অনেক দোলাচলের পর অবশেষে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হচ্ছে। আগামীকাল রবিবার বিকেল ৪টায় সোনারগাঁও হোটেলে ওই বৈঠক হওয়ার কথা। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয়শঙ্কর গতকাল শুক্রবার নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের জানান, রবিবার বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বিএনপির একাধিক সূত্রও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া তথা গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন প্রশ্নে মোদির এ সফর প্রভাব ফেলতে পারে।
সফরকালে মোদি তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করবেন বলে আশা করে বিএনপি। এ ছাড়া তিনি সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় এ দেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলে যেতে পারেন বলে দলটির মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। গত কয়েক দিনে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও ওয়াশিংটনে অবস্থিত ড. ওসমান ফারুকের সঙ্গে আলাপ করে দলটির এমন প্রত্যাশার কথা জানা গেছে। তা ছাড়া শেষ পর্যন্ত মোদি-খালেদা বৈঠক হচ্ছে এই ভেবে দলটির প্রত্যাশার পারদ আরো বেড়েছে। কারণ বিএনপি মনে করে, ওই বৈঠক যাতে না হয় তার জন্য এমন কোনো চেষ্টা নেই, যা সরকারপক্ষ থেকে করা হয়নি।
কালের কণ্ঠের সঙ্গে যাঁদের আলাপ হয়েছে এমন বেশির ভাগ নেতাই মনে করেন যে বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোট এ মুহূর্তে দেশের জনগণের বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে, যারা আবার বর্তমান সরকারের ওপরে ক্ষুব্ধ। ফলে তাদের মতকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত শুধু এই সরকারকে সমর্থন দিতে পারে না। ওই নেতাদের অন্তত তিনজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু ভারতের সমর্থনের কারণে বর্তমান সরকার টিকে আছে’ বলে জনগণের মধ্যে সৃষ্ট ধারণার কথা সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে। আভাসে-ইঙ্গিতে এও বলা হবে, সরকারের প্রতি একতরফা এ ধরনের সমর্থন অব্যাহত রাখা হলে দেশের জনগণের মধ্যে ভবিষ্যতে ‘ভারতবিরোধী মনোভাব’ চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে।
বিএনপি নেতারা আরো জানান, অন্তত বছর দুয়েক ধরে খালেদা জিয়াসহ ২০ দলীয় জোটের নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছেন না। কিন্তু ওই ধারা অব্যাহত রাখা হলে ভারতবিরোধিতা শুরু হতে পারে। প্রয়োজন হলে মাঠে নামতে পারে বিএনপিও।
কারণ জানতে চাইলে ওই নেতারা বলেন, ক্রমাগত সন্তুষ্ট করার নীতিতেও ভারতের মন না গললে একপর্যায়ে দলের ভেতর থেকেই ভারতবিরোধিতা শুরু হবে। কেননা বিএনপি মনে করতে পারে যে ভারতবিরোধিতা না করায় কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে মোদির সঙ্গে বৈঠকের জন্য সম্ভাব্য ‘টকিং পয়েন্টস’ তৈরিসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বিএনপি। বিশেষ করে বাংলাদেশে উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকট কেন বা কোথা থেকে শুরু তার বিস্তারিত তথ্য ও ঘটনাবলি মোদিকে জানানোর জন্য দলটি লিখিত একটি স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছে।
আগামীকাল ৭ জুন বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে মোদির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। দলটির প্রভাবশালী একজন নেতা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, বিকেল পৌনে ৪টা থেকে আধাঘণ্টা বা ৪৫ মিনিটের ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৃহস্পতিবার রাতেই দিল্লি থেকে এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ বৃহত্তর একটি গণতান্ত্রিক দেশ ভারত নিশ্চয়ই এ দেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো দেখতে চাইবে। তিনি বলেন, এ দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট মোদি সরকারের অজানা নয়। ফলে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলে গণতন্ত্রের এ সংকট দূর হবে মোদি সরকারের কাছ থেকে এমন প্রত্যাশা বিএনপি করতেই পারে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতে, বিজেপি সরকারের প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব এ দেশের সব খবর রাখে। খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি দেশের শতকরা কত ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে তারা এসবও জানে। ফলে তাদের মতামতের প্রতি অবশ্যই মোদি সরকার গুরুত্ব দেবে। এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, সব কিছু যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বলে যাবেন এমন নয়। একটি সরকারের অবস্থান বা মনোভাব কূটনৈতিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবেও ব্যক্ত করা যায়।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বিএনপির দাবি খুবই যৌক্তিক ও স্পষ্ট। এ দেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দরকার। তাঁর মতে, ভারতের বর্তমান সরকারও এ বিষয়ে অবহিত। ফলে বৃহত্তর প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান বা ‘বার্তা’ পাওয়ার আশা বিএনপি করতেই পারে।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সরকার টু সরকার অনেক ইস্যু আছে, যেগুলো সরকারের সঙ্গে আলোচনা হবে। তবে বিএনপির মূল কনসার্ন হলো এ দেশে রাজনৈতিক সংকট তথা গণতন্ত্র উত্তরণের ইস্যু। আমার মনে হয়, এ প্রশ্নে মোদি সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখবেন না। এর প্রমাণ হলো সরকারপক্ষ নানা চেষ্টা করেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে মোদির বৈঠক বাদ দেওয়াতে পারেনি। তা ছাড়া শুনেছি, সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে নেওয়ারও চেষ্টা করেছে, যা সফল হয়নি।’