একটি গরু থেকে ১৩৫টির মালিক


হাওর বার্তা ডেস্কঃ স্বপ্ন দেখতেন একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে ভেঙে যায় সেই স্বপ্ন। একমাত্র সন্তান হওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয়। বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া।

মায়ের কথায় একটি গরু দিয়ে শুরু করেন খামার। একটি গরু থেকে আজ তিনি ১৩৫টি গরুর মালিক। প্রতিদিন তার খামারের গরু থেকে দুধ হয় ৫০০ থেকে ৬০০ লিটার। বছরে খামার থেকে ৫০টির বেশি বাছুর বিক্রি করেন তিনি। এ থেকে ৫০-৬০ লাখ টাকা আয় হয়।

শুধু দুধ নয়, গরুর গোবর থেকে তৈরি হচ্ছে বায়োগ্যাসও। তাতেই মিটছে নিজ বাড়ির রান্না ও গৃহস্থালি কাজে জ্বালানির চাহিদা। আবার গোবর থেকে তৈরি করা হচ্ছে কেঁচো কম্পোস্ট জৈব সার। তার খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত দশজন মানুষের।

এ গল্প পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের বহরমপুর (পাকুরিয়া) গ্রামের সফল উদ্যোক্তা আমিরুল ইসলামের। তার খামারের নাম ‘তন্ময় ডেইরি ফার্ম’। এ বছর বিশ্ব দুগ্ধ দিবসে তিনি দেশসেরা ডেইরি আইকন হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া প্রাণিসম্পদ খাতে অসামান্য অবদান রাখায় পেয়েছেন স্বর্ণপদক সহ সরকারি-বেসরকারি নানা পুরস্কার।

পেছনের গল্প

আমিরুলের বাবার নাম নবীর উদ্দিন প্রামানিক (মৃত)। মা আমেনা খাতুন (মৃত)। ৬ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে আমিরুল ইসলাম ৬ষ্ঠ। পাকশি চন্দ্র প্রভা বিদ্যাপিঠ থেকে ১৯৮৪ সালে এসএসসি ও ১৯৮৬ সালে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তার বাবা মারা যান। আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে কাঁধে। বাবার মৃত্যুতে বাড়ির গরুগুলো সব বিক্রি করে দেওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় আয়ের উৎস।

আমিরুল ইসলামের মা বললেন, বাড়ি গরু শূন্য ভাল লাগছে না। একটা গরু কিনে দাও। তখন ১৯৯৪ সালে উপজেলার পাকশীর রূপপুর থেকে ১৪ হাজার ৬শ’ টাকায় একটি শংকর জাতের গাভী কেনা হয়। গাভিটি বাড়িতে নিয়ে আসার কয়েক মাস পর একটি ষাঁড় বাচ্চা প্রসব করে। সে সময় গাভী থেকে প্রতিদিন ১৩-১৪ লিটার দুধ হতো। এর মধ্যে ষাঁড়টি ২৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে সেই টাকা জমিয়ে রাখি। পরে গাভীটি দুই বছরে দু’টি বকনা বাচ্চা প্রসব করে। গচ্ছিত টাকার সঙ্গে মায়ের দেওয়া আরও কিছু টাকা যুক্ত করে বাড়িতে তৈরি করা হয় খামারের শেড।

এভাবে শুরু হয় আমিরুলের বাণিজ্যিক খামারের যাত্রা। প্রতিবছর গাভীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বড় হতে থাকে খামারের পরিসর।

পরের সফলতার গল্প

২৮ বছরে সেই গল্প এগিয়েছে অনেকদূর। প্রথমদিকে লাভ বেশি হতো। খাবারের দাম কম ছিল। বর্তমানে আমিরুলের খামারে শংকর জাতের ১৩৫টি গাভী রয়েছে। এর পাশাপাশি তিন বছর আগে তিনটি গাড়ল দিয়ে শুরু করা গাড়লের খামারে বর্তমানে ২৫টি গাড়ল রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ৮টি গাড়ল জবাই করা হয়েছে, ৫টি বিক্রি করা হয়েছে। আর ৪টি মহিষ দিয়ে এবছরই শুরু করেছেন মহিষের খামার।

