হাওর বার্তা ডেস্কঃ গত বছরের তুলনায় এ বছর বোরো ধান চাষে রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে প্রায় ১৭২ কোটি টাকা। ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় শুধু সেচেই খরচ বাড়বে ১৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়াও সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় প্রতি বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনে বাড়তি খরচ হবে সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
দেশের মানুষের চালের ৬০ ভাগ জোগান আসে বোরো মৌসুম থেকে। আর এই চালের জোগানের প্রায় অর্ধেকের বেশি যায় উত্তরাঞ্চল থেকে। তবে গত বছরের মাঝামাঝিতে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি আর এ বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে বোরো উৎপাদনে খরচ বাড়ছে কৃষকের।
রংপুর মহানগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাছনা তকেয়ারপাড় এলাকার কৃষক শামছুল হক জানান, এখন বোরোর জমি তৈরিতে সময় কাটছে। তবে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এবার সেচ খরচে বাড়তি টাকা যোগান দিতে হবে। আর এতেই বাড়বে উৎপাদন ব্যয়।
নগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সরেয়ারতল এলাকার কৃষক বুলবুল, জহুরুল ও তাহের জানান, সব কিছুর দাম বেড়েছে। কোনোটাই এখন আর আগের দামে মিলছে না। সার, বীজ, কীটনাশকের দামও চড়া। শীতকালে শ্রমিক সংকটও রয়েছে। যদি শ্রমিক পাওয়া যায়, তবে মজুরি বেশি। গত বছর ডিজেলের দাম বেড়েছিল। এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এখন উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। এভাবেই যদি দাম বাড়তেই থাকে তাহলে কৃষকরা অতিরিক্ত ব্যয় সামাল দিতে মাঠে মারা পড়বে।
পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের পরান এলাকার কৃষক আকরামুল ইসলাম বলেন,‘হামার নিজের জমিজমা নাই। মাইনষের জমি আদি নিয়্যা আবাদ করি। গরু নাই দেকি ট্রাক্টর দিয়্যা চাষ করি। এ্যালাতো সোগেরে দাম বেশি। সার, বীজ ও পানি খরচ বাড়ছে। ডিজেলের দাম, বিদ্যুতের দাম যেভাবে হু হু করি বাড়েছে তাতে হামার মতো গরিব মাইনষোক চাষাবাদ ছাড়ি দেওয়া নাগবে।’
গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টার এলাকার কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, সরকারের উচিত ছিল কৃষি এবং কৃষকের কথা চিন্তা করে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা। কিন্তু কেউ তো তা করছে না। এখন ডিজেল-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কৃষকের ওপর দিয়েই ধকল যাচ্ছে। এভাবেই যদি প্রতি বছর বোরো মৌসুমে উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে, তাহলে চাষাবাদ ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতে হবে।
গত মৌসুমে এক বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। আর এ বছর তা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ বিঘায় খরচ বাড়ছে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা।
শীত মৌসুমে যখন চাষাবাদে ব্যস্ত কৃষক, তখন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে। ঠিক মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় চাষাবাদসহ উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বিড়ম্বনায়।
গেল কয়েক দিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং অব্যাহত থাকায় বাড়ছে অভিযোগ। হঠাৎ কেন এমন বিদ্যুৎ বিপর্যয়- এ প্রশ্নের জবাব নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সহসাই মিলছে না। তবে কর্মচারীরা নাম না প্রকাশের শর্তে বলছেন, জাতীয় গ্রিডে সমস্যার কারণেই ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। কয়েক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে দাবি তাদের।
এদিকে কৃষকরা জানান, গত বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে সেচের খরচ ছিল ১২০০ টাকা, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০০ টাকায়। বীজ প্রতি কেজি ছিল ২০০ টাকা, এবার তা হয়েছে ৩৫০ টাকা। এ ছাড়াও জমি তৈরি ৯০০ থেকে ১৩০০ টাকা, সার খরচ ২০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা, কীটনাশক ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা, ধান রোপণ ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ধান কাটা-মাড়াই ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকা হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হবে জমির ভাড়া ৫০০০ টাকা। সে হিসেবে গত মৌসুমে এক বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। আর এ বছর তা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ বিঘায় খরচ বাড়ছে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা।
চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে বোরে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে সড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে।
রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎচালিত গভীর সেচ পাম্প ৬২ হাজার ৭৫৩টি, অগভীর ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৪টি, ডিজেলচালিত গভীর ৩৩২টি এবং অগভীর সেচ পাম্প রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজার ১৮টি। বোরো ধান সেচনির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় সেচে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎচালিত গভীর-অগভীর সেচ পাম্পের সংখ্যা ৩ লাখ ১২ হাজার ৫২৭টি এবং ডিজেলচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩০টি। শুধু সেচেই কৃষকের ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে বোরে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে সড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে।
তিনি আরও বলেন, বোরো চাষে অতিরিক্ত সেচ লাগে। সেচ দিতে যেন পানির অপচয় না হয় সেজন্য আমরা কৃষকদের লক্ষ্য রাখতে বলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আমাদের সুষম সারের ব্যবহারে উৎপাদন যাতে বৃদ্ধি পায় তার জন্যও কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। খরচ কমাতে কৃষকদের পরিমিত সেচ এবং নিয়ম মেনে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় কৃষক সমিতি রংপুরে সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি জানান, কৃষি ক্ষেত্রে প্রান্তিক, বর্গা আর গরিব কৃষকরা প্রধান। তাদের হাতে কিন্তু টাকা-পয়সা নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের উচিত সরাসরি মাঠে গিয়ে তাদের একটি তালিকা করে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। তারা যেন সেই প্রণোদনা পান, তা নিশ্চিত করা। এটা সম্ভব হলে উৎপাদনের ধারাটা সচল রাখা সম্ভব হবে।