ঢাকা ০৬:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম

ধান কাটা নিয়ে বিপাকে কৃষক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৫৩:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ মে ২০২২
  • ১১২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে বিরূপ আবহাওয়া বিরাজ করছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলায় ভারি থেকে অতিভারি না হয় মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এ ছাড়া উজানের দেশ ভারতের বিভিন্ন জেলায় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। তিস্তা যমুনার পানি বেড়ে চরাঞ্চলের জমির বোরো ধান ও অন্যান্য ফসল তলিয়ে গেছে। অন্যদিকে সুরমা-কুশিয়ারা এসব নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওর এলাকার পাঁচটি জেলায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন বৈরী আবহাওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধানের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ঝড়ো বাতাসে পাকা ধান জমিতে নুইয়ে পড়েছে। এসব ধানে চারা গজাচ্ছে। অশনির প্রভাব কেটে গিয়ে রোদের দেখা মিললেও শ্রমিক সঙ্কটের কারণে কৃষক ধান কাটতে পারছে না। ১ হাজার থেকে ১১০০ টাকা অর্থাৎ দেড় মণ ধানের দামেও মিলছে না একজন ধান কাটার শ্রমিক। চাহিদা বেশি থাকায় কলের মেশিন হারভেস্টারও পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় জমির ধান কেটে ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটছে কৃষকদের।

প্রতি বছরই দেশে বোরো মৌসুমের ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক না থাকার কারণে তাদের মজুরিও বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একদিনে ১ হাজার থেকে ১১০০ টাকায়ও শ্রমিক মিলছে না। অথচ বর্তমানে ধান কেটে বাজারে ৬শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। সে হিসাবে দেড়মণ ধানের দামেও ১ জন শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি মজুরিতে শ্রমিক নিয়ে লোকসানে পড়ছেন কৃষক।
সারাদেশে বর্তমানে বিআর ২৯ জাতের ধান পুরোপুরি পাকা অবস্থায় আছে। চলতি মৌসুমে বোরোর আবাদও ভালো হয়েছে। কিন্তু ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে ১১ মে থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাই যে সব এলাকায় জমিতে পানি জমেছে সেখানে পাকা ধান জমিতেই নষ্ট হচ্ছে।
নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার শুনই গ্রামের কৃষক মজিবর মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিদিন কামলা (ধান কাটার শ্রমিক) খুইজ্যা পাই না। ক্ষেতের প্রায় অর্ধেক ধান কামলারে দিলেও কেউ আসে না। পানিতে ডুইব্যা ক্ষেতের ধান নষ্ট অইতাছে, কিন্তু কিছুই করতে পারতাছি না।
বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর এলাকার কৃষক মমিন আলী বলেন, ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু এ বছর একজন ধান কাটা শ্রমিককে প্রতিদিনের মজুরি দিতে হচ্ছে ১ হাজার টাকা। তারপরও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি মণ মোটা ধানের দাম ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। এমন অবস্থায় ধান চাষ করে লোকসান ছাড়া আর কি।
বোরো মৌসুমে প্রতি বছরই বাগেরহাটে শ্রমিকের খুবই সঙ্কট দেখা দেয়। পার্শ্ববর্তী নড়াইল, যশোর, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক এসে কাজ করেন। বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী ‘মানুষ বেচা-কেনার হাট’ ফকিরহাট ও যাত্রাপুর থেকে এসব শ্রমিক আনা হয়। এসব শ্রমিক আনা থেকে শুরু করে সব খরচ কৃষককেই বহন করতে হয়। কিন্তু এবার ওই সব এলাকা থেকে আগের মত শ্রমিক আসেনি। এতে শ্রমিক সঙ্কট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
জয়পুরহাটের বদলগাছির কৃষক আলাল বলেন, প্রতিজন শ্রমিক ১১শ’ টাকা দিনমজুরি চায়। তাদের দিয়ে এক বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করে ঘরে নিতে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হবে। মেশিনের সুবিধা পেলে সে খরচ অর্ধেক হতে। মেশিনে কাটালে সময়ও কম লাগে এবং খরচ মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা বিঘা। মেশিনে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের খরচ কম। অথচ মেশিনও পর্যাপ্ত নেই। পনের দিন আগে থেকে বলেও মেশিন পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ একর জমির ধান কাটতে হয়। এ বিশাল পরিমাণে জমির ধান কাটতে যত সংখ্যক শ্রমিক প্রয়োজন তার অনুপাতে ৪০ শতাংশ কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। সে চাহিদা পূরণে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ধান কাটার যন্ত্রের প্রয়োজন সেটার মাত্র পাঁচ শতাংশ রয়েছে দেশের কৃষকদের কাছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা বলছেন, বোরো মৌসুমের সব ধান কাটতে দেশে অন্তত ২০ হাজার হারভেস্টার যন্ত্র প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে হার্ভেস্টিং ও রিপিং মেশিন মিলিয়ে চার হাজারের মতো যন্ত্র সচল আছে।
অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ধান আবাদে সবচেয়ে বেশি আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। তবে জমি চাষ ও সেচে ৯৫ শতাংশ যন্ত্রের ব্যবহার হলেও ধান রোপণ, কাটা, মাড়াই-ঝাড়াইয়ে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার এখনো অনেক কম। এসব কাজে কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবহার মাত্র ১০ শতাংশ।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. সৈয়দ মো. রফিকুল আমিন বলেন, কিছু এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কায় একসঙ্গে সবাই ধান কাটছে। এসব এলাকায় শ্রমিক সংকট হচ্ছে। সরকার দীর্ঘমেয়াদে এ সঙ্কট সমাধানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প নিয়েছে। হাওর এলাকায় বেশ কিছু মেশিন দেওয়া হয়েছে। সারাদেশেই কৃষকদের অর্ধেক দামে হারভেস্টার দেওয়া হচ্ছে। এভাবে একসময় অধিকাংশ জমি যন্ত্রের আওতায় চলে আসবে।
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকও গত কয়েক বছর ধান কাটার উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন। তিনি ভবিষ্যতে সমালয় পদ্ধতিতে চাষাবাদের বিষয়ে আগ্রহী। কারণ সারাদেশের বিভিন্ন মাঠে ছোট ছোট মালিকানার জমিতে নানান জাতের ধানের চাষ হচ্ছে। ফলে একই সময় সেখানে বড় হারভেস্টারে ধান কাটা সম্ভব হচ্ছে না। সমালয় পদ্ধতিতে পুরো মাঠে একসঙ্গে বীজ বপন, চারা রোপণ থেকে শুরু করে ধান কেটে গোলায় তোলাÑ সবই হবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে। এতে শ্রমিকনির্ভরতা পাশাপাশি কমবে চাষির ব্যয়।
বাগেরহাটে দেড় মণ ধানের দামে একজন শ্রমিকের মজুরি
এস এম সামছুর রহমান, বাগেরহাট থেকে জানান, দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বাগেরহাটে অন্যান্য বছরগুলোর মত এবছরও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এই মুহূর্তে অধিকাংশ জমির ধান কেটে কৃষক ঘরে তুলেছেন। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় অশনি আতঙ্কে অনেক কৃষক আগে ভাগেই ধান কেটে ঘরে তুলেছিলেন। কিন্তু এবছর বাগেরহাটে ধান কাটা শ্রমিক সঙ্কট ও শ্রমিকের মজুরী নিয়ে বিপাকে পড়েন চাষীরা। এবছরই প্রথম শ্রমিকের মজুর বেড়ে হাজার টাকায় পৌঁছায়। ৯শ’ ৫০ থেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে একজন শ্রমিক নিতে হয়েছে তাদের। সাথে আবার তিন বেলা খাবারও রয়েছে।
এদিকে প্রতি মন মোটা ধান বিক্রি হয়েছে ৭শ’ থেকে ৭শ’ ৫০ টাকায়। অবশ্য চিকন সবচেয়ে ভাল ধান বিক্রি হয়েছে ৯শ’ থেকে ৯শ’ ২০ টাকায়। সেই হিসেবে প্রায় দেড় মণ ধানের দামে মিলেছে একজন শ্রমিক।
এদিকে ধানের দাম কম আর শ্রমিকের মজুরি বেশি হওয়ায় বোরোর বাম্পার ফলন হলেও বাড়তি ব্যয়ের জন্য লোকসানের আশঙ্কা করছেন চাষীরা।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সুত্রে জানা যায়, এবছর জেলায় ৫৯ হাজার ২শ’ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে চিতলমারী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ১১হাজার ৮শ’ ৮০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। আর সবচেয়ে কম উপকূলীয় উপজেলা মোংলায় আবাদ করা হয়েছে মাত্র ২০ হেক্টর জমিতে।
তবে কৃষকরা বলছেন, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে একদিকে যেমন ধানের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে, সেই সাথে এবছর শ্রমিক সঙ্কটের কারণে শ্রমিকের মজুরীও বেড়ে গেছে। একারণে চাষীদের ধান উৎপাদন থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত খরচের পরিমানও অনেক বেড়েছে। অপরদিকে ধানের দাম কম। ফলে বোরোর বাম্পার ফলন হলেও হাসি নেই কৃষকের মুখে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর এলাকার কৃষক মহিউদ্দিন বলেন, ধানের ফলন ভাল হয়েছে। কিন্তু এবছর একজন ধান কাটার শ্রমিককে প্রতিদিনের মজুরী ৯‘শ ৫০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আর প্রতিমণ মোটা ধানের দাম ৭শ’ থেকে ৭শ’ ৫০ টাকা। এমন অবস্থা হলে ধান চাষ করলে কৃষকের লোকসান হবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার সুগন্ধি গ্রামের কৃষক হাকিম মল্লিক জানান, শ্রমিকের অভাবে বোরো ধান কাটা নিয়ে তিনি বিপাকে পড়েছিলেন। পরে অধিক দামে শ্রমিক নিতে বাধ্য হয়েছেন। তিন বেলা ভাত খাইয়ে একজন শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়েছে ৯শ’ ৫০ টাকা। যা প্রায় দেড় মণ ধানের দামের সমান। তিন বেলা খাওয়ানো ছাড়াও শ্রমিকদের পান-সুপারি ও চা-বিড়িসহ অন্যান্য খরচ দিতে হয়।
এই মৌসুমে প্রতিবছরই বাগেরহাটে কিছুটা শ্রমিকের সঙ্কট থাকে তাই পার্শ্ববর্তি জেলা নড়াইল, যশোর, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক এসে কাজ করে থাকেন। বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী ‘মানুষ বেচা-কেনার হাট’ ফকিরহাট ও যাত্রাপুর থেকে এসব শ্রমিক আনা হয়। আর এসব শ্রমিক আনা থেকে শুরু করে সব খরচ কৃষকেই বহন করতে হয়। ফলে খরচের পাল্লা বাড়তেই থাকে চাষীর।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমান জানান, বোরো মৌসুমে বাগেরহাটে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এবছর দীর্ঘ সময় ধরে ধান পাকায় ও কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারে শ্রমিক সঙ্কট নজরে আসেনি। তবে শ্রমিকের মজুরী তুলনামূলক বেড়ে গেছে।

 

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার সময় কমছে ২ ঘণ্টা

ধান কাটা নিয়ে বিপাকে কৃষক

আপডেট টাইম : ০৯:৫৩:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ মে ২০২২

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে বিরূপ আবহাওয়া বিরাজ করছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলায় ভারি থেকে অতিভারি না হয় মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এ ছাড়া উজানের দেশ ভারতের বিভিন্ন জেলায় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। তিস্তা যমুনার পানি বেড়ে চরাঞ্চলের জমির বোরো ধান ও অন্যান্য ফসল তলিয়ে গেছে। অন্যদিকে সুরমা-কুশিয়ারা এসব নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওর এলাকার পাঁচটি জেলায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন বৈরী আবহাওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধানের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ঝড়ো বাতাসে পাকা ধান জমিতে নুইয়ে পড়েছে। এসব ধানে চারা গজাচ্ছে। অশনির প্রভাব কেটে গিয়ে রোদের দেখা মিললেও শ্রমিক সঙ্কটের কারণে কৃষক ধান কাটতে পারছে না। ১ হাজার থেকে ১১০০ টাকা অর্থাৎ দেড় মণ ধানের দামেও মিলছে না একজন ধান কাটার শ্রমিক। চাহিদা বেশি থাকায় কলের মেশিন হারভেস্টারও পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় জমির ধান কেটে ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটছে কৃষকদের।

প্রতি বছরই দেশে বোরো মৌসুমের ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক না থাকার কারণে তাদের মজুরিও বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একদিনে ১ হাজার থেকে ১১০০ টাকায়ও শ্রমিক মিলছে না। অথচ বর্তমানে ধান কেটে বাজারে ৬শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। সে হিসাবে দেড়মণ ধানের দামেও ১ জন শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি মজুরিতে শ্রমিক নিয়ে লোকসানে পড়ছেন কৃষক।
সারাদেশে বর্তমানে বিআর ২৯ জাতের ধান পুরোপুরি পাকা অবস্থায় আছে। চলতি মৌসুমে বোরোর আবাদও ভালো হয়েছে। কিন্তু ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে ১১ মে থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাই যে সব এলাকায় জমিতে পানি জমেছে সেখানে পাকা ধান জমিতেই নষ্ট হচ্ছে।
নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার শুনই গ্রামের কৃষক মজিবর মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিদিন কামলা (ধান কাটার শ্রমিক) খুইজ্যা পাই না। ক্ষেতের প্রায় অর্ধেক ধান কামলারে দিলেও কেউ আসে না। পানিতে ডুইব্যা ক্ষেতের ধান নষ্ট অইতাছে, কিন্তু কিছুই করতে পারতাছি না।
বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর এলাকার কৃষক মমিন আলী বলেন, ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু এ বছর একজন ধান কাটা শ্রমিককে প্রতিদিনের মজুরি দিতে হচ্ছে ১ হাজার টাকা। তারপরও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি মণ মোটা ধানের দাম ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। এমন অবস্থায় ধান চাষ করে লোকসান ছাড়া আর কি।
বোরো মৌসুমে প্রতি বছরই বাগেরহাটে শ্রমিকের খুবই সঙ্কট দেখা দেয়। পার্শ্ববর্তী নড়াইল, যশোর, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক এসে কাজ করেন। বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী ‘মানুষ বেচা-কেনার হাট’ ফকিরহাট ও যাত্রাপুর থেকে এসব শ্রমিক আনা হয়। এসব শ্রমিক আনা থেকে শুরু করে সব খরচ কৃষককেই বহন করতে হয়। কিন্তু এবার ওই সব এলাকা থেকে আগের মত শ্রমিক আসেনি। এতে শ্রমিক সঙ্কট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
জয়পুরহাটের বদলগাছির কৃষক আলাল বলেন, প্রতিজন শ্রমিক ১১শ’ টাকা দিনমজুরি চায়। তাদের দিয়ে এক বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করে ঘরে নিতে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হবে। মেশিনের সুবিধা পেলে সে খরচ অর্ধেক হতে। মেশিনে কাটালে সময়ও কম লাগে এবং খরচ মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা বিঘা। মেশিনে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের খরচ কম। অথচ মেশিনও পর্যাপ্ত নেই। পনের দিন আগে থেকে বলেও মেশিন পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ একর জমির ধান কাটতে হয়। এ বিশাল পরিমাণে জমির ধান কাটতে যত সংখ্যক শ্রমিক প্রয়োজন তার অনুপাতে ৪০ শতাংশ কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। সে চাহিদা পূরণে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ধান কাটার যন্ত্রের প্রয়োজন সেটার মাত্র পাঁচ শতাংশ রয়েছে দেশের কৃষকদের কাছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা বলছেন, বোরো মৌসুমের সব ধান কাটতে দেশে অন্তত ২০ হাজার হারভেস্টার যন্ত্র প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে হার্ভেস্টিং ও রিপিং মেশিন মিলিয়ে চার হাজারের মতো যন্ত্র সচল আছে।
অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ধান আবাদে সবচেয়ে বেশি আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। তবে জমি চাষ ও সেচে ৯৫ শতাংশ যন্ত্রের ব্যবহার হলেও ধান রোপণ, কাটা, মাড়াই-ঝাড়াইয়ে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার এখনো অনেক কম। এসব কাজে কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবহার মাত্র ১০ শতাংশ।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. সৈয়দ মো. রফিকুল আমিন বলেন, কিছু এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কায় একসঙ্গে সবাই ধান কাটছে। এসব এলাকায় শ্রমিক সংকট হচ্ছে। সরকার দীর্ঘমেয়াদে এ সঙ্কট সমাধানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প নিয়েছে। হাওর এলাকায় বেশ কিছু মেশিন দেওয়া হয়েছে। সারাদেশেই কৃষকদের অর্ধেক দামে হারভেস্টার দেওয়া হচ্ছে। এভাবে একসময় অধিকাংশ জমি যন্ত্রের আওতায় চলে আসবে।
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকও গত কয়েক বছর ধান কাটার উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন। তিনি ভবিষ্যতে সমালয় পদ্ধতিতে চাষাবাদের বিষয়ে আগ্রহী। কারণ সারাদেশের বিভিন্ন মাঠে ছোট ছোট মালিকানার জমিতে নানান জাতের ধানের চাষ হচ্ছে। ফলে একই সময় সেখানে বড় হারভেস্টারে ধান কাটা সম্ভব হচ্ছে না। সমালয় পদ্ধতিতে পুরো মাঠে একসঙ্গে বীজ বপন, চারা রোপণ থেকে শুরু করে ধান কেটে গোলায় তোলাÑ সবই হবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে। এতে শ্রমিকনির্ভরতা পাশাপাশি কমবে চাষির ব্যয়।
বাগেরহাটে দেড় মণ ধানের দামে একজন শ্রমিকের মজুরি
এস এম সামছুর রহমান, বাগেরহাট থেকে জানান, দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বাগেরহাটে অন্যান্য বছরগুলোর মত এবছরও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এই মুহূর্তে অধিকাংশ জমির ধান কেটে কৃষক ঘরে তুলেছেন। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় অশনি আতঙ্কে অনেক কৃষক আগে ভাগেই ধান কেটে ঘরে তুলেছিলেন। কিন্তু এবছর বাগেরহাটে ধান কাটা শ্রমিক সঙ্কট ও শ্রমিকের মজুরী নিয়ে বিপাকে পড়েন চাষীরা। এবছরই প্রথম শ্রমিকের মজুর বেড়ে হাজার টাকায় পৌঁছায়। ৯শ’ ৫০ থেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে একজন শ্রমিক নিতে হয়েছে তাদের। সাথে আবার তিন বেলা খাবারও রয়েছে।
এদিকে প্রতি মন মোটা ধান বিক্রি হয়েছে ৭শ’ থেকে ৭শ’ ৫০ টাকায়। অবশ্য চিকন সবচেয়ে ভাল ধান বিক্রি হয়েছে ৯শ’ থেকে ৯শ’ ২০ টাকায়। সেই হিসেবে প্রায় দেড় মণ ধানের দামে মিলেছে একজন শ্রমিক।
এদিকে ধানের দাম কম আর শ্রমিকের মজুরি বেশি হওয়ায় বোরোর বাম্পার ফলন হলেও বাড়তি ব্যয়ের জন্য লোকসানের আশঙ্কা করছেন চাষীরা।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সুত্রে জানা যায়, এবছর জেলায় ৫৯ হাজার ২শ’ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে চিতলমারী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ১১হাজার ৮শ’ ৮০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। আর সবচেয়ে কম উপকূলীয় উপজেলা মোংলায় আবাদ করা হয়েছে মাত্র ২০ হেক্টর জমিতে।
তবে কৃষকরা বলছেন, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে একদিকে যেমন ধানের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে, সেই সাথে এবছর শ্রমিক সঙ্কটের কারণে শ্রমিকের মজুরীও বেড়ে গেছে। একারণে চাষীদের ধান উৎপাদন থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত খরচের পরিমানও অনেক বেড়েছে। অপরদিকে ধানের দাম কম। ফলে বোরোর বাম্পার ফলন হলেও হাসি নেই কৃষকের মুখে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর এলাকার কৃষক মহিউদ্দিন বলেন, ধানের ফলন ভাল হয়েছে। কিন্তু এবছর একজন ধান কাটার শ্রমিককে প্রতিদিনের মজুরী ৯‘শ ৫০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আর প্রতিমণ মোটা ধানের দাম ৭শ’ থেকে ৭শ’ ৫০ টাকা। এমন অবস্থা হলে ধান চাষ করলে কৃষকের লোকসান হবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার সুগন্ধি গ্রামের কৃষক হাকিম মল্লিক জানান, শ্রমিকের অভাবে বোরো ধান কাটা নিয়ে তিনি বিপাকে পড়েছিলেন। পরে অধিক দামে শ্রমিক নিতে বাধ্য হয়েছেন। তিন বেলা ভাত খাইয়ে একজন শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়েছে ৯শ’ ৫০ টাকা। যা প্রায় দেড় মণ ধানের দামের সমান। তিন বেলা খাওয়ানো ছাড়াও শ্রমিকদের পান-সুপারি ও চা-বিড়িসহ অন্যান্য খরচ দিতে হয়।
এই মৌসুমে প্রতিবছরই বাগেরহাটে কিছুটা শ্রমিকের সঙ্কট থাকে তাই পার্শ্ববর্তি জেলা নড়াইল, যশোর, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক এসে কাজ করে থাকেন। বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী ‘মানুষ বেচা-কেনার হাট’ ফকিরহাট ও যাত্রাপুর থেকে এসব শ্রমিক আনা হয়। আর এসব শ্রমিক আনা থেকে শুরু করে সব খরচ কৃষকেই বহন করতে হয়। ফলে খরচের পাল্লা বাড়তেই থাকে চাষীর।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমান জানান, বোরো মৌসুমে বাগেরহাটে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এবছর দীর্ঘ সময় ধরে ধান পাকায় ও কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারে শ্রমিক সঙ্কট নজরে আসেনি। তবে শ্রমিকের মজুরী তুলনামূলক বেড়ে গেছে।