হাওর বার্তা ডেস্কঃ স্থানীয় কয়েকজন নারী-পুরুষ বাড়ির আঙিনায় বসে মেহগনির ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে তা গুঁড়ো করছেন। সেই গুড়ো প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে বিশেষ তেল প্রস্তুত করছেন তারা। এরপর সেই তেল স্প্রে মেশিনে পানির সঙ্গে মিশিয়ে ধানক্ষেতে কীটনাশকের বিকল্প হিসাবে ছিটিয়ে দিচ্ছেন।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কৃষি জমিতে পোকা ও ইঁদুর দমনে কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে মেহগনির তেল ব্যবহার করছেন স্থানীয় কৃষকরা।স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে এই তেল বেশ কাজ দিচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি এই কীটনাশক ব্যবহার করে সুফলও পাচ্ছেন তারা। এতে ক্ষেতের পোকা ও ইঁদুর দমনে একদিকে যেমন খরচ কমছে, অপর দিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষকরা।
প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে এমন কীটনাশক তৈরিতে কৃষকদের সহযোগিতা করছেন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তুষার কান্তি রায়। তিনি বলেন, ‘দেশে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে জৈব কীটনাশক ছাড়া উপায় নেই। সরকারের প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে এ উপজেলার কৃষকদের কীটনাশকের বিকল্প ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পরামর্শ অনুযায়ী তারা কাজও করছেন। ফলে ক্ষেতের পোকা দমনে একদিকে যেমন খরচ কমছে অপর দিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে কৃষক। পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করছে কৃষকরা।’
পুটিমারী ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের কৃষক আবদুল কাইয়ুম জানান, পোকামাকড়ের পাশাপাশি ইঁদুর ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে। তাই এবার প্রথমবারের মতো জমিতে মেহগনির তেল ছিটানোর পর ইঁদুর আক্রমণ করতে পারেনি। জমিতে কীটনাশক ছিটানোর সময় অনেক সর্তকতা অবলম্বন করতে হয়। ছিটানোর সময় নাক-মুখ ঢাকতে হয়। নইলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। মেহগনির তেল ব্যবহারে এসব সমস্যা হয় না। এছাড়া মেহগনির তেল ব্যবহারের কারণে এই খরচ কমে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর এখন সরকারিভাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে ফসলে কীভাবে কীটনাশকের বিকল্প ওষুধ ব্যবহার করা যায় সেজন্য আমাদের কৃষি দফতর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করছে। সেক্ষেত্রে এ ধরনের জৈব পদ্ধতি নিঃসন্দেহে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের একটি অনুষঙ্গ। ধীরে ধীরে কৃষকদের ওই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত করানোর চেষ্টা করা হবে।’
২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের এক পিএইচডি গবেষকের গবেষণার পর অতিরিক্ত চারটি ইঁদুর বেচে যায়। ইঁদুরগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য ল্যাব সহকারী সালাউদ্দীন মামুনকে দায়িত্ব দেন শিক্ষক। টিস্যু খুব দুর্বল হওয়ায় খোলা পরিবেশে টিকতে পারবে না মনে করে নিয়ে আসেন বাড়িতে। এখন সেই শখের বশে ইঁদুর চাষ করে সফল হচ্ছেন মামুন।
শখের বসে ইঁদুর পালন করতে গিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছেন তিনি। এসব ইঁদুর বিক্রি করে মাসে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছেন। দেশের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ইঁদুর ক্রয় করছেন গবেষণার জন্য। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ কিনছেন তাঁর চাষ করা ইঁদুর।
রাজশাহীর কাটাখালীর পৌর এলাকায় বাসিন্দা মামুন। ইঁদুর লালন পালন করার জন্য ছোট আকৃতির একটি কক্ষ পুরোটাই নেট দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন সালাহউদ্দিন মামুন। মেঝেতে বেশ কয়েকটি খাঁচা রয়েছে ইঁদুর পোষার জন্য। খাঁচার ওপর হার্ডবোর্ডের তৈরি ৮ থেকে ১০টি বাক্স, রয়েছে ইঁদুর।
সালাহউদ্দিন মামুন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, ২০১৭ সালে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের এক পিএইচডি গবেষকের গবেষণার পর অতিরিক্ত চারটি ইঁদুর বেচে যায়। তিনি সেই ইঁদুরগুলো ছেড়ে দিচ্ছিলেন। টিস্যু খুব দুর্বল হওয়ায় খোলা পরিবেশে টিকতে পারবে না মনে করে ইঁদুরগুলো আমি বাড়িতে নিয়ে আসি।তার মধ্যে দুইটি মা ইঁদুর ছিলো।এক মাস পর দুইটা মা ইঁদুর থেকে ২০ টা ইঁদুরের বাচ্চা পাওয়া যায়।এভাবে প্রায় প্রতিমাসে ইঁদুরের বাচ্চা দিতে লাগলো।সেই চারটা ইঁদুর থেকে ১০০০ পিস পর্যন্ত ইঁদুর হয়েছে ।
তিনি জানান, একটি মা ইঁদুর থেকে একবারে ৮ থেকে ১০টি বাচ্চা পাওয়া যায়। বছরে কমপক্ষে আট থেকে ১০টি বাচ্চা পাওয়া যায়। আমাদের আবহাওয়া ইঁদুর উৎপাদনের জন্য খুব অনুকূলে। এইজন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে মা ইঁদুর বেশি সংখ্যকবার বাচ্চা দেয়। ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যেখানে বছরে দুই থেকে তিনবার একটি মা ইঁদুর বাচ্চা দেয় সেখানে আমাদের দেশে আট থেকে ১০ বার বাচ্চা পাওয়া যায়।আবার লালনপালনের খরচও কম হওয়ায় খুব লাভজনক। একটা ইঁদুর দিনে চার থেকে পাঁচগ্রাম খাবার খায়।তবে বিক্রি করে বেশ লাভজনক। শখের বসে শুরু হওয়া খাবার থেকে আমি এ পর্যন্ত ৫ হাজার পিস ইঁদুর উৎপাদন করে বিক্রি করেছি দেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে।
সালাহউদ্দিন মামুন জানান, ইঁদুর লালন পালন শুরু করার এক মাস পর আমি প্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের মিউজিয়ামের রায়হান ভাইয়ের কাছে ২০ পিস ইঁদুর দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে ১০০০ টাকা দিয়েছিলেন। এর একমাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজিকে আরো ২০ পিস ইঁদুর দেওয়া হয়।এভাবে ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমেস্ট্রি, ফার্মেসী ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগে নিতে শুরু করলো।এছাড়া বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগও ইঁদুর নিতো।তখন প্রতি পিস ইঁদুর বিক্রি করেছি ৪০ টাকায়।বাচ্চা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে ইঁদুর বিক্রির উপযোগী হয়।
তবে করোনাভাইরাসের কারণে সব ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় প্রচুর ইঁদুর জমা হয়ে পড়েছিলো। প্রচুর ইঁদুর অবিক্রিত হয়ে পড়ে। গত অক্টোবর মাসেও আমার কাছে এক হাজার পিস ইঁদুর ছিলো।এর মধ্যে প্রতিটি ইঁদুর ৭০ টাকা হিসেবে ২৫০ পিস ও ১৫০ পিস করে ঢাকার দুইটি ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠান ক্রয় করে নিয়ে গেছে। ইঁদুর রাখার জায়গা ছোট হওয়ায় ৪০০ পিসের ওপর ইঁদুর বিড়ালকে দিয়ে খাইয়েছি। বর্তমানে আমার কাছে ১৫০ পিসের মতো ইঁদুর রয়েছে।তবে এখন ইঁদুরের বেশ চাহিদা তৈরি হয়েছে।দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি আমার কাছ থেকে ইঁদুর নেওয়ার জন্য ফোন করছে।এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ থেকেও অর্ডার পেয়েছি।
সালাহউদ্দিন মামুন জানান, ইঁদুর বিক্রি করে এখন প্রতি মাসে গড়ে ৫ হাজার টাকা আয় হয়। একটা বড় ঘর করে নেট দিয়ে পুরোটাই ঢেকে ১০০ পিস মা ইঁদুর আর ২০ পিস বাবা ইঁদুর রাখলে মাসে মাসে কয়েকগুণ আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব।কারণ ১০০ পিস মা ইঁদুর আর ২০ পিস বাবা ইঁদুর থেকে মাসে ৫০০ থেকে ১০০০ পিস ইঁদুর উৎপাদন করা সম্ভব। যা থেকে ৩৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা উপার্জন করা সম্ভব। আমার পরিকল্পনা এখন আরেকটি বড় ঘর করে সেখানে প্রতিমাসে ৫০০ থেকে ১০০০ ইঁদুর উৎপাদন করা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু রেজা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আমি কয়েক মাস পরপর তার কাছে থেকে ৫০টি করে ইঁদুর নিই। বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় তার কাছ নেওয়া ইঁদুরগুলো কাজে লাগে। যতবেশি অ্যাপ্লিকেশন তত বেশি ইঁদুরের প্রয়োজন হয়। কারণ গবেষণায় প্রয়োগ সরাসরি মানবকুলের ওপর করা যায় না। সেক্ষেত্রে ইঁদুর খুব কাজে লাগে। আর সুইস অ্যালবিনো ইঁদুর গবেষণার কাজেই ব্যবহার করা হয়।