চার যুগ মানুষের সেবায় ব্রত জিলিয়ানের শেষ চাওয়া

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চার যুগেরও বেশি সময় ধরে মেহেরপুরবাসীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন ব্রিটিশ নাগরিক জিলিয়ান এম রোজ। অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সেবা দিয়ে কেড়ে নিয়েছেন মানুষের মন। মানবসেবায় ত্রুটি হবে, এমন ভাবনায় নিজেকে রেখেছেন চিরকুমারী।

বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের এই নার্স রোগী ও প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে আবদ্ধ হয়েছেন মায়ার বন্ধনে। তাই তো বয়সের ভারে নুয়ে পড়া জিলিয়ান রোজ (৮০) বাকি জীবন কাটাতে চান মানুষের সেবা করে। হতে চান বাংলাদেশের নাগরিক।

এদিকে বছরান্তে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে পড়তে হয় বিভিন্ন জটিলতায়। তাই দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সাড়া পাননি। তাই তাকে নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন মেহেরপুরবাসী।

জানা গেছে, ১৯৩৯ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন জিলিয়ান এম রোজ। জিলিয়ানের বাবা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ছোটবেলায় পিতৃবিয়োগ ঘটে জিলিয়ানের জীবনে। একমাত্র ভাই ড. ডিএ রোজের সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর সিদ্ধান্ত নেন ধর্ম প্রচারের। খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের জন্য ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় আসেন রোজ।

সে সময় বাংলাদেশের মানুষ, মাটি, প্রকৃতি দেখেছেন ঘুরে ঘুরে। ১৯৭০ সালে স্বজনদের টানে ফিরে যান নিজ দেশে। কিন্তু এ দেশের মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে ফের চলে আসেন ১৯৭৪ সালে। দেশে নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে খুলনা ও পরে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুর হাসপাতালে আসেন। শুরু করেন মানবসেবা। কবে কখন যে সময় যৌবন চলে গেল, টের পাননি। তাই থেকে গেলেন চিরকুমারী।

রোজ খুব প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে কথা না বললেও নিজ হাতে রোগীকে সেবা প্রদান করেন নিরলসভাবে। দীর্ঘদিন ধরে থাকার কারণে তার হৃদয়জুড়ে এখন বাংলাদেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। মানুষকে পরম মমতায় সেবা দিয়ে মন জয় করেছেন। তার চলনে-বলনেও চলে এসেছে বাঙালিয়ানা। তাই এখন তার একটাই চাওয়া, বাংলার মাটিতে শেষ বিদায়।

একান্ত আলাপে রোজ বলেন, ২০১৭ সালে স্বজনদের চাওয়ায় দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষ ও মাটির ভালোবাসায় আর যেতে মন চায়নি। পরিবার একাধিকবার দেশে ফিরে যাওয়ার কথা জানালেও আমি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে অপারগতা প্রকাশ করি।

জিলিয়ান বলেন, সরকার যদি আমাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়, তাহলে যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন এভাবে সেবা দিয়ে যাব। রোজের ভাষায়, পৃথিবীতে এসেছি সেবা দিতে। বৃদ্ধদের জন্য কেউ কিছু করে না। তাই আমি নিজে একটি বৃদ্ধাশ্রম খুলেছি। তারা যেন শেষ জীবনে ভালোভাবে মৃত্যুবরণ করতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, আমি যখন ১৯৬৪ সালে এ দেশে আসি, তখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল। পরে আমি মালয়েশিয়ায় চলে যাই। সেখান থেকে আবারও দেশে ফিরি। পরে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের খুলনা জেলায় সেবা দেওয়ার জন্য চলে আসি। খুলনায় বেশ কয়েক বছর গ্রামাঞ্চলে সেবা দিয়ে ১৯৮১ সালে বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে যোগদান করি। সেই থেকে গরিব-দুঃখী মানুষের সেবা করে যাচ্ছি।

বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের সিনিয়র নার্স নীলসুরি সরিনও তার সঙ্গে কাজ করতে পেরে গর্বিত। তিনি বলেন, জিলিয়ান রাত-দিন মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। নিজের জন্য কোনো কিছু না করা এ মানুষটির কোনো অহংকারও নেই। সাদাসিধে পোশাক পরেন, খাবার খান নিরামিষ। তার কাছ থেকে আসল মানুষ হয়ে ওঠার গুণাবলি কিছুটা অর্জন করতে পেরেছি। তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। তার শেষকৃত্য করতে পারলে জীবন সার্থক হবে।

মেহেরপুর জেলার মানুষ জিলিয়ান এম রোজকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তিনি নিজেও জেলা প্রশাসনের কাছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করেছেন। কিন্তু আজও তাকে সেই সম্মান দেওয়া হয়নি।

সেটি সমর্থন জানিয়ে বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন জানান, মায়ের মমতামাখা হাত দিয়ে দীর্ঘদিন সেবা দেওয়া মানুষটি আজ বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। জেলার মানুষকে তিনি সেবা দিয়ে জয় করে নিয়েছেন মন। জেলার মানুষও তাকে আপন করে নিয়েছেন। তার জীবনের শেষ চাওয়াটা পূরণ হবে, আমি এ প্রত্যাশা করি।

মেহেরপুর জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি তোজাম্মেল আযম বলেন, ১৯৬৫ সালের ১২ মে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস প্রথমবার পালন করে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। সেই থেকে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে দিনটি। কারণ দিনটি হলো আধুনিক নার্সিংয়ের জননী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন। এমন একটি দিনে মেহেরপুরের মানুষকে নার্স হিসেবে জীবন উৎসর্গকারী ব্রিটিশ নগরিককে শুধু সংবর্ধনা নয়, নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মানিত করা উচিত। তাহলে আরও জিলিয়ান এগিয়ে আসতে উৎসাহ পাবেন।

 

২০০১ সালে ইংল্যান্ডের রানির পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন হাইকমিশনার বল্লভপুরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার উপাধী দিয়ে সম্মানিত করেন। বিষয়টি জানিয়ে মুজিবনগর উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াইদ্দীন বিশ্বাস বলেন, আমাদের মেহেরপুরের মানুষকে ভালোবেসে যে মানুষটি নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা দিয়ে যেতে পারে, মানুষকে মানবিক হওয়ার জন্য নিজেকে উজাড় করতে পারেন, তার জন্য আমাদেরও কিছু করা উচিত।

মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজন সরকার বলেন, জিলিয়ান রোজ এখন আমাদের সম্পদ। তার নাগরিকত্ব চাওয়ার বিষয়টি শুনেছি। উপজেলা প্রশাসনের যা করণীয়, সে বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খান বলেন, বাংলাদেশকে যে মানুষটি এত ভালোবেসেছেন, নিশ্চয়ই বাংলাদেশও তাকে ভালোবাসবে। আমরাও তাকে ভালোবাসি, বাংলাদেশের মানুষ মনে করি। জিলিয়ানের কাজে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। নাগরিকত্বর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর