ইরান ও ইসরায়েল সংঘাতের পরিণতি এখন কোন দিকে যেতে পারে তা নিয়ে শুরু হয়েছে বেশ জল্পনাকল্পনা।
নিরাপত্তা সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনারের মতে, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের পরিণতি কী হতে পারে, তা এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ইসরায়েল ঠিক কীভাবে শনিবার (১৩ এপ্রিল) রাতে চালানো হামলার জবাব দেয়, তার ওপর।
তিনি আরও জানান, মধ্যপ্রাচ্যে ও বিশ্বের অন্যত্রও বহু দেশই এই পরিস্থিতিতে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছে। এর মধ্যে এমন অনেক দেশও আছে, যারা ইরানের সরকারকে ঘোরতর অপছন্দ করে। কিন্তু এখন তারাও চাইছে ইসরায়েল যেন নতুন করে এই হামলার জবাব না দেয়।
অন্যদিকে ইরানের মনোভাবও অনেকটা এই ধরনের : অ্যাকাউন্ট সেটলড মানে শোধবোধ হয়ে গেছে। বিষয়টার এখানেই ইতি টানলেই ভালো। তবে হ্যাঁ, যদি আবার আমাদের বিরুদ্ধে পালটা আঘাত হানতে যাও সে ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু অনেক বেশি শক্তিশালী হামলা চালাব যেটা প্রতিহত করা তোমাদের সাধ্যে কুলোবে না—ইরানের এমন মানসিকতার ব্যাখ্যা করেছেন ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার।
যদিও ইসরায়েলের হামলার পরিণতিতে ইরানের কর্তৃপক্ষ তো বটেই, দেশের সাধারণ মানুষও বেশ খুশি। তেহরানের রাস্তায় নেমে তারা উল্লাস প্রকাশও করেছেন। তবে ইসরায়েল যদি নতুন করে আর হামলা না-চালায়, তাহলে ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাওয়া ভালো এমন একটা মানসিকতাও তেহরানের কাজ করছে।
কিন্তু ইসরায়েল ইতিমধ্যেই ‘রীতিমতো কড়া জবাব’ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, তাকে অনেকেই সে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘কট্টরপন্থি’ বা হার্ডলাইন সরকার বলে বর্ণনা করে থাকেন।
গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের চালানো অতর্কিত হামলার জবাব দিতে ইসরায়েল সময় নিয়েছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তারপর ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে তারা একটানা গাজা ভূখণ্ডে তীব্র অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে গাজাকে যেন তারা প্রায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইছে।
ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনারের মতে, ইসরায়েলের ‘ওয়ার ক্যাবিনেট’ বা যুদ্ধ-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা ইরানের এই প্রত্যক্ষ হামলার কোনো জবাব না-দিয়ে হাত গুটিয়ে থাকবে, এই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তাহলে ইসরায়েলের সামনে এখন কী কী রাস্তা বা ‘অপশন’ খোলা আছে?
প্রথমত, হতে পারে তারা ঐ অঞ্চলে তাদের প্রতিবেশীদের কথায় আমল দেবে এবং একটা ‘কৌশলগত ধৈর্য প্রদর্শনে’র রাস্তায় হাঁটবে। এর অর্থ হলো—তারা সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে কোনো পালটা হামলা না চালিয়ে ঐ অঞ্চলে ইরানের যেসব শরিকরা আছে তাদের ওপর অভিযান চালাবে। এর মধ্যে আছে লেবাননের হিজবোল্লাহ্র মতো গোষ্ঠী কিংবা সিরিয়ায় ইরানের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ কেন্দ্রগুলো যার বিরুদ্ধে ইসরায়েল বহু বছর ধরেই হামলা চালিয়ে আসছে।
দ্বিতীয়ত, ইরান যে ধরনের হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পালটা ঠিক সেই ধরনের ‘সাবধানে ও মেপে মেপে’ হামলা চালাতে পারে যার নির্দিষ্ট লক্ষ্য হবে ইরানের সেই মিসাইল ঘাঁটিগুলো, যেখান থেকে সেদিন রাতে হামলা চালানো হয়েছিল।
তবে ইসরায়েল যদি এই অপশনটা বেছে নেয়, তাহলে ইরান সেটাকেও যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবেই দেখবে। কারণ বহু বছরের বৈরিতা সত্ত্বেও ইসরায়েল ইতিপূর্বে কখনোই সরাসরি ইরানের ভূখণ্ডে কোনো হামলা চালায়নি। বরং তারা ঐ অঞ্চলে ইরানের সঙ্গী বা প্রক্সি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে আক্রমণেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে।
তৃতীয় পথ হতে পারে, ইসরায়েল যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টায় আরো এক ধাপ এগিয়ে ইরান যেভাবে হামলা চালিয়েছে তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী পালটা হামলা চালাল। সেক্ষেত্রে তারা শুধু নির্দিষ্ট মিসাইল ঘাঁটিই নয়, ইরানের অত্যন্ত শক্তিশালী রিভোলিউশনারি গার্ডের ঘাঁটি, প্রশিক্ষণ শিবির ও কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল সেন্টারগুলোকেও আক্রমণের নিশানা করবে। ইসরায়েল যদি এই শেষ দুটো অপশনের কোনো একটা বেছে নেয়, তাহলে ইরানকেও অবশ্যই আবারও পালটা আঘাত হানার পথে যেতে হবে।
আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই সংঘাতে কি আমেরিকাও জড়িয়ে পড়তে পারে? পরিস্থিতি কি এমন দাঁড়াতে পারে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন মার্কিন বাহিনী আর ইরানের মধ্যেও পুরোদস্তুর গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়? কেননা, উপসাগরীয় আরব অঞ্চলের ছয়টি দেশেই কিন্তু মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আছে।
এছাড়াও তাদের সামরিক ঘাঁটি আছে সিরিয়া, ইরাক ও জর্ডানেও। বহু বছরের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান যে ব্যালিস্টিক ও অন্য নানা ধরনের মিসাইলের বিপুল ভান্ডার তৈরি করেছে, মার্কিন এই সামরিক ঘাঁটিগুলো সেই সব ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানায় পরিণত হতে পারে।
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই আর একটা হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে তারা যদি আক্রান্ত হয় তাহলে তারা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রপথটি যদি ইরান মাইন, ড্রোন ও ফাস্ট অ্যাটাক ক্র্যাফট দিয়ে বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম ব্যস্ত রুটটি অচল হয়ে পড়বে এবং বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের এক-চতুর্থাংশ বন্ধ হয়ে যাবে। অবধারিতভাবে সেটা হবে একটা দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি।
ইরানের মানুষ কী ভাবছেন?
ইরানের রিভোলিউশনারি গার্ডস (আইআরজিসি) ইসরায়েলের ওপর ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালানোর পর ইরানে সরকারের সমর্থক বহু মানুষ তেহরানের রাজপথে নেমে এসে আনন্দোল্লাস করতে থাকেন। মধ্যপ্রাচ্যে যেসব দেশ ইরানের মিত্র বা শরিক হিসেবে পরিচিত, তাদের মধ্যে এবং ইরানের ভেতরেও সমর্থকদের মধ্যে আইআরজিসি-র গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য এই হামলা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইরানের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি জানান, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে যেসব নিশানাকে লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছিল তার মধ্যে সে দেশের নোটাম বিমান বাহিনী ঘাঁটিও (এয়ারফোর্স বেস) ছিল।
দুই সপ্তাহ আগে যে ইসরায়েলি এফ-৩৫ বিমানগুলোর চালানো হামলায় দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে সাত জন আইআরজিসি কমান্ডার নিহত হন, সেই যুদ্ধবিমানগুলো এই ঘাঁটি থেকেই উড়ে গিয়েছিল।
মেজর জেনারেল বাঘেরি এটাও জানিয়েছেন, ইরান তাদের ‘লক্ষ্য অর্জন করেছে’ এবং অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কোনো অভিপ্রায় তাদের নেই। তবে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছেন, নতুন করে কোনো হামলা চালানো হলে ইরান তার অনেক কঠোর প্রত্যুত্তর দেবে।
এছাড়া সে দেশের শীর্ষ সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের কথাবার্তা থেকে মনে হচ্ছে তারা হামলার পরিণামে ‘সন্তুষ্ট’। কিন্তু ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যায়, তা কোনো একটি পক্ষের ওপর নির্ভর করছে না তাই আপাতত সারা দুনিয়াকেই পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রাখতে হবে।