনী আমেজ তৈরি হবে।

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে দেশের ১৫০টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে এই প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা নিয়েছে কমিশন। এই ধাপে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী আসন—এই তিন পদে এক হাজার ৮৯১ জন প্রার্থী হতে আবেদন করেছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬৯৬ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭২৪ জন এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৭১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

গতকাল বুধবার মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে আগামী শনিবার পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। আপিল নিষ্পত্তি হবে আগামী রবিবার।

প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন আগামী সোমবার। পরদিন মঙ্গলবার প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হবে প্রচার।

স্বতন্ত্র এমপিদের কেন্দ্রের নীতি মেনে চলার বার্তা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র সদস্য। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও স্বতন্ত্র ভোট করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ৬২ জন। এই ৬২ জনের মধ্যে ৬০ জন স্বতন্ত্র এমপিই আওয়ামী লীগ নেতা। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে তাঁদেরও দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব এবং নেতাকর্মীদের সমর্থন রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, দল থেকে স্থানীয় এমপিদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দলের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে সবাইকে ভোট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এমনকি এখানে স্বতন্ত্র এমপি বলে কিছু নেই। যাঁরা দল থেকে স্বতন্ত্র এমপি হয়েছেন তাঁদেরও দলের নীতি মেনে চলতে হবে।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকবে না, এর মানে এই নয় যে যার যা ইচ্ছা তা-ই করবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ। এমপিদের সঙ্গে এখন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বসা না-ও হতে পারে। তবে বার্তা তো পাঠানো যাবে।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর