হাওর বার্তা ডেস্কঃ কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও ভারতের আসাম রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। চার দিন ধরে পাহাড়ি ঢলে উপজেলার জিঞ্জিরাম, কালোর, কালজানি ও ধরণী নদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪৯ গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে ৫৯২ হেক্টর জমির ফসল ও ৫৭ কিলোমিটার কাঁচাপাকা সড়ক।
পানি ওঠায় ৩৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। নৌকা ও কলাগাছের ভেলা পারাপারের একমাত্র ভরসা এসব এলাকার মানুষের। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকট।
‘পানিত বেরবের পাই না। বেরালেই খরচ। কাজ কাম নাই। আয় উন্নতি বন্ধ। খুব সমস্যাত আছি।’ মনে কষ্ঠ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের খেয়ারচর গ্রামের দিনমজুর নজির হোসেন।
একই এলাকার বাতেন মিয়া জানান, পানি ভেঙ্গে ডিম নিয়ে খেয়ারচর হাটে বিক্রি করতে যাই। বৃষ্টির কারণে লোকজন হাটে নাই। বেলা চারটার মধ্যে হাট বন্ধ হয়ে গেছে। অবিক্রিত ডিম নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।
গত ৭ থেকে ৮দিন ধরে এই এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরাসরি ভারত থেকে নেমে এসেছে জিঞ্জিরাম, কালো ও ধরণী নদী। এই তিন নদীতে অস্বাভাবিক পানিবৃদ্ধি হওয়ায় কুড়িগ্রামের রৌমারী ও চর রাজীবপুর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে দেখা দিয়েছে আগাম বন্যা। রৌমারী টু ঢাকা সড়কের পূর্ব অংশে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করলেও পশ্চিম অংশে ব্রহ্মপুত্র, হলহলিয়া ও সোনাভরি নদী রয়েছে বন্যা সীমার অনেক নীচে। ফলে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বিচ্ছিন্ন এই দুই উপজেলার একটি অংশের মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে ভোগান্তি।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আশরাফুল আলম রাসেল জানান, ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে জিঞ্জিরাম, কালো ও ধরণী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে রৌমারী ও চর রাজীবপুর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পরেছে। বন্যায় তলিয়ে গেছে ৩০ কিলোমিটার কাচা-পাকা সড়ক। পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে ৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও ২৮৩ হেক্টর ফসল পানিতে নিমজ্জিত। এই পরিস্থিতিতে উপজেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ পাওয়া ৩ লাখ টাকা দিয়ে শুকনো খাবার হিসেবে চিড়া, মুড়ি, চিনি, লবণ ও মোমবাতী কেনা হচ্ছে। দ্রুতই বন্যা কবলিতদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
এদিকে, বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। এতে ডুবে যাওয়া রাস্তা-ঘাট জেগে উঠতে শুরু করেছে।
গতকাল দুপুরে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
গত সোমবার বিকেল থেকে সুনামগঞ্জ ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি ১৯ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সুনামগঞ্জ পৌর শহরে বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট থেকে পানি নেমেছে। যার ফলে জেলা শহরের সঙ্গে তাহিরপুরের যোগাযোগ সচল হয়েছে। নিম্নাঞ্চল থেকে পানি কমতে কিছুটা সময় লাগবে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরু ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, গত সোমবার বিকেল থেকে সুনামগঞ্জ ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে আবারও পানি বাড়বে।
বেলকুচি চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, উজানের ঢলে যমুনা নদীত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিলীন হল ঐতিহ্যবাহী তারকা মসজিদ সহ ৪০টি বসত বাড়ি, হুমকির মুখে রয়েছে বহু ঘরবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-তাঁতকারখানা
গতকাল সকালে সিরাজগঞ্জের এনায়তপুর থানা সদরের ব্রাহ্মনগ্রামে ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক মসজিদটিসহ বসত বাড়ি ভয়াবহ ভাঙ্গনে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। এছাড়া গত এক সপ্তাহে নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে প্রায় ৪০টি বসত ভিটা। চোখের সামনে নামাজের ঘর বিলীন হওয়ায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে এলাকাবাসি।
এলাকাবাসির অভিযোগ ভাঙন রোধে সংশ্লিষ্টরা সঠিক সময় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ভাঙ্গন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, গত সোমবার ভোর থেকে হঠাৎ করে যমুনা নদীত স্রোত ও ঘূর্ণ্যাবর্ত্যের সৃষ্টি হয়। দেখতে দেখতে নদীর পাড়ে শুরু হয় ভাঙন। বিলীন হয়ে যায় তারকা জামে মসজিদের পূর্বাংশের প্রধান ফটক, গতকাল তারকা মসজিদটির বারান্দাসহ প্রায় একতৃতীয়াংশ নদীগর্ভে চলে গেছে। এতে নদী পাড়ের মানুষ আতঙ্কে রয়েছে।
খুকনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুল্লুক চাঁদ মিয়া জানান, ব্রাহ্মনগ্রাম থেকে পাচিল পর্যন্ত নদীর তীর সংরক্ষণে সাড়ে ৬শ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন ও কাজ শুরু হয়েছে। তারপরও কেন এই ভাঙন। কাজর অগ্রগতি ও সঠিক তদারকির অভাবেই বারবার নদী পাড় ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে ক্ষতির শিকার হচ্ছে এলাকার তারকা মসজিদসহ ব্রাহ্মনগ্রামর প্রায় অর্ধশত বসত ভিটা। তিতাস (কুমিল্লা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাতাকান্দি বাজার-মোহনপুর লঞ্চঘাট সড়কের বারকাউনিয়া নামক স্থানে বর্ষার শুরুতেই চর কাঠালিয়া নদী শাখায় ভয়াবহ ভাঙ্গন শুরু হয়ে গেছে। নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে পাকা সড়ক, মসজিদ-মাদরাসা ও বসতবাড়ি। ভাঙ্গন রোধ না করলে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে বাতাকান্দি বাজার-মোহনপুর লঞ্চঘাট সড়কের বারকাউনিয়া অংশ। দ্রুত ভাঙ্গনরোধ করার জন্য জোর দাবি জানান এলাকাবাসী।
ইউপি চেয়ারম্যান মো. শামসুল হক সরকার জানান, আমি প্রায় পনেরো দিন আগে খবর পেয়ে সহকারী প্রকৌশলী জাহিদ হাসানকে নিয়ে এখানে পরিদর্শন করি তখন এতটা ভাঙন ছিলো না। আজ (গতকাল) এলাকাবাসী খবর দেয় বড় ধরনের ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে এবং যেকোনো সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
খেয়ারচর ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নজরুল ইসলাম জানান, আমার ওয়ার্ডের ৬ শতাধিক বাড়ীঘরে পানি উঠেছে। লোকজন কোথাও বের হতে পারছে না। এখন পর্যন্ত পানিবন্দী লোকজন কোন সরকারি সহযোগিতা পায় নাই।
এ ব্যাপারে রৌমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল্যøাহ জানান, জনপ্রতিনিধিদের বন্যা কবলিত এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে দুর্গতদের তালিকা করতে বলা হয়েছে। রৌমারী ল্যান্ড পোর্ট পানিবন্দী হওয়ায় এই পোর্টের সাথে জড়িত ৫ থেকে ৬ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। তাদের বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে। যাতে তারা সহযোগিতা পান।