ভাগ্য কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ জানে না। বিধাতা মানুষের জীবনের আড়ালে লুকিয়ে রাখে বিস্ময় এবং চমকপ্রদ উপহার। অনেক বড় মনীষী, তারকা, সমাজের আইডলদের অতীত জীবন খুঁজলে পাওয়া যায় দারিদ্র্যের কঠোর সংগ্রামের ইতিহাস। তেমনই একজন রাষ্ট্রনায়ক এরদোয়ান। এক সময়ের রুটি ও লেবুর শরবত বিক্রেতা থেকে তিনি আজকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। টানা তৃতীয়বার দেশটির প্রেসিডেন্ট তিনি। নরেন্দ্র মোদী কিংবা বারাক ওবামার কথা অনেকেই জানেন। আসুন, আজ জেনে নেই বিশ্বের অন্যতম মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের গল্প।
১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ইস্তাম্বুলের কাছিমপাশা শহরতলীতে জন্মগ্রহণ করেন এরদোয়ান। বাবার নাম আহমদ এরদোয়ান, মায়ের নাম তানজিলে হানিম। এরদোয়ানের জন্মের সময় চলছিল রজব মাস। তাই তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় রেজেব। তুর্কি ভাষার রজব মাসকে বলা হয় রেজেব। তার দাদার নাম তাইয়িপ এবং বংশীয় নাম থেকে নেয়া হয় এরদোয়ান। সব মিলিয়ে তার নাম রাখা হয় রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। বাবা ছিলেন পেশায় জাহাজের ক্যাপ্টেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে এরদোয়ান) তৃতীয়।
এরদোয়ানের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বাবার আয় থেকে সামান্য হাত খরচ পেতেন। সেই হাত খরচ থেকে টাকা জমিয়ে পোস্ট কার্ড কিনে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। এ ছাড়াও রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করতেন পানির বোতল। পরিবারকে সহায়তা করতে একসময় এরদোয়ান বিক্রি শুরু করেন রুটি ও শরবত। সেসব টাকা দিয়ে শুধু পরিবারকে সাহায্য করতেন তা নয়, স্কুলের বেতনও দিতেন তিনি। ছোট থেকেই বই পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। কলেজে পা রাখার আগেই নিজের টাকায় গড়ে তোলেন ব্যক্তিগত পাঠাগার।
স্কুলজীবন থেকেই ফুটবলের প্রতি দারুণ ঝোক ছিল এরদোয়ানের। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই শুরু করেন ক্লাব ফুটবল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সুনাম। এরপর ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয় ফুটবল দল আইইটিটিতে যোগ দেন। দীর্ঘদিন তিনি এই ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং দায়িত্ব পালন করেছেন ক্যাপ্টেন হিসেবেও। পরে তার নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে ইস্তাম্বুল ক্লাব তাকে সুযোগ করে দেয় জাতীয় ফুটবল ক্লাবে নিবন্ধনের জন্য। এই ক্লাবের খেলোয়াড় হতে পরিবারের অভিভাবকের অনুমতি লাগে। কিন্তু অনুমতি দেন নি এরদোয়ানের বাবা। বাবার নিষেধে আর ফুটবলে ফেরেননি এরদোয়ান।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এরদোয়ান। ১৯৭৬ সালে তিনি কমিউনিস্ট বিরোধী অ্যাকশন গ্রুপ ন্যাশনাল তুর্কি স্টুডেন্ট ইউনিয়নে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে জড়িত হন। একই বছর ইসলামিস্ট ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির (এমএসপি) বেয়োগলু যুব শাখার প্রধান হন। এবং পরে দলের ইস্তাম্বুল যুব শাখার চেয়ারম্যান হিসেবে পদোন্নতি পান।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর যখন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যায় তখন তিনি বেসরকারী খাতে পরামর্শদাতা এবং সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
এরদোয়ান ১৯৮৬ সালের সংসদীয় উপ-নির্বাচনে ইস্তাম্বুলের ৬তম জেলা প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেন। কিন্তু উপ-নির্বাচনে পঞ্চম বৃহত্তম দল হিসাবে তার দল শেষতম হওয়ায় কোনো আসন পাননি। তিন বছর পর এরদোয়ান বেয়োগলু জেলার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ২২.৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। হয়েছিলেন দ্বিতীয়। এরদোয়ান ১৯৯১ সালে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন। কিন্তু পছন্দের ভোটের কারণে তার আসন গ্রহণ করতে বাধা দেয়া হয়।
১৯৯৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ২৫.১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হন। মেয়ের হয়েই নানা ধরনের উন্নয়নকাজে হাত দেন এরদোয়ান যা এর আগে করেনি কোন মেয়র।
এরদোয়ান ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ভালো বক্তা। দলের অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে সবার সামনে চলে আসেন তিনি। তার চমকপ্রদ বক্তৃতা সবাইকে আকর্ষণ করতো। ১৯৯৭ সালের অভ্যুত্থানের পর তার ভাষণেই জেগে ওঠে তার দলের নেতারা। ১৯৯৯ সালে জাতীয়তাবাদী একটি কবিতা পড়ার জন্য চার মাসের জেল হয় এরদোয়ানের। কবিতার পঙ্ক্তি নিম্নরূপ:
‘মসজিদগুলো আমাদের ব্যারাক
গম্বুজগুলো আমাদের হেলমেট
মিনারগুলো আমাদের বেয়নেট
এবং বিশ্বাস হলো আমাদের সৈন্য।’
২০০১ সালে নতুন দল গঠন করেন এরদোয়ান। নাম দেন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। দলের চেয়ারম্যান হন তিনি। এরপর থেকেই দেশজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এরদোয়ান। দল গঠনের বছরখানেক পর ক্ষমতায় আসেন তারা। ২০০৩ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই দেশটির সর্বোচ্চ ব্যক্তি তিনি। ২০১৪ সালে সরাসরি ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে জয় লাভ করেন এই নেতা।
এরদোয়ান তার ক্ষমতাকালে একটি অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হন। ২০১১-১২ সালের দিকে সরকারের ভেতর থাকা আমলা, রাজনীতিবিদ, মিডিয়া কর্মী, অফিসার সকলেই চেয়েছিলেন এরদোয়ানের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ফতুল্লা গুলেন নামে একজন ধর্মপ্রচারক এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বলে এটি গুলেন মুভমেন্ট নামে পরিচিত। মোবাইল ফোনের মেসেজের মাধ্যমে সেদিন এরদোয়ান তুরস্কের সব জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। এরদোয়ানের ডাকে সবাই নেমে পরে রাজপথে। শুরু করে বিক্ষোভ। শেষ হয় এই অভ্যুত্থান। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এক গণভোটে জয়লাভ করেন এরদোয়ান। পরের বছর জুনে ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়ে ২য় বারের মতো তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হন তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের উদ্যোগে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ চলাচলের বিষয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে হওয়া এক সমঝোতাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের। এ বছর নির্বাচনে জয়লাভ করার পর এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন সকল পরাশক্তি দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা একসঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখার দিকে তাকিয়ে আছি।’
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বলেছেন. ‘ফ্রান্স এবং তুরস্ককে অনেক চ্যালেঞ্জ একসাথে মোকাবেলা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপে শান্তি ফিরিয়ে আনা, ইউরো-আটলান্টিক জোটের ভবিষ্যৎ, ভূমধ্যসাগর। পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় আমি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানাই, আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখবো।’
এরদোয়ানকে ভালোবেসে তুরস্কের অনেকেই তাকে ‘সুলতান’ ডাকে।