হাওর বার্তা ডেস্কঃ একসময় যে ইউনিয়নজুড়ে দেখা যেত ধানখেত, এখন সেই ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামজুড়ে শুধুই চোখে পড়ে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। অভাব-অনটন দূরে ঠেলে এখানকার মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা হয়ে উঠেছে এই আম। যারা একসময় দিনমজুর ও শ্রমিকের কাজ করতেন, তারাও বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় হাঁড়িভাঙা আমগাছ লাগিয়েছেন। আম চাষ করে অনেকেই বদলে ফেলেছেন ভাগ্য।
দুই দশক আগেও হাঁড়িভাঙা আম নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না রংপুরের আমের রাজধানী বলা হয়ে থাকে মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ ইউনিয়নে। ছিল না এখানে বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ। সবাই ধান, তামাক, সবজি চাষ নিয়ে পড়ে থাকতেন। মিষ্টি, সুস্বাদু ও বিষমুক্ত হাঁড়িভাঙা আমের গল্প শুরু হয়েছিল এঁটেল মাটিখ্যাত ইউনিয়নের তেকানী গ্রাম থেকে।
আঁশহীন রসালো এ আমের চাষ যে অনেক বেশি লাভজনক, সেটি বুঝতে পারেন খোড়াগাছবাসী। একের পর এক আমচাষির সাফল্য দেখে একসময় যারা জমিতে ধানসহ অন্য ফসলনির্ভর চাষাবাদে মনোযোগী ছিলেন, তারাও হাঁড়িভাঙায় স্বপ্ন বুনতে থাকেন। লাভ বেশি হওয়ায় হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়ে ওঠে এখানকার মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন।
এভাবেই বছরের পর বছর খোড়াগাছের হাঁড়িভাঙা মিঠাপুকুরের অন্যান্য ইউনিয়নসহ ও বদরগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই আমের বাণিজ্যিক চাহিদা বাড়তে থাকায় রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে এর ফলন বিস্তৃত হয়েছে। জেলার বাইরে নীলফামারীর সদর, সৈয়দপুর; দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা ও চিরিরবন্দর এলাকায়ও চাষ হচ্ছে হাঁড়িভাঙার।
ঐতিহ্যবাহী হাঁড়িভাঙা আমের উৎপত্তি সন্ধান করতে চেষ্টা করেছে। শোনা গেছে মাতৃগাছটি এখনো বেঁচে আছে। যে গাছ থেকে হাজার হাজার চারাগাছ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রংপুর অঞ্চলে।
সরেজমিনে মিঠাপুকুর উপজেলায় খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানী গ্রামে গেলে দেখা মেলে গাছটির। ৭২ বছর আগে রোপণ করা সেই মাতৃগাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। ডালপালা বিস্তার করেছে চারদিকে। গাছটির গোঁড়াও পাঁজা করে ধরতে প্রয়োজন হবে দুজন। গাছের ডাল-পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে আম। তবে গাছ পুরোনো হওয়ায় আম ছোট ছোট। তবু এ গাছ থেকে বছরে অন্তত ৮ থেকে ১২ মণ আম পাওয়া যায়। এ গাছ থেকেই হাঁড়িভাঙা জাতের আম ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। তবে নতুন নতুন গাছের ভিড়ে আলোচনায় না থাকলেও এ মাতৃগাছটি এখনো ফল দিয়ে যাচ্ছে অগোচরে।
হাঁড়িভাঙা আমের নাম অবশ্য শুরুতে হাঁড়িভাঙা ছিল না। এ আমের আবিষ্কারক হিসেবে স্থানীয়ভাবে নফল উদ্দিন পাইকারকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন এক বৃক্ষপ্রেমিক। তার হাত ধরেই তেকানী গ্রামে হাঁড়িভাঙার গোড়াপত্তন। যদিও এর আদি নাম মালদিয়া।
বৃক্ষপ্রেমী নফল উদ্দিন পাইকার বেঁচে নেই। আছে তার শক্ত মাটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সুমিষ্ট হাঁড়িভাঙার খ্যাতি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার ছেলে আমজাদ হোসেন পাইকারের। মাতৃগাছটির আদ্যোপান্ত জানতে আমময় আড্ডায় তার কাছ থেকে হাঁড়িভাঙা নামকরণ, সম্ভাবনা, সংকট, সমস্যা ও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের (জিআই) স্বীকৃতি প্রসঙ্গে কথা হয়। গল্প আড্ডায়
