আওয়ামী লীগেও বিশ্বাসঘাতক আছে

নূহ-উল-আলম লেনিন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন এর। দীর্ঘ আলোচনায় গুরুত্ব পায় জঙ্গিবাদ। তুলে ধরেন রাজনীতির অন্যান্য বিষয়ও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে বিরোধী জোট। ঐক্যের কথা বলছেন আপনারাও। আসলে ঐক্য হলেই কি এই জঙ্গি সমস্যা সমাধান করা সম্ভব?

নূহ-উল-আলম লেনিন : জঙ্গিবাদ সমসাময়িক একটি প্রপঞ্চ। জাতীয় ঐক্য হয়ে গেলেই এই সমস্যার সমাধান হয়- এমন সরলীকরণে আমি বিশ্বাসী নই। বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্য হয়ে গেলেই মুক্তি, এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। আর বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হলেই যদি জঙ্গিবাদ নিপাত যায়, তাহলে বুঝতে হবে জঙ্গিবাদের সমস্যা বিএনপিতেই।

তাই যদি হয়, তাহলে বিএনপি প্রতিজ্ঞা করুক যে, আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে ঐক্য করলে বাংলাদেশে আর কোনোদিন জঙ্গিবাদী তৎপরতা হবে না। এই দায়িত্ব তারা নিক। তখন আমি অন্তত ঐক্য করতে মত দেব।

তাহলে রাজনীতিতে ঐক্যের কথা উঠছে কেন?

নূহ-উল-আলম লেনিন : দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে রাজনীতিতে ঐক্যের গুরুত্ব সবসময়ই থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে কার সঙ্গে কীভাবে ঐক্য করব। আমরা ঐক্য করব জনগণকে নিয়ে, তাদের মতের ভিত্তিতে।

এমন ঐক্যে দেশের মানুষ আদৌ সাড়া দেবে?

নূহ-উল-আলম লেনিন : ইতোমধ্যেই ঐক্যের আবহ দেখতে পাচ্ছি। আগামীকালই সব বন্ধ হয়ে যাবে, আমি এটি বিশ্বাস করি না। কিন্তু মানুষ তো সচেতনভাবেই মাঠে নেমেছে। ধর্মীয় সংগঠনগুলোও সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কথা বলছে।

এমন অবস্থান নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। কেউ বলছেন, সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কেউ মাঠে নামছে আবার কেউ চাপে মাঠে নামছে?

নূহ-উল-আলম লেনিন : একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী সমদূরত্বের মাপ নিয়ে সব কিছু মূল্যায়ন করতে চায়। এমন আলোচনা সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও হচ্ছে। এসবের মধ্য দিয়ে তারা কী চায়? তারা কি চায় দেশটা একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাক। তারা কি চায় বিভাজন আরো বাড়ুক।

যারা সন্ত্রাসের বিপক্ষে, ধর্মান্ধতার বিপক্ষে, যারা মানুষে মানুষে ঐক্য তাদের কেন মাঠে নামতে দেব না। তাদের কথা বলার অধিকার নেই। তার তো বৈধ সংগঠন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেটা নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাও নিতে পারে তদন্ত সাপেক্ষে। কিন্তু যারা এখনো দোষী প্রমাণিত হয়নি তাদের সহযোগিতা রাষ্ট্র, সমাজ কেন নেবে না। তারাও জনগণের অংশ।

প্রশ্ন উঠছে, সরকার কোনো ইস্যুতেই বিএনপির মতো সংগঠনকে মাঠে নামতে দিতে চায় না। অপরদিকে কট্টর ইসলামী সংগঠনকে নিয়ে জঙ্গিবিরোধী কর্মসূচি পালন করছে। আসলে এর মধ্য দিয়ে আদৌ কি সফলতা আসে?

নূহ-উল-আলম লেনিন : জঙ্গিবিরোধী অবস্থান নিলে তো পানি এত ঘোলা করত না। বিএনপি নেতারা জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার না চাইলে জনগণকে নিয়ে তারাই ঐক্য করবে। সমস্ত ঘটনার দায় প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হচ্ছে। এসব তো ঐক্যের কথা নয়। আমরা জনগণকে গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যের কথা বলছি। জনগণের শক্তির কাছে আর কোনো শক্তি গুরুত্ব পায় না। জনশক্তিতেই সফলতা আসে।

তার মানে বিএনপির ঐক্যের প্রস্তাব আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দিচ্ছে না?

নূহ-উল-আলম লেনিন : বিএনপির ঐক্যের প্রস্তাব মূলত প্রতারণা। অতীতের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে।

তাহলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে জামায়াত ছাড়ানোর শর্ত কেন?

নূহ-উল-আলম লেনিন : বিএনপি বড় একটি রাজনৈতিক দল। বিএনপি যুদ্ধাপরাধ দলও নয়। তারা একটি বৈধ দল। বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছে আওয়ামী লীগ।

কোনো বিষয়ে ঐক্য করতে হলে তো প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হয়। জামায়াতকে সঙ্গে রেখে বিএনপি ঐক্যের কোনো ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে না।

নির্বাচন কমিশনে জামায়াত অবৈধ। রাজনীতিতে নেই, মাঠে নেই। জামায়াতকে এত গুরুত্ব দেয়ার কী আছে?

নূহ-উল-আলম লেনিন : নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করলেও জামায়াত তো এখনো নিষিদ্ধ হয়নি। তারা রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশ করতে পারছে।

জামায়াত ছাড়ার শর্ত দিচ্ছেন বিএনপিকে। সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না কেন?

নূহ-উল-আলম লেনিন : জামায়াত আর জেএমবি এক নয়। জামায়াতের মুখ ও মুখোশ রয়েছে। মুখোশ হচ্ছে তাদের ভোট নির্বাচনের রাজনীতি। আর মুখ হচ্ছে মওদুদীবাদ।
আদালত জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আইনমন্ত্রী এ ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে নির্বাহী আদেশে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

আদালতের কাছে সঁপে দেয়া রাজনীতি কিনা?

নূহ-উল-আলম লেনিন : সরকার সঁপে দেয়নি। আদালত নিজে থেকেই রায় দিয়েছে। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল। যে কোনো বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পাবেই।
তবে এখানে নিছক রাজনীতির বিচারে এটি মূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। এখানে আদালতের সিদ্ধান্তও গুরুত্ব দিতে হবে।

বিএনপি যদি জামায়াত ছাড়ে তাহলে…

নূহ-উল-আলম লেনিন : বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার। যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে বিএনপির কোনো মন্তব্য নেই। মৌলবাদ এবং গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। বিএনপি জামায়াতের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিলেই আলোচনার বিষয় সামনে আসবে। কিন্তু বিএনপি ছাড়বে বলে মনে হয় না।

জামায়াতকে বিএনপির না ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির রসদ জোগাচ্ছে কিনা?

নূহ-উল-আলম লেনিন : আমরা দেশের কল্যাণ চাই। আমরা কোনো তীরের খেলা খেলতে চাই না। জামায়াতকে ছাড়লে বিএনপিরও মঙ্গল।
এই অবস্থায় মুক্তির উপায় কী?

নূহ-উল-আলম লেনিন : মুক্তির পথ মানুষের বিশ্বাসে। বাঙালিকে কোনো দিন দমিয়ে রাখা যায়নি। বাঙালি বীরের জাতি।

কিন্তু আপনার দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ তো বাঙালিকে বেঈমানের জাতি বলেও মন্তব্য করেছেন?

নূহ-উল-আলম লেনিন : পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক আছে। বাঙালির মধ্যে বেঈমান আছে বলেই তো বঙ্গবন্ধুকে হারাতে হয়েছে।
এমন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সৈয়দ আশরাফ আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন?

নূহ-উল-আলম লেনিন : তিনি হয়তো বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের মধ্যকার বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই তো জাতির স্থপতিকে হারাতে হয়েছে। তিনি হয়তো অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন।

আজকেও সকল ষড়যন্ত্র শেখ হাসিনাকে টার্গেট করেই। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিশ্বাসঘাতক আছে। বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবে না বাঙালির মধ্যে বিশ্বাসঘাতক নেই।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলছেন। এ নিয়ে আপনার মত জানতে চাইব।

নূহ-উল-আলম লেনিন : প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, খালি মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ নেই। এখনই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিন। যে বোঝার সে বুঝে নেবে প্রধানমন্ত্রী কী বলতে চাইছেন। আমাদের অনেকেই মনে করে বিএনপি এবারও নির্বাচনে আসবে না। সহজেই নির্বাচিত হওয়া যাবে। এটিই সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েই তিনি এমন মন্তব্য করছেন।

নির্বাচনে এবার বিএনপিকে প্রত্যাশা করছেন?

নূহ-উল-আলম লেনিন : আমি মনে করি সকল বৈধ দল নির্বাচনে অংশ নিক। মনে রাখবেন, ন্যাড়া দ্বিতীয়বার বেলতলায় যায় না। যে ভুল বিএনপি ২০১৪ সালে করেছে, তারা আর করবে না বলেই আমি বিশ্বাস করি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে কালিমা আওয়ামী লীগের বলেই অনেকে মনে করেন। সেই ভুল হয়তো আর আওয়ামী লীগ করতে চাইছে না?

নূহ-উল-আলম লেনিন : উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে অনেকেই অনেক কথা বলতে পারেন। ভুল কে করেছে, তা বিএনপি নেতাদের কথা থেকেই প্রমাণিত। বিএনপি সংসদে থাকলে গণতন্ত্র আরো সমৃদ্ধ হতো। খালেদা জিয়া এখন হিসাব কষছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গিলতে তিনি বাধ্য হয়েছেন।

পরবর্তী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে এমনটি আশা করছেন?

নূহ-উল-আলম লেনিন : অবশ্যই। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বিএনপির জন্যও বিশেষ বার্তা। বিএনপি হত্যা-সন্ত্রাসের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের মধ্যে যাক, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিক, মানুষের ভাষা বুঝতে পারুক- তাতে দেশেও শান্তি মিলবে, দলটিও জনগণমুখী হতে পারবে।

আওয়ামী লীগ চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে এমন কোনো কথা নয়। বিএনপি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসতে পারলে গণতন্ত্রেরই মঙ্গল। বিএনপি নির্বাচনমুখী হলে রাজনীতিই শক্তিশালী হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর