সেই রাতে ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সেই রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত। ’ (সুরা কদর: ১-৫)
ঠিক কত তারিখে এই রাতের অবস্থান তা কেউ জানে না। তবে রমজানের শেষ দশকে এর অনুসন্ধানের নির্দেশ এসেছে হাদিসে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকে কদরের রাত অনুসন্ধান করো। ’ (সহিহ বুখারি: ২০২০)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘এ মাসে (রমজানে) এমন একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সত্যিই বঞ্চিত হলো। ’ (সুনানে নাসায়ি: ২১০৮)
লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানের অর্থ হলো—আল্লাহর দরবারে এই রাতের কল্যাণ লাভের প্রার্থনা করা, নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। যেন আল্লাহ পাপের কারণে লাইলাতুল কদরের বরকত থেকে বঞ্চিত না করেন।
কদরের রাতে করণীয়
লাইলাতুল কদরে পবিত্র হয়ে ইখলাসের সঙ্গে যত বেশি ইবাদত করা যায় ততই ভালো। যেকোনো গুনাহ ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকাও ইবাদত কবুল হওয়ার মাধ্যম। এখানে শবে কদরে করণীয় বিশেষ ফজিলতপূর্ণ ৯টি আমল তুলে ধরা হলো।
১. বেশি বেশি ইস্তেগফার করা
আয়েশা (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, যদি আমি লাইলাতুল কদর জানতে পারি, তাহলে সে রাতে কী বলব? তিনি বললেন, তুমি বলো—اللَّهمَّ إنَّك عفُوٌّ كريمٌ تُحِبُّ العفْوَ، فاعْفُ عنِّي উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিম, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি’ (অর্থ) ‘হে আল্লাহ, আপনি সম্মানিত ক্ষমাকারী, আপনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। ’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৫১৩) এছাড়াও ইস্তেগফারের মাসনুন দোয়াগুলো যত পারেন পড়বেন।
২. কোরআন তেলাওয়াত করা
কদরের রাতের মর্যাদার সঙ্গে যেহেতু কোরআন নাজিলের বিষয়টি সম্পর্কিত, তাই বুজুর্গ আলেমদের মতে, কদরের রাতে কোরআন তেলাওয়াত করা তাৎপর্যপূর্ণ। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে; আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান? মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ’ (সুরা কদর: ১-৩)
৩. জামাতে ফরজ নামাজ ও তারাবি আদায়
কদরের রাতে জামাতের সঙ্গে মাগরিব, এশা ও ফজর নামাজ আদায় করা খুব জরুরি বিষয়। কেননা হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সঙ্গে পড়ে, সে যেন সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে। ’ (মুসলিম: ৬৫৬)
এরপর যত পারেন নফল নামাজ পড়বেন। কিয়ামুল্লাইল করবেন। তারাবি কিয়ামুল্লাইলের অংশ। শবে কদরে কিয়ামুল্লাইলের বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে- مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمانًا واحْتِسَابًا، غُفِر لَهُ مَا تقدَّم مِنْ ذنْبِهِ – متفقٌ عَلَيْهِ ‘কদরের রাতে যে কিয়ামুল্লাইল করে বিশ্বাস নিয়ে এবং নাজাতের প্রত্যাশায়, আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। ’ (মুত্তাফাকুন আলাইহ)
৪. নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ
নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ দোয়া কবুলে সহায়ক। এক হাদিসে নবীজি বলেছেন, ‘যখন কেউ দোয়া করবে, সে যেন তার পবিত্র প্রতিপালকের প্রশংসা বর্ণনাযোগে ও আমার প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে দোয়া আরম্ভ করে, তারপর যা ইচ্ছা প্রার্থনা করে। ’ (আবু দাউদ: ১৪৮১; তিরমিজি: ৩৪৭৬)
আরেক হাদিসে এসেছে, ‘নবী (স.)-এর ওপর দরুদ না পড়া পর্যন্ত যেকোনো দোয়া আটকে থাকে। ’ (আল-মুজাম আল-আওসাত: ১/২২০, আলবানি ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে (৪৩৯৯) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন)
৫. তাহাজ্জুদ আদায়
তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। মহানবী (স.) রমজানের শেষ দশকে কদরের রাত অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি এই দশকে রাত জেগে ইবাদত করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, যখন রমজানের শেষ দশক আসত, তখন নবী (স.) তাঁর লুঙ্গি কষে বেঁধে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। ’ (সহিহ বুখারি: ২০২৪)
৬. দান-সদকা করা
দান সদকা আল্লাহর রাগ প্রশমিত করে। দানশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ বিশেষভাবে দয়া করেন। সর্বোপরি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার অন্যতম কার্যকর আমল হলো দান সদকা করা। রাসুলুল্লাহ (স.) বিভিন্নভাবে দান-সদকার প্রতি উৎসাহিত করেছেন, এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। (বুখারি: ৬০২৩)
৭. মা-বাবা ও মৃতদের জন্য দোয়া করা
জীবিত মৃত সকল মুসলমানের জন্য দোয়া করা অনেক বড় নেক আমল। এতে কোটি কোটি নেকি যোগ হয় আমলনায়। শবে কদরের মতো রাতে এই দোয়া না পড়া উচিত হবে না। এরকম একটি দোয়া হলো-رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ উচ্চারণ: ‘রব্বানাগ-ফিরলী ওয়ালি ওয়ালি-দাইয়্যা ওয়ালিল মু’মিনীনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিছা-ব। ’ অর্থ: ‘হে আমাদের রব! আমাকে, আমার মাতা-পিতাকে এবং সব ঈমানদারকে আপনি সেই দিন ক্ষমা করে দিন, যেদিন হিসাব কায়েম করা হবে। ’ (সুরা ইবরাহিম: ৪১) এছাড়াও মা-বাবার জন্য কোরআনে বর্ণিত দোয়াগুলো করতে পারেন।
মৃতদের জন্য পবিত্র কোরআনের এই দোয়াটিও করা যায়- رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ ‘রাব্বানাগফিরলানা ওয়া লি ইখওয়ানিনাল্লাজিনা ছাবকুনা বিল ইমানি ওয়া লা তাঝআল ফি কুলুবিনা গিল্লাল লিল্লাজিনা আমানু রাব্বানা ইন্নাকা রাউফুর রাহিম। ’ অর্থ: ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের ক্ষমা কর এবং আমাদের সেসব ভাইকেও ক্ষমা কর যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে আর মুমিনদের প্রতি আমাদের হৃদয়ে কোনো বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয় তুমি অতি স্নেহশীল ও পরম করুণাময়। ’
(সুরা হাশর: ১০)
৮. কাজা নামাজ পড়া
কদরের রাতে বুদ্ধিমানের মতো একটি আমল হলো কাজা নামাজ আদায় করা। রমজানের শেষ ১০ দিন কদর তালাশে প্রতিদিন ১৭ রাকাত ফরজ নামাজের কাজা আদায় করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। কেননা লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাসের চেয়েও বেশি বরকতময়। এমন রাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ কাজা পড়তে পারলে কমপক্ষে হাজার মাস তথা ৮৩ বছর ৪ মাস কাজা নামাজ আদায়ের মতোই হবে ইনশাআল্লাহ।
৯. ইতেকাফ
ইতেকাফ কদরের রাতের বরকত লাভে সহায়ক। কেননা ইতেকাফকারী জাগতিক সব ব্যস্ততা পেছনে ফেলে মহান আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হতে পারে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। ’ (সহিহ বুখারি: ২০২৬