জয়ার মুখে স্বামীর গল্প, সুরঞ্জিতের শরীর একদম ভাল নেই

ঢাকার জিগাতলার ৪৬/৩ নম্বর বাড়িটির কোথাও নামফলক নেই। কিন্তু বড় রাস্তা থেকে সবাই জানে ওই বাড়িটি। বাড়িটি আর কারও নয় বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদ, অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, আওযামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের। ষাটের উত্তাল ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা এই বামপন্থী নেতা বরাবর স্পষ্টভাষী উচ্চারণে জাতীয় রাজনীতিতে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আলোচিত হয়েছেন ৫০ বছর ধরে। ৭০ সালে নৌকার গণজোয়ারের বিপরীতিতে ভাটির হাত্তরের জলরাশির ঢেউ বুকে নিয়ে কুড়ে ঘরের প্রতীকে ন্যাপ থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরেছেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ন্যাপ, একতা, গণতন্ত্রী পার্টি সর্বশেষ ৯৪ সাল থেকে আওয়ামীলীগ। বোমা হামলার শিকার হওয়া, সামরকি জামানায় জেলখাটা এই নেতা ৭০ সালে বিজয়ী হয়ে ৭১ সালে সাবসক্টের কমাণ্ডার হিসাবে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করছেনে। একজন তুখোর পার্লামেন্টারিয়ান, একজন বাগ্মি পুরুষ হসিাবে রাজনীতিতে জায়গা করা মানুষটি বড় বেশি পড়াশোনা জানা। ইংরেজি, বাংলায় বলতে যেমন জুড়ি নেই তেমনি রয়েছে প্রখর হিউমারসেন্স আর সাহত্যিরে রসবোধ।

ব্যাপক পড়াশোনা জানা এই প্রবীন পার্লামেন্টারিয়ানের শরীর এখন একদম ভাল নেই। দীর্ঘদেহী মানুষটির শরীর ভেঙে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে এখন তিনি ঢাকায়। মাঝে-মধ্যে হাসপাতালে না হয় বাড়ির শয্যায় কাটে তার সময়। তবু মুখের মাস্ক খুলে সংসদে চলে আসনে। তবু রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। চুপ হয়ে থাকেন না। রাজনীতিতে তার মতো স্টাইলিশ পার্লামেন্টরিয়ান সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক কিংবদন্তি।

নিরাপত্তা কর্মীকে পরিচয় দিতেই সদর গেইট খুলে দিল। এগিয়ে এলেন একজন। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত’র সাথে দেখা করতে চাই। আসছে ৫ মে তাঁর জন্মদিন। ওইদিনকে উপলক্ষ করে সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা বলায় মনে হয় বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হলো। তাঁর অফিস ঘরে নিয়ে বসানো হলো।

বেশ বোঝা যাচ্ছে এই অফিস ঘরে এখন আর নিয়মিত তিনি বসেন না। চেয়ারে টেবিলে হালকা ধুলোর আস্তর। বেশ কয়েকটি ক্রেস্ট টেবিলের ওপর এখানে ওখানে। এরই মধ্যে একজন বলল স্যার সংসদে চলে গেছেন। অন্য একদিন আসতে হবে। কিন্তু উনি তো অসুস্থ। বাসায় থাকবার কথা। শুনে এসবি জয়নাল জানালো, উনি বেশ অসুস্থ কিন্তু আজ বিশেষ কারণে তাঁকে সংসদে যেতে হয়েছে।

প্রায় সাথে সাথেই একজন ভিষন সাদামাটা, একেবারে আটপৌরে ভঙ্গিতে এসে দরজায় দাঁড়ালেন। চেহারায় আভিজাত্য। একসময় অনিন্দ সুন্দরী ছিলেন বলে দিতে হবে না কাউকে।

নমস্কার জানিয়ে বল্লাম সুরঞ্জিত দা তো অসুস্থ, উনি কেমন আছেন এবং সেই সাথে আসছে মে মাসের ৫ তারিখ দাদা’র জন্মদিন। ওনার ব্যাপারে জানতে চাই।
একথা শুনে শব্দ করে হেঁসে উঠলেন যিনি তিনি আর কেউ নন মিসেস সুরঞ্জিত, মানে জয়া সেন গুপ্ত।
বললেন, ৫ তারিখে দাদা’র জন্মদিন কে বলল? নেট থেকে পাওয়া । দাদা’র প্রোফাইলে দেয়া আছে ৫/৫/১৯৪৫ (শনিবার)।
ওহ্। হ্যাঁ ওঁর পাসপোর্টেও এ দিনটি দেয়া আছে। এক অর্থে ঠিকই আছে। কিন্তু ওর আসল জন্মদিন ৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী। আসলে কি জানো তো ওর জন্মের আগে বাবা, আর জন্মের অল্পদিনের মধ্যে মা মারা যান। এমন কেউ ছিল না যে সঠিকভাবে স্কুলের রেজিষ্ট্রারে বয়সের তারিখটা লিখে দিয়ে আসবে। কে কখন, কোথায় লিখে দিয়েছে সেই থেকে কাগজে কলমে ওই ৫/৫/১৯৪৫। ভাগ্যিস ওর কুষ্টিটি যত্ন করে রাখা ছিল। তাই ওর আসল জন্মদিনটা আমরা জানি।
কথা বলতে বলতে বসার ঘরে নিয়ে বসান।

পরিচয় পর্ব শেষে বললাম দাদা যেহেতু নেই আপনি দাদা সম্বন্ধে বলেন। (আবার হাসি)আমি বলবো! তোমার দাদা শুনতে পেলে আমারে দেবেনে।
কি জানতে চাও।
বলেন, দাদা কেমন আছেন? ওনার শরীরের অবস্থা, চিকিৎসক কি পরামর্শ দিয়েছেন?
-হ্যাঁ এটুকু বলতে পারি।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রথম এরপর মার্চ মাসে ভিষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর আগে অবশ্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। মূলত: সেখানকার চিকিৎসারই ফলোআপ হচ্ছে এখানে।

তাঁর বোন ম্যারোর চিকিৎসার জন্য হরমোনাল ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছিল। এখন এই ইন্জেকশন নিতে পারছেন না। তাঁর শরীরে হেমোগ্লোবিন উৎপাদন হচ্ছে না। এই মূহূর্তে এরই চিকিৎসা করছেন। জেনে খুশী হবে য়ে তার শারীরিক অবস্থা আজকে আগের চেয়ে বেশ ভালো। কিন্তু সুস্থ বলা যাবে না।
ভীষণ দূর্বল। একা একা চলতে পারেন না। খেতে পারেন না। যেকোনো সময় মাস্ক লাগাতে হচ্ছে। বেশী সময় বিছানায় থাকছেন। তারপরও আশার কথা তিনি সেরে উঠছেন।
খুব ভালো লাগলো দাদা সেরে উঠছেন।
আমরা একটু আলাদা কথায় আসি। আপনাদের বিয়ের কথা বলেন।
-এ বাবা সে সময়ের কথা তো অনেক পুরনো। বাংলাদেশের মতোই বয়স হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের।
-মানে?
মানে হলো ১৯৭২ সালের ৬ মার্চ আমাদের বিয়ে হয়। সে সময় দেশের অবস্থা যেমন ছিল আমাদেরও তেমনি।
আপনারা বিয়ে বার্ষিকী পালন করেন? বিয়ে বার্ষিকীর কথা দাদার মনে থাকে?
একদম না। ওর দেশের লাখো মানুষের কথা মনে থাকে নাম মনে থাকে। শুধু বিয়ের দিনটা ছাড়া। বিয়ের দিন তো দুরে ও তো যেদিন বিয়ে করতে যাবে সেদিনটাও ভুলে গিয়েছিল।
একটু খুলে বলবেন কি?

আমাদের বিয়ের দিন ৬ মার্চ ঠিক করা হয়। ও(সুরঞ্জিত) তখন ঢাকায়। ওদের বাসা থেকে ফোন করা হলো কবে আসবে, ও (সুরঞ্জিত)বলে কি ৯ মার্চ যাবো বিয়ে তো ১০ তারিখ। একথা শুনে তো সবার আক্কেল গুড়ুম। ভাগ্যিস যে ওইদিন ফোন করা হয়েছিল(হাসি)তানা হলে যে কি হতো।
বিয়েটা কি অভিভাবকদের মতে নাকি নিজেদের বোঝাপড়ায় হয়েছে?
– আমার দাদা ড. বাউল দাসের বন্ধু ছিলেন উনি (সুরঞ্জিত)। সেই সুবাদে বাড়িতে যাতায়াত। ব্যস ভালো লেগে গেল। কি দেখে ভালো লেগেছিল (একটু ভেবে)ওঁর ব্যক্তিত্ব্য আর অনর্গল চমৎকার কথা বলতেন বাংলা-ইংরেজীতে। বাবা বিয়ে দিতে চাননি। আমার চট করে কাউকে ভালো লাগতো না। তাই ভালোলাগার কথা যখন বলেছি বাবা ধরেই নিয়েছিলেন এই বিয়েটা দিতে হবে। ব্যস।
বিয়ের পর কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন মানে যাকে আমরা হানিমুন বলি।
হ্যাঁ বিয়ের পর দিদির বাড়িতে যাবো বলে কলকাতা থেকে গোহাটি যাওয়ার পথে ২ দিন দার্জিলিং এ ছিলাম। এ দুদিনকে যদি বলো তবে হানিমুন বললে বলা যেতে পারে।

একজন জয়া সেন গুপ্তা কি সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত’র মাঝে হারিয়ে ফেলেছেন এমন কথায় যেন একটু ভাবলেন। মনে হলো যেন মুখের হাসিটি একটু মিলিয়ে গেল।
বলেন, সত্যি করে বল তো আমরা সবাই কি মিলিয়ে যাই না। এক সময় গান করতাম এখন করি না। একজন নেতার স্ত্রী গান করবে। তোমার দাদার ভালো লাগল না। ছেড়ে দিলাম। আমাদের ঘরে ঘরে এমন হাজারো ঘটনা আছে। আমারা আসলে মিলিয়ে যাই। কখনো পছন্দ করি মিলিয়ে যেতে।

অবস্থাপন্ন শ্বশুর বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দিককার কষ্টের কথা প্রায় মনে পড়ে। তিনি বলেন, আমরা যখন ঢাকায় আসি আমাদের থাকবার জায়গা ছিল না। দু:সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় ৬ মাস থাকি। প্রথম এসিটাও উনি কিনে দেন। সেসময় টাকার জন্য রেডিওতে কথিকা পড়তাম- টাকা পেতাম ভালো লাগতো। কিন্তু পরবর্তিতে বন্ধ করতে হলো, আমাকে তো টিভিতে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। ওই যে মিলিয়ে দেয়া।
বিয়ের আগে থেকে চাকরী করেন। প্রথম কাজ শুরু করেন ফরিদপুরে কে এম কলেজে প্রভাষক হিসেবে। এরপর প্রায় ৫ বছর গ্রীন হেরাল্ড, গ্রীন জেমস, ইসলামিক মহাবিদ্যালয়ে চাকরী করেছেন।

পিএইচডি করবার জন্য চাকরী ছেড়ে দিতে হয়। সময়টা ১৯৮২ সাল। রাজনৈতিক কারণে সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে যেতে হয় জেলে। এসময়টা তিনি একা হয়ে পড়েন। ৬ বছরের ছেলে সৌমেন সেন গুপ্তকে নিয়ে কোথায় যাবেন কি করবেন দিশাহারা না হয়ে চাকরী খোঁজেন।কিন্তু সে সময় তাকে একটা কাজ দিতে সবাই যেন ভয় পাচ্ছিল।

এমন পরিস্থিতিতে জয়া সেন গুপ্ত চলে যান ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা আবেদ খানের কাছে। বলেন, ভয় না পেলে আমাকে একটা চাকরী দেন। ব্যস, চাকরী শুরু করেন শিক্ষা বিভাগে। এরপর নিরবচ্ছিন্নভাবে চাকরী করে আসছিলেন। গত ২৫ জুন চাকরী ছেড়ে দেন স্বামীর অসুস্থতার কারণে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে।
-চাকরি ছেড়ে দিয়ে কেমন আছেন?
প্রথম দু,চারদিন ভালোই ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে পেটে ভাতে আয়া। চাকরী ছেড়ে আসাটা মোটেই সুখের নয়। খুব খারাপ লাগে। একটা জানালা খোলা রাখা খুব দরকার। তোমাকে চুপি চুপি বলি তোমার দাদা সুস্থ হলেই আমি আবারো চাকরীতে যাবো। মেয়েদের জন্য চাকরিটা খুবই জরুরী।
– আবার দাদার কথায় আসি। দাদা বাজার করেন?
বাজার করতে পছন্দ করেন। তবে তাকে বাজার করতে দেয়া রিস্কি। যাই সামনে দেখে তাই কিনে আনে।
– দাদার বিষয়ে এমন কিছু বলেন যা আমরা জানিনা।
বিয়ের পর থেকে একটা শাড়ীও আমি কিনি নাই। সব ’ও’ কিনে আনে। কারো দেয়া শাড়ী পড়লে বলে ’কি পরছো ভুতের মতো লাগে’। আর একটা বিষয় কেউ খুব একটা জানেনা, সেটা হলো উনি অভিনয় ও আবৃত্তিতে বেশ ভালো।
– শেষ কবে দাদার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলেন?
চার বছর আগে জাপানে ।
– এতোগুলো বছর একসঙ্গে, কেমন আছেন?
কেমন আছি, কিছু মেনে নিয়ে কিছু মনে নিয়ে চলছে। আসলে কি জানোতো বয়সের সাথে সাথে ভালোবাসা আর ওভাবে থাকে না, দায়িত্ব বেড়ে যায়। এখন দায়িত্ব নিয়ে চলছি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো একটা সময় স্বামী স্ত্রী ছাড়া আর কেউ কাছে থাকে না। না ছেলে না মেয়ে। আমি আর তুমি ছাড়া কেউ নেই। তাই আছি।

রাজনীতি নিয়ে ভাবেন না তবে এর সবটুকু ভাল-মন্দ নিয়ে তাকে চলতে হয়। রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা নেই। সুরঞ্জিত সেনের যে জিনিসটা তাকে ভালো লাগে তাহলো সুরঞ্জিত এর মানুষের জন্য ভালোবাসা। আর খারাপ লাগা আছে বেশ কিছু তার মাধ্যে খোঁচা দিয়ে কথা বলা।

তুখোড় রাজনীতি্বিদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে আমরা সবাই জানি। কিন্তু তাঁর পাশ থেকে একজন নীরবে নিভৃতে তাঁর ভালোলাগাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিনিয়ত যিনি সাহস ও সমর্থন জুগিয়ে আসছেন তিনি হলেন তাঁর স্ত্রী জয়া সেন গুপ্তা।

১০কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়িটির জৌলুস বলতে এই মানুষগুলো। ছেলে, ছেলের বউ আর দুই নাতি শুভজিত-সুদীপ্তা। একজন ডাকসাইটে জাঁদরেল রাজনীতিবিদের স্ত্রী হওয়ার অহংকার নেই বিন্দু মাত্র, যা আছে তা শুধুই ভদ্রতা আর বিনয়। কিন্তু কোথায় যেন একটা ছন্দ পতনের সুর।

নিজেকে একা রাখা হয়না কিন্তু ফাঁক পেলেই একা একা ভায়োলিন বাজাতে পছন্দ করেন ।

স্ত্রীকে জয়া বলেই ডাকেন সুরঞ্জিত দা, কিন্তু দাদাকে বৌদি যে নামে ডাকেন তা বলতে বারণ আছে।

দাদাকে যে কথাটি বলা হয়নি কখনোই তা হলো, ‘ভালোবাসি’।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর