ঢাকা ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আওয়ামী লীগের শরিকরা মাঠে নিষ্ক্রিয়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৩০:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ মার্চ ২০২৪
  • ৪২ বার
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বেড়েছে। মাঠের আন্দোলন থেকে শুরু করে ভোটের মাঠ, কোথাও শরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগে আসন ভাগাভাগিতে শরিকদের জন্য আওয়ামী লীগের একাদশের তুলনায় আসন ছাড় কমেছে। আবার সরকারের মন্ত্রিসভা বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদেও শরিক নেতাদের ঠাঁই মিলছে না।

এমনকি নির্বাচনের আগে খোদ ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘জোটের প্রয়োজনীয়তা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে, তবে কি জোটে ভাঙন দেখা দিতে পারে?

মূলত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ কৌশলে সরকার থেকে জোট নেতাদের দূরে ঠেলে দিতে থাকে। সরকার ও রাজনীতির মাঠ, দুই জায়গায়ই অনুপস্থিত থেকে জোটের মাঝারি দলগুলোও ছোট দলে পরিণত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, এখনই জোট ভেঙে দেওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই।

যদিও জোটের ভেতর এক ধরনের দূরত্বের বিষয়টি দৃশ্যমান। মূলত এটি রাজনৈতিক জোট। ফলে জোটের সবাই সরকারে না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সক্রিয়তা কমতে শুরু করায় জোটের নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে।

তবে আওয়ামী লীগের শরিকদের একাধিক নেতা নেতিবাচক কোনো আশঙ্কার বিষয়টি নাকচ করেছেন।

জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমরা আশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জোটের সবাই মিলে বসব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সময় দিতে পারেননি। আগামী ৫ বা ৬ তারিখ (মার্চ) জোটের সবাইকে নিয়ে আমি নিজে বসব। সেখান থেকে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ বলেন, জোট ভাঙার কোনো শঙ্কা নেই। এটা আদর্শিক জোট। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক জোট। ভাঙাভাঙির কোনো সুযোগ নেই। কিছু জায়গায় কিছু মনোমালিন্য থাকতে পারে, সেটা আলোচনায় ঠিক হয়ে যাবে।

জোটের কার্যকারিতা হারাচ্ছে

২০০৪ সালে ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এক ছাতার নিচে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টি (জেপি) রয়েছে।

মূলত এটিকে আদর্শিক জোট হিসেবেই আখ্যা দিচ্ছে দুই পক্ষ। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে টানা চারবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করায় জোটের রাজনৈতিক কার্যক্রমে গতি কমেছে। মাঠের রাজনীতিতে জোটের নিষ্ক্রিয়তায় ছোট দলগুলো আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। দলগুলোর এখন আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরতা এতটাই বেড়েছে যে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী জোটের অন্য শরিক নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্র্যাকটিক্যালি এটার (জোটের) কার্যকর ভূমিকা থাকছে না। এখন কিভাবে কার্যকর করবে, সেই সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।’

জোট ভেঙে যাওয়ার গুঞ্জন কতটা জোরালো—এমন প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের কোনো প্রত্যাশা নেই। আমরা আমাদের মতো কাজ করে যাব। আমাদের দলের কাজ আছে। আমরা সেটা করে যাচ্ছি। জোট নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। সেটা আওয়ামী লীগ নির্ধারণ করবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৪ দলীয় জোটের প্রাসঙ্গিকতা এখনো রয়েছে। কিন্তু আগামীর পথনকশা তৈরি না হওয়ায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে জোট।

মাঠের রাজনীতিতে নেই শরিকি তৎপরতা

গত এক দশকে তুলনামূলক চিত্র বিবেচনায় মাঠের রাজনীতি কিছুটা কমে আসছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় আন্দোলন-সংগ্রামের মতো দল বা জোটের কোনো কর্মসূচি নেই।

আবার নির্বাচনের বাইরে রাজনৈতিক তৎপরতায় ভাটা পড়ায় জোটের শরিক দলগুলোর কার্যক্রমেও গতি দেখা যাচ্ছে না। এতে জোটের শরিক দলগুলোর কার্যক্রম কমে আসায় দলগুলোও ছোট হয়ে আসছে।

জোটের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির নেতা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব দলীয় বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের আদর্শিক রাজনৈতিক জোট হয়েছে। আমরা সরকারে না থাকলেও জোটে থাকছি।’

একই প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বিভিন্ন দল ছোট-বড় হয়তো হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু এর জন্য আমি জোটকে দায়ী করতে চাই না। যে যার দল নিজেদের মতো করে চালাবে। জোটের আলোচনা ভিন্ন।’

ভোটের সমীকরণে শরিকদের সম্মান কমেছে

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাদশ নির্বাচনের তুলনায় শরিক দলগুলো আওয়ামী লীগ থেকে আসন ছাড় কম পেয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে ছাড় পাওয়া আসনে জোটের নেতারা নৌকা প্রতীকে ভোট করেছেন। যদিও শরিকদের দল থেকে নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করার পথ উন্মুক্ত ছিল। শরিকরা দল থেকে নিজেদের প্রার্থী দিলেও কেউ জয়ী হতে পারেননি।

নিজেদের জনপ্রিয়তা হারানো এবং নৌকার প্রতি অতি নির্ভরশীলতায় আওয়ামী লীগের চোখে শরিক নেতাদের সম্মান কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

১৪ দলীয় জোট সূত্র কালের কণ্ঠকে বলছে, দ্বাদশ নির্বাচনের আগে সংসদ ভবনে জোটের যে সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল, সেখানে জোটকে মূল্যায়ন করা হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের একটি অংশ বৈঠকে সরাসরি জোটের বিপক্ষে কথা বলেছে।

ওই বৈঠকে শরিক জোটের অন্যতম দুই নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর শরিকের আসন থেকে স্বতন্ত্র তুলে নেওয়ার প্রস্তাব নাকচ হয়। পরে আওয়ামী লীগ ও জোটের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে শরিকদের নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়।

জোটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা শরিক জোটের এক নেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আসলে নৌকার জন্য পাগল কেন? কারণ জনগণের কাছে নৌকা প্রতীকের ভিত্তি আছে। আমাদের দলীয় প্রতীকগুলোর ভিত্তি নেই।’

এই নেতা বলেন, ‘নিজের বল বড় বল। নিজের বল না থাকলে অন্যে মূল্যায়ন করবে না। আমরা নিজের দলকে বড় করতে পারিনি। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেদের মতো অগ্রসর হবে—এটাই স্বাভাবিক।’

মন্ত্রিসভায় ঠাঁই মিলছে না

২০০৮ সালে মহাজোট করে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। ভোটে জয়ের পর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সেই সরকারে শরিকদের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে ছিলেন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়া। জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় পান।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভাতেও শরিকরা ঠাঁই পেয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পান ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তথ্যমন্ত্রী হন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) নেতা আনোয়ার হোসেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

২০১৮ ও ২০২৪ সালে একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেষের দুই মন্ত্রিসভায় জোটের শরিকদের ঠাঁই হয়নি। সর্বশেষ মন্ত্রিসভা এখনো বর্ধিত হতে পারে। কিন্তু সেই বর্ধিত অংশের আলোচনাতেও জোটের কোনো নেতার নাম শোনা যাচ্ছে না।

সরকারে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, শরিক হিসেবে সরকারের অংশ হওয়ার, মন্ত্রিসভায় থাকার একটা প্রত্যাশা থাকে। নবম সংসদ থেকে এটার ধারাবাহিকতা ছিল। পরে সরকারে শরিকদের অংশগ্রহণ কমতে কমতে ২০১৮ সালে এসে নেই হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ থেকে অনেকবার শরিকদের ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর’ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জোটের প্রবীণ নেতারা সেই ঝুঁকি নিতে রাজি হননি।

মন্ত্রিসভায় শরিকদের জায়গা না পাওয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘আমরা সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গেই আছি। কিন্তু মন্ত্রিসভায় নেই। এটাকে জোটের ২০০৮ সালে যে নীতি হয়েছিল, সেই নীতি বাস্তবায়নের ঘাটতি হিসেবেই দেখি।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

আওয়ামী লীগের শরিকরা মাঠে নিষ্ক্রিয়

আপডেট টাইম : ১০:৩০:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ মার্চ ২০২৪
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বেড়েছে। মাঠের আন্দোলন থেকে শুরু করে ভোটের মাঠ, কোথাও শরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগে আসন ভাগাভাগিতে শরিকদের জন্য আওয়ামী লীগের একাদশের তুলনায় আসন ছাড় কমেছে। আবার সরকারের মন্ত্রিসভা বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদেও শরিক নেতাদের ঠাঁই মিলছে না।

এমনকি নির্বাচনের আগে খোদ ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘জোটের প্রয়োজনীয়তা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে, তবে কি জোটে ভাঙন দেখা দিতে পারে?

মূলত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ কৌশলে সরকার থেকে জোট নেতাদের দূরে ঠেলে দিতে থাকে। সরকার ও রাজনীতির মাঠ, দুই জায়গায়ই অনুপস্থিত থেকে জোটের মাঝারি দলগুলোও ছোট দলে পরিণত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, এখনই জোট ভেঙে দেওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই।

যদিও জোটের ভেতর এক ধরনের দূরত্বের বিষয়টি দৃশ্যমান। মূলত এটি রাজনৈতিক জোট। ফলে জোটের সবাই সরকারে না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সক্রিয়তা কমতে শুরু করায় জোটের নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে।

তবে আওয়ামী লীগের শরিকদের একাধিক নেতা নেতিবাচক কোনো আশঙ্কার বিষয়টি নাকচ করেছেন।

জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমরা আশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জোটের সবাই মিলে বসব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সময় দিতে পারেননি। আগামী ৫ বা ৬ তারিখ (মার্চ) জোটের সবাইকে নিয়ে আমি নিজে বসব। সেখান থেকে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ বলেন, জোট ভাঙার কোনো শঙ্কা নেই। এটা আদর্শিক জোট। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক জোট। ভাঙাভাঙির কোনো সুযোগ নেই। কিছু জায়গায় কিছু মনোমালিন্য থাকতে পারে, সেটা আলোচনায় ঠিক হয়ে যাবে।

জোটের কার্যকারিতা হারাচ্ছে

২০০৪ সালে ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এক ছাতার নিচে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টি (জেপি) রয়েছে।

মূলত এটিকে আদর্শিক জোট হিসেবেই আখ্যা দিচ্ছে দুই পক্ষ। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে টানা চারবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করায় জোটের রাজনৈতিক কার্যক্রমে গতি কমেছে। মাঠের রাজনীতিতে জোটের নিষ্ক্রিয়তায় ছোট দলগুলো আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। দলগুলোর এখন আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরতা এতটাই বেড়েছে যে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী জোটের অন্য শরিক নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্র্যাকটিক্যালি এটার (জোটের) কার্যকর ভূমিকা থাকছে না। এখন কিভাবে কার্যকর করবে, সেই সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।’

জোট ভেঙে যাওয়ার গুঞ্জন কতটা জোরালো—এমন প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের কোনো প্রত্যাশা নেই। আমরা আমাদের মতো কাজ করে যাব। আমাদের দলের কাজ আছে। আমরা সেটা করে যাচ্ছি। জোট নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। সেটা আওয়ামী লীগ নির্ধারণ করবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৪ দলীয় জোটের প্রাসঙ্গিকতা এখনো রয়েছে। কিন্তু আগামীর পথনকশা তৈরি না হওয়ায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে জোট।

মাঠের রাজনীতিতে নেই শরিকি তৎপরতা

গত এক দশকে তুলনামূলক চিত্র বিবেচনায় মাঠের রাজনীতি কিছুটা কমে আসছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় আন্দোলন-সংগ্রামের মতো দল বা জোটের কোনো কর্মসূচি নেই।

আবার নির্বাচনের বাইরে রাজনৈতিক তৎপরতায় ভাটা পড়ায় জোটের শরিক দলগুলোর কার্যক্রমেও গতি দেখা যাচ্ছে না। এতে জোটের শরিক দলগুলোর কার্যক্রম কমে আসায় দলগুলোও ছোট হয়ে আসছে।

জোটের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির নেতা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব দলীয় বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের আদর্শিক রাজনৈতিক জোট হয়েছে। আমরা সরকারে না থাকলেও জোটে থাকছি।’

একই প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বিভিন্ন দল ছোট-বড় হয়তো হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু এর জন্য আমি জোটকে দায়ী করতে চাই না। যে যার দল নিজেদের মতো করে চালাবে। জোটের আলোচনা ভিন্ন।’

ভোটের সমীকরণে শরিকদের সম্মান কমেছে

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাদশ নির্বাচনের তুলনায় শরিক দলগুলো আওয়ামী লীগ থেকে আসন ছাড় কম পেয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে ছাড় পাওয়া আসনে জোটের নেতারা নৌকা প্রতীকে ভোট করেছেন। যদিও শরিকদের দল থেকে নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করার পথ উন্মুক্ত ছিল। শরিকরা দল থেকে নিজেদের প্রার্থী দিলেও কেউ জয়ী হতে পারেননি।

নিজেদের জনপ্রিয়তা হারানো এবং নৌকার প্রতি অতি নির্ভরশীলতায় আওয়ামী লীগের চোখে শরিক নেতাদের সম্মান কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

১৪ দলীয় জোট সূত্র কালের কণ্ঠকে বলছে, দ্বাদশ নির্বাচনের আগে সংসদ ভবনে জোটের যে সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল, সেখানে জোটকে মূল্যায়ন করা হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের একটি অংশ বৈঠকে সরাসরি জোটের বিপক্ষে কথা বলেছে।

ওই বৈঠকে শরিক জোটের অন্যতম দুই নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর শরিকের আসন থেকে স্বতন্ত্র তুলে নেওয়ার প্রস্তাব নাকচ হয়। পরে আওয়ামী লীগ ও জোটের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে শরিকদের নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়।

জোটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা শরিক জোটের এক নেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আসলে নৌকার জন্য পাগল কেন? কারণ জনগণের কাছে নৌকা প্রতীকের ভিত্তি আছে। আমাদের দলীয় প্রতীকগুলোর ভিত্তি নেই।’

এই নেতা বলেন, ‘নিজের বল বড় বল। নিজের বল না থাকলে অন্যে মূল্যায়ন করবে না। আমরা নিজের দলকে বড় করতে পারিনি। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেদের মতো অগ্রসর হবে—এটাই স্বাভাবিক।’

মন্ত্রিসভায় ঠাঁই মিলছে না

২০০৮ সালে মহাজোট করে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। ভোটে জয়ের পর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সেই সরকারে শরিকদের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে ছিলেন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়া। জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় পান।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভাতেও শরিকরা ঠাঁই পেয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পান ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তথ্যমন্ত্রী হন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) নেতা আনোয়ার হোসেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

২০১৮ ও ২০২৪ সালে একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেষের দুই মন্ত্রিসভায় জোটের শরিকদের ঠাঁই হয়নি। সর্বশেষ মন্ত্রিসভা এখনো বর্ধিত হতে পারে। কিন্তু সেই বর্ধিত অংশের আলোচনাতেও জোটের কোনো নেতার নাম শোনা যাচ্ছে না।

সরকারে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, শরিক হিসেবে সরকারের অংশ হওয়ার, মন্ত্রিসভায় থাকার একটা প্রত্যাশা থাকে। নবম সংসদ থেকে এটার ধারাবাহিকতা ছিল। পরে সরকারে শরিকদের অংশগ্রহণ কমতে কমতে ২০১৮ সালে এসে নেই হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ থেকে অনেকবার শরিকদের ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর’ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জোটের প্রবীণ নেতারা সেই ঝুঁকি নিতে রাজি হননি।

মন্ত্রিসভায় শরিকদের জায়গা না পাওয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘আমরা সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গেই আছি। কিন্তু মন্ত্রিসভায় নেই। এটাকে জোটের ২০০৮ সালে যে নীতি হয়েছিল, সেই নীতি বাস্তবায়নের ঘাটতি হিসেবেই দেখি।’