নেত্রকোণা জেলা প্রতিনিধিঃ বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারী-২০২৪) মহামান্য হাইকোর্ট নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর উপজেলাধীন সোমেশ্বরী নদীতে বালুমহাল ইজারা দরপত্র সংক্রান্ত সকল কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেছেন। একইসাথে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে প্রদত্ত আদেশ নেত্রকোণা জেলা প্রশাসককে অবহিত করারও নির্দেশ প্রদান করেছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) কর্তৃক ২০১৫ সালে দায়েরকৃত এক জনস্বার্থমূলক মামলায় (নং৫৩৩২/২০১৫) প্রদত্ত ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই আদেশের বাস্তবায়ন ও বালুমহালে নতুন করে ইজারা দরপত্র সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে বেলা কর্তৃক দায়েরকৃত একটি আবেদনের শুনানী শেষে নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর উপজেলাধীন সোমেশ্বরী নদীতে বালুমহাল ইজারা দরপত্র সংক্রান্ত সকল কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেছেন আদালত।
বিজ্ঞ বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এবং বিজ্ঞ বিচারপতি খিজির হায়াত এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেন।
নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক আদালতের আদেশ ও বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ এর বিধান লঙ্ঘন করে সোমেশ্বরী নদীতে মামলাভূক্ত পাঁচটি বালু মহাল ১৪৩১ বঙ্গাব্দের জন্য ইজারার উদ্দেশ্যে চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি নতুন করে দরপত্র আহবান করেন। দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিলো আজ (১৬ ফেব্রুয়ারী-২০২৪)।
পাঁচটি বালু মহালের নাম:
১. বিজয়পুর ও ভবানীপুর থেকে শ্মশানঘাট। ২.শ্মশান ঘাট থেকে চৈইডালি পর্যন্ত ৩.বিরিশিরি ঘাট থেকে কিরণখোলা পর্যন্ত ৪.গোয়াকান্দি মৌজার উত্তর সীমান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত ৫.ঝাঞ্জাইল থেকে উত্তর চানকরপুর পর্যন্ত।
বর্তমানে বালুমহালগুলো থেকে মোস্তাক আহমেদ রুহীর মালিকানাধীন মেসার্স রুহী এন্টারপ্রাইজ এবং মো. জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন মেসার্স জিহান এন্টারপ্রাইজ ইজারা গ্রহীতা হিসেবে বালু উত্তোলন করছে।
উল্লেখ্য, অনিয়ন্ত্রিত বালু ও পাথর উত্তোলন থেকে নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর উপজেলাধীন সোমেশ্বরী নদী রক্ষায় বেলা একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (নং-৫৩৩২/২০১৫) দায়ের করে। মামলার প্রাথমিক শুনানী শেষে মহামান্য আদালত বিগত ২৯ জুলাই, ২০১৫ তারিখে রুল জারি করেন। উক্ত রুলে বালুমহাল ইজারা প্রদান সংক্রান্ত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবেনা তা জানতে চেয়েছেন আদালত। একইসাথে সোমেশ্বরী নদীকে কেন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হবেনা তাও জানতে চেয়েছেন মহামান্য আদালত।
রুল জারির পাশাপাশি মহামান্য আদালত মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড; জেলা প্রশাসক, নেত্রকোণা এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দূর্গাপুর উপজেলা, নেত্রকোণাকে আইন অনুযায়ী উক্ত নদীর প্রতিবেশগত অবস্থা নিরূপণ করতে, আইন ও ইজারা শর্ত অনুযায়ী কঠোরভাবে নদী থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ এবং বালু, পাথর ও মাটি উত্তোলনে পাম্প ও ড্রেজার মেশিন ব্যবহার প্রতিরোধ করতে নির্দেশ প্রদান করেন।
আদালত জেলা প্রশাসক, নেত্রকোণা এবং পুলিশ সুপার, নেত্রকোণাকে বালু, পাথর ও মাটি উত্তোলন নিয়মিত তদারকি করতে নির্দেশ প্রদান করেছেন যাতে করে ইজারা গ্রহীতাগণ ইজারা চুক্তির বাইরে গিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে।
মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড; জেলা প্রশাসক, নেত্রকোণা; পুলিশ সুপার, নেত্রকোণা; উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দূর্গাপুর উপজেলা, নেত্রকোণা; মেয়র, দূর্গাপুর পৌরসভা, নেত্রকোণাকে আদালতের নির্দেশ পালন সাপেক্ষে কমপ্লায়েন্স দায়ের করার নির্দেশ প্রদান করেন।
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সোমেশ্বরী নদী থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ এবং বালু, পাথর ও মাটি উত্তোলনে পাম্প ও ড্রেজার মেশিন ব্যবহার কঠোরভাবে প্রতিরোধে বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও সোমেশ্বরী নদীতে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ইজারা গ্রহীতা ইজারা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে পুরো নদী থেকে হাজার হাজার নিষিদ্ধ ড্রেজার বসিয়ে দিনরাত বালু তুলছে। প্রতিদিন গড়ে ৪৫০০ টি করে ট্রাকে এই বালু পরিবহণ করা হয়। ভেজা বালু পরিবহনের ফলে আত্রাখালী, শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়ক সাধারণের চলাচলের অনুপযুক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
সোমেশ্বরী নদী থেকে বালুর ট্রাক চলাচলের জন্য সোমেশ্বরীর শাখা নদী আত্রাখালীর মুখে বালু ফেলে আত্রাখালী নদীকে পরিণত করা হয়েছে বালু চরে। বর্তমানে সোমেশ্বরী নদী থেকে আত্রাখালী নদীতে পানির কোন প্রবাহ নেই। বালু রাখার জন্য ইজারা গ্রহীতা ইতোপূর্বে দূর্গাপুরের বিরিশিরি পিসিনল বিদ্যালয়ের মাঠও ব্যবহার করেছে যা বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য বাড়তি ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান এই নদীটির স্বচ্ছ
জলরাশি ও অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের বিমোহিত করতো। এ নদীতে পাওয়া যেত মহাশোল মাছসহ শতাধিক প্রজাতির মাছ। অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত হাজারো শ্যালো মেশিন থেকে নির্গত পোড়া মবিল ও তেল নদীর পানিতে মিশে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে নদীর পানি। ফলে নদীটির সৌন্দর্য যেমন বিপর্যস্ত পাশাপাশি মহাশোলসহ বিলুপ্ত হয়েছে শতাধিক প্রজাতির দেশিয় মাছ।
অপরিকল্পিত ও আইনবহির্ভূতভাবে বালু উত্তোলনে নদী ও নদী এলাকায় অবস্থিত তেরীবাজার, মোক্তারপাড়া, ভবানীপুর, ফারাংপাড়া, কামারখালি, কুল্লাগড়া, ডাকুমারা, শিবগঞ্জ, গাঁওকান্দিয়া, গোরাইত এবং বিরিশিরি নামক গ্রামসমূহ ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন রকম বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। দিন রাত খননযন্ত্র ও ট্রাক চলাচলের বিকট শব্দ এবং বাতাসে মিশে থাকা বালু কণা মানুষের শ্বাসকষ্ট ও শ্রবণ সমস্যা বৃদ্ধি করছে। ভয়ংকর বায়ু দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে চারপাশের এলাকা।
প্রতিদিন চার হাজারেরও বেশী ভেজা বালুবাহী ট্রাক নিয়ে এলাকায় প্রবেশ করছে বহুসংখ্যক বহিরাগত পরিবহন শ্রমিক। এতে এলাকার তরুণী ও নারীসহ লাখো মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ভেঙ্গে পড়েছে এলাকার সামাজিক সুরক্ষাবলয়। বেপরোয়া বালু উত্তোলনে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।
বেলা’র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন এ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং তাঁকে সহযোগিতা করেন এডভোকেট এস. হাসানুল বান্না।
মামলার বিবাদীগণ-১। সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়; ২। সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়; ৩। সচিব,পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়; ৪।সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়; ৫। চেয়ারম্যান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন; ৬। বিভাগীয় কমিশনার, ময়মনসিংহ; ৭। মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর; ৮। মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড; ৯। জেলা প্রশাসক, নেত্রকোনা; ১০। পুলিশ সুপার, নেত্রকোনা; ১১। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দূর্গাপুর, নেত্রকোনা।
এ ব্যাপারে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)র প্রধান নির্বাহী এ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমাদের আগে নদী বাঁচাতে হবে। সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলন না হওয়ার ফলে নদীটি এখন হুমকীর মুখে পড়েছে। আমরা ২০১৫ সালে নদীটিকে বাঁচাতে এ ব্যাপারে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করি, হাইকোর্ট নদীটির অবস্থা, বালু উত্তোলন প্রক্রিয়া জানিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন চায়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন না দিয়ে নতুন করে বালুমহাল ইজারা দেওয়া আইনত: অবৈধ, আজ হাইকোর্ট সোমেশ্বরীর বালুমহাল ইজারা প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে।
নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ বলেন, আমরা এখনও আদেশ পাইনি। আদেশ পেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।