তিনি শুনিয়েছেন ভালো মানের হাঁড়িভাঙা আম চেনার উপায়।
আমজাদ হোসেন পাইকার জানান, সম্ভবত ১৯৪৯ সাল। রংপুরের মিঠাপুকুরের বালুয়া মাসুমপুর গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেই এলাকার একটি জমি থেকে দুটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তার বাবা। তবে একটি গাছ চুরি হয়ে যায়। বাকি গাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে পানি (ফিল্টার সিস্টেমে) দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে।যে গাছ থেকে হাজার হাজার চারাগাছ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রংপুর অঞ্চলে
তিনি বলেন, গাছটিতে একসময় বিপুল পরিমাণ আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম সম্পর্কে জানতে চায়। তখন থেকেই গাছটির আম হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়। এখন হাঁড়িভাঙা আমের সুনাম মানুষের মুখে মুখে। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাগান। আমচাষি, বাগানি, ব্যবসায়ী— সবাই দিন দিন লাভবান হচ্ছেন। মাতৃগাছ থেকে কলম করা অনেক চারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশে বেড়েছে হাঁড়িভাঙার কদর।
হাঁড়িভাঙা আম ঘিরে প্রতিবছর শত কোটির টাকা ব্যবসা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এই আম আমাদের এলাকার চিত্র পাল্টে দিয়েছে। মৌসুমি ফল হলেও পুরো রংপুর অঞ্চলে হাজারো মানুষ এই আম ঘিরে লাভবান হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সম্পদ। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এই আমের সংরক্ষণে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই এলাকার হাটবাজারের উন্নয়ন ও যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। বিশেষ করে হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণে হিমাগারের খুবই প্রয়োজন।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে হাঁড়িভাঙার স্বীকৃতি নিয়ে দোটানা অবস্থার কারণে আমজাদ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। হঠাৎ রংপুরের হাঁড়িভাঙার জন্ম বা উৎপত্তিস্থল নিয়ে অন্য জেলার লুকোচুরিতে এখানকার ঐতিহ্য ও সুনাম ছিনতাইয়ের আশঙ্কা তার।
আমজাদের দাবি, খোড়াগাছের তেকানী গ্রাম থেকে হাঁড়িভাঙার যাত্রা শুরু। জিআই পণ্যের স্বীকৃতি বা নিবন্ধন পেলে অবশ্যই রংপুর পাবে। কিন্তু এখন হাঁড়িভাঙাকে নিজেদের দাবি করে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি চাইছে জয়পুরহাট জেলা। এটা অন্যায়, অযৌক্তিক। প্রতিটি পণ্যের ব্র্যান্ড আছে বা নিজস্ব নাম আছে। হাঁড়িভাঙা আম রংপুরের ব্র্যান্ড, এটা এখানকার সম্পদ। কিন্তু রংপুরকে বাদ দিয়ে যদি অন্য জেলাকে হাঁড়িভাঙার জন্য জিআই স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তা সঠিক হবে না। সরকারের কাছে দাবি, জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিতে হলে রংপুরকে দেওয়া হোক। ২০১৭ সালে আবেদন করার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না।
এই আমের সংরক্ষণ ও বেশি দিন রেখে খাওয়ার উপযোগী করতে কৃষি বিভাগসহ সরকার প্রধানের সুদৃষ্টি কামনা করে তিনি বলেন, যাদের কিছুই নেই, ভিক্ষা করে সংসার চালায়, তারাও এই মৌসুমে আম কুড়িয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি করে। হাঁড়িভাঙা গাছ থেকে নামানোর পর এক সপ্তাহের বেশি রাখা যায় না। সমস্যা হলো এটা বেশি পাকলে খাওয়া যায় না, দ্রুত নষ্ট হয়। এই আম কীভাবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়, সে বিষয়ে কৃষি বিভাগের সহযোগিতা ও গবেষণা খুব বেশি প্রয়োজন। এই আমের স্থায়িত্ব বাড়লে চাষি ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। তখন বিদেশে রপ্তানি করাটা আরও সহজ হবে।
কম ফলনের জন্য শুধু কীটনাশকই নয়, প্রকৃতির কাছেও অসহায় হাজারো আমচাষি। এ মৌসুমে গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল। কিন্তু ঘন ঘন বৃষ্টি আর প্রথম দফার ঘূর্ণিঝড়ে মুকুলগুলো ঝরে যায়। দ্বিতীয় দফায় আবারও ঘূর্ণিঝড় ও শিলাবৃষ্টির কারণে গুটি আমেরও একটি অংশ ঝরে যায়। সব মিলিয়ে এবার ফলন কম হয়েছে। তবে এই আমের বিপণন ও সংরক্ষণব্যবস্থা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন চাষিরা। হাঁড়িভাঙা আমের হাটখ্যাত মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জে রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় দূর-দূরান্তের ক্রেতাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তিন দশকের বেশি সময় ধরে।
আমজাদ হোসেন বলেন, আমের উৎপাদন বা ফলন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ গাছের গোড়ায় হরমোন ব্যবহার। মৌসুমের শুরুতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী আমবাগান চুক্তিতে কিনে নেন। পরে তারা পরিচর্যা করতে গিয়ে বেশি উৎপাদন ও লাভের আশায় হরমোন ব্যবহার করছেন। এতে কয়েক বছর ফলন ভালো হলেও দিনে দিনে বাগানমালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সঙ্গে আগের মতো আশানুরূপ ফলন মিলছে না। এই আমের জন্য কীটনাশক ও হরমোন ব্যবহার করা ঠিক না।
ভালো মানের হাঁড়িভাঙা আম চেনার উপায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের ওপরটা যত কালচে, ভেতরে ততই সুন্দর। এর স্বাদ ও মিষ্টি লোভনীয়। দেখতে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন আমে কীটনাশক ও স্প্রে ব্যবহার বাগান কিনে নেওয়া ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভের জন্য করে থাকেন। এতে আম দেখতে ভালো, সুন্দর ও পাকা রঙের মনে হয়।
হাঁড়িভাঙা আমের বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। এই আমের আঁটিও খুব ছোট। ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙা আকারভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে। গত এক দশকে দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা বেড়েছে হাঁড়িভাঙার। সঙ্গে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশেও রপ্তানির সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে।
হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারক অনেকেই আছেন। তাদের মধ্যে লুৎফর রহমান ও আবদুস সালাম সরকারের রয়েছে আলাদা পরিচিতি। তারা ১৯৯০ সালের পর থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙা আম চাষ শুরু করেন। এখন রংপুর জেলার বিস্তৃতি ছেড়ে হাঁড়িভাঙা নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দর এলাকায়ও চাষ হচ্ছে হাঁড়িভাঙা।
বুধবার (১৫ জুন) থেকে বাজারে পাওয়া যাবে রংপুরের সুস্বাদু আম ‘হাঁড়িভাঙা’। সারা দেশে জনপ্রিয়তার তালিকায় থাকা এই আমগাছ থেকে পাড়ার পর শুরু হবে বাজারজাত। বৈশাখী ঝড়বৃষ্টি আর গেল দুই সপ্তাহের ঝড়-বাতাসে আমের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। এবার জেলায় ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে শুধু হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করে এ বছর ১৫০ কোটি টাকার ওপরে ব্যবসা করতে পারবেন আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা।