হালগিরিস্থ সবি আছিল, নদী সব নিয়ে গ্যাছে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আব্দুল মালেক, ৬২ বছরের এই বৃদ্ধ একে একে ১১বার আগ্রাসী তিস্তা নদীর ভাঙনের শিকার হয়েছেন। শেষ জীবনে এসে বড্ড ক্লান্ত তিনি। বাকি জীবনটা পৈতৃক ভিটায় কাটাতে চান। কিন্ত সেই সুখ বেশিদিন সয়নি।

গত শনিবার করাল গ্রাসী তিস্তার ভাঙনে শেষ আশ্রয়স্থল বসতভিটাটুকু নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

শুধু আব্দুল মালেকেই নন গত দেড়মাসের ব্যবধানে সাদুয়াদামার হাট ও সাতালস্কর গ্রামের প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তিস্তা নদীর ভাঙনে প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার বাস্তুহারা হয়েছেন। কয়েক শ হেক্টর ফসলি জমি, বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা নদীতে চলে গেছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি এলজিইডি নির্মিত কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ের একটি কাঁচা রাস্তার অর্ধেক ভাঙনে বিলীন হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি বৈদ্যুতিক খুঁটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আরো অন্তত ১২টি খুঁটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো তাদের স্বজনদের মায়া ত্যাগ বিভিন্ন এলাকায় বসতি গড়েছেন। অনেকে নিরুপায় হয়ে ভাঙনকবলিত এলাকার পাশেই ভাঙা ঘরবাড়ি নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ মানবেতর জীপন যাপন করছেন।

শনিবার জেলার উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়নের সাদুয়াদামার হাট ও সাতালস্কর এলাকায় গিয়ে এ দৃশ্য দেখা গেছে।

সরেজমিনে সাতালস্কর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আব্দুল মালেকের বসতভিটার বেশির ভাগ অংশই নদীগর্ভে চলে গেছে। বাকিটুকুও যেকোনো সময় নদীতে চলে যাবে। কিন্ত এতকিছুর পরও মায়া ছাড়তে পারেননি। স্ত্রী শরীফা বেগমকে নিয়ে অবশিষ্ট ভিটায় বসে নদীর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন এই দম্পতি।

আব্দুল মালেক বলেন, ‘যখনই বাড়ি আন্ধার হয় (গাছগাছালি দিয়ে চারিদিকে বাড়ি ঢেকে যায়), তখনি নদী আসি হানা দেয়। এইদন করি ১১বার নদী ভাঙি হামার সউক শ্যাষ করি দিছে। শ্যাষ সম্বল প্রায় ৪৫ শতক জমিত, কোন রকমে একপাশে বাড়ি করি, বাকি কোনাত আবাদ করি খাং। সেকনাও এবার নদীত গেলো। ‘

মালেকের স্ত্রী শরীফা বলেন, ‘নদী ঘরবাড়ির সরবারও সমায় দেয় না। বাড়ির মেলা মালামাল নদীত চলি গেইছে। নদীত পানি কম, নৌকা আটকে যায়, তাই মালামাল ওপারে যাবার পাচ্ছিনে। ‘ পেটে ক্ষুদা থাকলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়েছেন তিনি।

ভাঙনের শিকার হাজিরুদ্দিন (৭০) বলেন, ‘হালগিরিস্থ সবি আছিল। নদী সব নিয়ে গেছে। নদীর এপার ভাঙলে, ওপারত যাই। এইদন করি তের বার বাড়ি ভাঙা পচ্ছে। ‘

সাদুয়াদামার হাটের গোলজার হোসেন (৭০) বলেন, ‘নদীত তেমন পানি না বাড়লেও, গত বৈশেখ মাস থাকি নদী ভাঙা শুরু হইছে। নদী একনা দুরত আছিল, দেইখতে দেইখতে হামারগুলের বাড়ি ভাঙি গেইল। ‘

স্থানীয়রা জানান, গত দুই দিনে এ এলাকায় প্রায় শতাধিক বসতভিটা নদীতে চলে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার ভয়াবহ ভাঙন চলে আসলেও, পাউবো কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেননি। এমনকি তাদের কাউকে চোখে পড়েনি। ভাঙনরোধে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অব্যাহত ভাঙনে কয়েক কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, পুরনো বজরা বাজারসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

বজরা কাশিমবাজার পল্লী বিদ্যুৎ অভিযোগ কেন্দ্রের ইনচার্জ আশরাফুল আল আমিন বলেন, ‘গত বছর এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। নদী ভাঙনের ফলে এক বছরের মাথায় তা বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আমরা ৭টি খুঁটি তুলে ফেলেছি। আরো ১২টি খুঁটি চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে, সে সবও সরিয়ে নিতে হবে। ‘ এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে দায়সারা বক্তব্য দেন কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ‘ভাঙন যেহেতু বেশি হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমরা দেখে কাজ শুরু করব। ‘

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর