বাংলাদেশের মতো নিম্নআয়ের দেশে সব মানুষ প্রতিদিন প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এ দেশের মানুষের কাছে ভাত জনপ্রিয় হওয়ায় প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে।
এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) নতুন উদ্ভাবিত দুটি জাতের ধানের একটি হলো ব্রি ধান ১০৭ ও অন্যটির নাম ব্রি ধান ১০৮।
অন্য ধানের তুলনায় এসব ধানে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে সেটা মানুষের শরীরের আমিষ প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে পুষ্টি বিজ্ঞানীদের।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, উভয় প্রজাতির ধান যেমন উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ, ঠিক তেমনি এগুলো উচ্চফলনশীলও। সেইসঙ্গে এই ধান থেকে চিকন ও ঝরঝরে চাল হওয়ায় এগুলো বিদেশে রপ্তানিযোগ্য। যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তারা প্রতিদিন আমিষজাতীয় খাবার খেতে পারে না।
ব্রি ধান ১০৭
ব্রি ধান ১০৭ হলো উফশী বালাম জাতের বোরো মৌসুমের ধানের জাত। এই প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করতে বিজ্ঞানীদের প্রায় সাত বছর লেগেছে।
এ ধানের জীবনকাল ১৪৮ থেকে ১৫০ দিন। এ ধানের দানার রং খড়ের মতো এবং চাল হলো বাসমতী এবং বালাম চালের মতো লম্বা এবং চিকন। এছাড়া পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০৩ সে.মি.।
যখন এটি মাঠপর্যায়ে চাষ করা হবে, তখন হেক্টরপ্রতি এই ধানের গড় ফলন হবে ৮ দশমিক ২ টন। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা করলে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ থেকে ১০ টন পর্যন্তও ফলন দিতে পারে ব্রি ধান ১০৭।
এ প্রজাতির ধানটি লবণাক্ত বা খরা এলাকা বাদে সারা দেশে চাষাবাদযোগ্য জানিয়ে ব্রি’র উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবদুল কাদের বলেন, সাধারণ চালে ৬ থেকে ৮ শতাংশ প্রোটিন এমনিতেই থাকে; কিন্তু এই ধানে ১০ দশমিক ০২ শতাংশ প্রোটিন আছে।
কেউ যদি তিনবেলা এই চালের ভাত খায়, তাহলে এটা দিয়ে তার শরীরের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
‘দৈনিক একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ৫৮ গ্রাম প্রোটিন দরকার হয়; কিন্তু বাংলাদেশে অনেক গরিব মানুষ আছে, যারা প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিদিন দুধ, ডিম, মাছ, মাংস খেতে পারেন না। তাদের জন্য এই চাল খুব-ই উপযোগী। কারণ এতে দুই শতাংশের মতো বেশি প্রোটিন আছে।’
ব্রি’র উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম মাসুদুজ্জামানের নেতৃত্বে ‘ব্রি ধান ১০৮’ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। এ প্রজাতির ধানটি অপেক্ষাকৃত খাটো বা ছোট চাল; সেইসাথে আবার চিকনও। এটার গড় ফলন হলো হেক্টরপ্রতি সাড়ে ৮ টন। কিন্তু এটাও উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ১০ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে।
চালটির আকার হবে জিরার মতো এবং এর ভাত হবে ঝরঝরে, সাদা রঙের। এতে প্রোটিনের মাত্রা ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এটিও বোরো মৌসুমে উপকূল ও খরাপ্রবণ অঞ্চল বাদে সারা দেশে চাষযোগ্য।
গত প্রায় নয় বছর ধরে এই প্রজাতিটির জন্য গবেষণা করে হয়েছে জানিয়ে মি. কাদের বলেন, কেউ যদি তিনবেলা এই চালের ভাত খায়, তবে এখান থেকে তার দেহের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হবে।
তিনি জানান, গাজীপুরে অবস্থিত ধান গবেষণা কেন্দ্রে এবং ব্রি’র ১১ টি আঞ্চলিক অফিসে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর নতুন প্রজাতির এই ধান দুটো কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
এই ধান কি মাছ-মাংসের বিকল্প?
উচ্চ প্রোটিনসম্পৃদ্ধ ধান হওয়ায় এই ধানগুলো মানুষের দেহের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে ঠিকই; কিন্তু সেটা মাছ, মাংস, দুধ, ডিমের বিকল্প হবে কিনা; সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
মি. কাদের এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্রি ধান ১০৭ এবং ১০৮-কে প্রোটিনের চাহিদা পূরণে বিকল্প বলা যাবে কিনা, আমি জানি না। তবে প্রোটিনের চাহিদা পূরণে যারা মাছ-মাংস কিনে খেতে পারছে না, তাদের ক্ষেত্রে এটা ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি। বিশেষ করে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তবে পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, চালের মধ্যে প্রোটিন থাকলেও তা আমিষজাত প্রোটিনের অভাব পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীনের মতে, চাল থেকে যে প্রোটিন পাওয়া যায়, তা মানবদেহে প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট না।
‘বাড়ন্ত বয়সের বাচ্চাদের গ্রোথের জন্য প্ল্যান্ট প্রোটিন (উদ্ভিজ আমিষ) পর্যাপ্ত না। বাচ্চাকে এনিমেল প্রোটিন (প্রাণীজ আমিষ) খেতেই হবে। প্রাণীজ আমিষ প্রাণীজ আমিষ-ই, উদ্ভিজ আমিষ উদ্ভিজ আমিষ-ই।’
তিনি বলেন, চাল থেকে প্রাপ্ত আমিষ কখনো উদ্ভিজ আমিষের ‘সাবস্টিটিউট’ হতে পারে না। ‘এনিমেল প্রোটিনের ক্ষেত্রে যে ২০টি অ্যামাইনো এসিড দিয়ে প্রোটিন তৈরি হচ্ছে, তা গ্রোথের জন্য যে মাত্রায় দরকার, সেটা উদ্ভিজ আমিষ দিয়ে সরবরাহ সম্ভব না। সে কারণেই গ্রোথের জন্য এনিমেল প্রোটিন লাগবে।’
তিনি বলেন, আমার শক্তির কত শতাংশ কোন খাত থেকে আসবে, সেটা তো গাইডলাইন করে দেওয়া আছে। প্রতি কেজি ওজনের জন্য দশমিক ৮ গ্রাম প্রোটিন দরকার। সেক্ষেত্রে, যতটুকু প্রোটিন সে খাবে, তার ১০-২০ শতাংশ এনিমেল প্রোটিন থাকতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু ভাত বেশি খায়, তাই তাদের দৈনিক প্রোটিনের চাহিদার অনেকটাই এখান থেকে পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু তারা মানসম্পন্ন প্রোটিন খাচ্ছে কিনা, সেটাই মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত বলে মনে করেন মিজ নাজমা।
‘বাংলাদেশের মানুষের প্রোটিন রিকোয়ারমেন্ট নিয়ে সমস্যা নাই। আমাদের যে চাহিদা, ভাত বেশি খাওয়ায় সেটা এমনিতেও ফুলফিল হয়ে যায়; কিন্তু সেজন্য তো আমরা ভাত বেশি খাওয়াকে রিকমেন্ড করতে পারি না। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রোটিন কোয়ালিটি। কারণ, এনিমেল প্রোটিন এবং প্লান্ট প্রোটিনের কোয়ালিটি এক না।’
তিনি বলেন, প্লান্ট প্রোটিনের যে কোয়ালিটি, তাতে যে পরিমাণ অ্যামাইনো এসিড থাকার কথা, সেটা থাকে না। তাই, প্রোটিনের কোয়ালিটি এনং কোয়ান্টিটি, দুটোই নিশ্চিত করতে হয়। প্রোটিন যদি পুওর কোয়ালিটির হয়, সেক্ষেত্রে কোয়ান্টিটি ঠিক করেও কোনো লাভ নাই।
বাংলাদেশে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ ধান এই প্রথম?
যখন কোনো ধানে প্রোটিনের পরিমাণ ৯ শতাংশের বেশি থাকে, তখন সেটিকে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ ধান হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই হিসেবে, বাংলাদেশে উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ধানের উদ্ভাবন এটাই প্রথম না।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ ধানের প্রজাতি উদ্ভাবন করা হয় ১৯৯৭ সালে, ধানটির নাম ব্রি ধান ৩৪।
এরপর সময়ের সাথে সাথে আরও অনেক প্রজাতির ধান এসেছে, যেগুলোর সবগুলোতেই প্রোটিনের পরিমাণ ১০ শতাংশের কাছাকাছি। ব্রি ধান ৩৪-এর পর এসেছে- ব্রি ধান ৩৬, ব্রি ধান ৩৭, ব্রি ধান ৬৬, ব্রি ধান ৮১, ব্রি ধান ৮৬, ব্রি ধান ৯০, ব্রি ধান ৯১, ব্রি ধান ৯৬, ব্রি হাইব্রিড ৪, ব্রি হাইব্রিড ৭; কিন্তু পার্থক্য হলো, ব্রি ধান ৩৪ উদ্ভাবনের অনেক পরে জানা গেছে যে এটি উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ ধান।
মি. কাদের বলেন, ভারতেও কয়েকটা প্রজাতি এর আগে অনুমোদন পেয়েছে। আমাদেরও ১০-১১ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ ধানের কিছু কিছু প্রজাতি এর আগে আগে থেকেই হচ্ছে।
‘পার্থক্য হলো, আগে সেগুলো টার্গেট (লক্ষ্য নিয়ে) করে করিনি। কিন্তু এখন আমরা সাধারণ মানুষের পুষ্টির কথা বিবেচনা করে টার্গেট করে করছি। এখন আমরা টার্গেট নিয়ে কাজ করছি যে প্রোটিন হাই হতে হবে।’
কবেনাগাদ বাজারে আসবে?
মি. কাদের জানান, এ বছর বীজ উৎপাদন করা হলে ২০২৫ সালের মে মাসের পর এ ধানের চাল বাজারে আসবে।
বীজ কৃষকদের হাতে চলে গেলে কত হেক্টর জমিতে এই ধানের চাষ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা প্রজাতি উদ্ভাবন হওয়ার সাথে সাথে কৃষকদের হাতে যায় না। এটার আস্তে আস্তে প্রসার হবে। সেই হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি যে এটা পূর্ণাঙ্গভাবে মাঠে যেতে তিন থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে। আর এই বছর কি পরিমাণ বীজ উৎপাদন করতে পারবো আমরা, তার ওপর নির্ভর করছে যে কতটুকু ধান উৎপাদন হবে। আমাদের ধারণা, এ বছর আমাদের পক্ষে ২০-৩০ টনের বেশি বীজ উৎপাদন করা সম্ভব না।
তিনি জানান, এ ধানের উৎপাদনে বাড়তি কোনো খরচ হবে না। তাই দাম সাধারণ মানুষের নাগালেই থাকবে। তবে এটার গ্রেইন কোয়ালিটি ভালো হলে বাজারদর কিছুটা বেশি থাকবে। আমরা সবাই-ই জানি যে বাজারে মোটা চালের দাম চিকন চালের দামের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি পড়ছে; কিন্তু আমরা আশা করি, দাম নাগালের মাঝেই থাকবে। যেহেতু এর উৎপাদন খরচ অন্যান্য ধানের মতোই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।