২২ বিঘা জমির ওপর এই খামার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা। তার খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত দশজন মানুষের। এছাড়া খামারে নিজেও গরুর পরিচর্যা করেন আমিরুল ইসলাম।

আমিরুলকে দেখে অনুপ্রাণিত তারা

ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে আমিরুলের খামার থেকে হাতে-কলমে শিক্ষা নেন। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকার অনেকেই গাভীর খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। বহরমপুর গ্রামে ইদ্রিস আলী বলেন, ১৭ বছর আগে আমিরুল ভাইকে দেখে আমিও উদ্বুদ্ধ হয়ে খামার শুরু করি। বর্তমানে আমার খামারে ১২টি গাভী আছে। বছরে ৩ থেকে ৪টি গাভী বিক্রি করি। এখন আগের চেয়ে অনেক স্বচ্ছলতার সাথে দিন পার করছি।

একই গ্রামের আলম হোসেন বলেন, কৃষিকাজ করি। আমিরুলকে দেখে ভাবলাম পাশাপাশি কিছু করি। ১৫ বছর আগে শুরু করি একটি গাভী দিয়ে। বর্তমানে ১৮টি গাভী আছে। এর মাঝে অনেকগুলো গাভী ও বাছুর বিক্রিও করেছি।

পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন

২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ২০১৩ সালে জাতীয় সমবায় পুরস্কার, ২০১৯ সালে প্রফেসর ড. আশরাফ আলী খান স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন সোসাইটি ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমী পুরস্কার, প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। সর্বশেষ চলতি বছরের গত ১ জুন বিশ্ব দুগ্ধ দিবসে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক ২০২১ সালের দেশসেরা ডেইরি আইকন হিসেবে সম্মাননা পদকে ভূষিত হয়েছেন।

আমিরুলের স্বপ্ন

সফল উদ্যোক্তা খামারী আমিরুল ইসলাম বলেন, আমার স্বপ্ন এলাকায় একটি বৃহৎ পরিসরে দুধের পল্লী গড়ে তোলা। ওই পল্লীর বৈশিষ্ট্য হবে স্বল্প মূল্যে দুগ্ধ জাতীয় ও শিশুদের পুষ্টি মেটাতে সুস্বাদু খাবার তৈরি করা। একজন আদর্শ গবেষকের মতো সংরক্ষণ করেন বিভিন্ন গরুর জাতের ইতিহাস। এই জ্ঞান কাজে আসে গবেষকদেরও।

নতুন উদ্যোক্তাদের আমিরুলের পরামর্শ

আমিরুল বলেন, আবেগের বশবর্তী হয়ে খামার করা যাবে না। খামার করতে হলে প্রাথমিক ধারণা তার থাকতে হবে। গরু কিনতে যাবার আগে ঘাসের প্লটটাকে নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে আমার কাছে মনে হয়, ওই খামারীকে আর কোনোদিন পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।

আমিরুলকে নিয়ে যা বললেন কৃষি কর্মকর্তা

আমিরুল ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নাজমুল হোসাইন বলেন, আমিরুল একজন আদর্শ খামারী। তিনি দীর্ঘদিন যাবত প্রাণী সম্পদ বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে বিভিন্নভাবে আমাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করে আসছি।

তিনি বলেন, তার খামারে গিয়ে দেখেছি তিনি খুব কম খরচে তার খামার তৈরি করেছেন। তিনি বাঁশ দিয়ে সাধারণ ঘর তৈরি করেছেন। অনেকেই আছেন যারা বিনিয়োগ করতে চান তারা প্রথমেই ঘরের পেছনে অনেক টাকা খরচ করে ফেলেন। পরে দেখা যায় পুঁজি হারিয়ে তার ব্যবসাটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা নতুন উদ্যোক্তা হবেন তাদের পরামর্শ দেবো, আমিরুলের খামারটি পরিদর্শন করে তার উদ্যোগ অনুসরণ করে দেখতে পারেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর