আজ আস্থা ভোট: ইমরান খান হারলে হারবে পাকিস্তানও

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্ভবত তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে খানকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অপসারণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তানের বেশ কিছু বিরোধী দল। পাকিস্তানের আইনপ্রণেতারা বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আলোচনায় বসবেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে।

গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকটা ঝড় বয়ে গেছে, যার ধারাবাহিকতায় ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি (পিটিআই)’র বেশ কয়েকজন সদস্য দল ত্যাগ করেন। এর ফলে অনাস্থা ভোটের ফল বিরোধী দলের পক্ষে আসার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। পাকিস্তানের সংসদে ৩৪২ আসনের মধ্যে ১৭২ ভোট নিয়ে বিরোধী দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রীত্ব বাতিল হবে। ইমরান খানের জোটের প্রধান শরিক এমকিউএম বুধবার বিরোধী জোটে যোগ দেয়ার পরই বিরোধী দল সংসদে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কাগজে কলমে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের ভোট এখন ১৭৫, আর সরকারি দলের ১৬৪।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর দুর্নীতি রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ক্ষমতায় আসা ইমরান খান অবশ্য সহজে নিজের অবস্থান ছাড়ছেন না। তিনি এখনও কতটা জনপ্রিয়, তার প্রমাণ হিসেবে রোববার ইসলামাবাদে বিশাল এক র‍্যালি আয়োজন করেন সাবেক এই ক্রিকেটার। ওই র‍্যালিতে খান তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের – তিন বারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ জারদারি – দিকে ইঙ্গিত করে সমবেত মানুষের প্রতি একটি চিঠি প্রদর্শন করেন, যেটিতে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত চোর’দের সহায়তায় ‘বিদেশি চক্রান্তের’ মাধ্যমে তার সরকার উৎখাতের চেষ্টার প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে ওই চিঠিতে ঠিক কী রয়েছে, সেটি খোলাসা করেননি তিনি।

এই নাটকীয়তার মধ্যেই বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার কথা থাকলেও কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই তা বাতিল করেন ইমরান খান। ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের জনসমর্থন হারিয়েছে দেশের অভ্যন্তরে চড়া মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়তে থাকার কারণে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের পাকিস্তান অংশের পরিচালক উজাইর ইউনিস বলেন, “উদাহরণস্বরূপ, জানুয়ারি ২০২০ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭%, সেখানে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৩%।”

বিশ্লেষক আরিফা নূর মনে করেন, পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব সবসময়ই ছিল। পাকিস্তানের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধেক সময় দেশটির সেনাবাহিনী সরাসরি দেশ শাসন করেছে। কিন্তু সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদের অপসারণের বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক গবেষক আবদুল বাসিত মনে করেন, ইমরান খানের ‘আত্মাভিমান’ ও ‘অনমনীয়তা’ এই দ্বন্দ্বকে জনসম্মুখে নিয়ে এসেছে – যে দ্বন্দ্ব নিয়ে সবসময় লোকচক্ষুর আড়ালেই আলোচনা চলতো।

“ইমরান খান সেনাবাহিনীর টেনে দেয়া সীমারেখা অতিক্রম করেছেন। পরবর্তীতে যখন থেকে তিনি সেনাবাহিনীর পছন্দের লোককেই নিয়োগ দেন, তখন থেকে তার পতনের শুরুটা হয়,” বলেন তিনি। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও ইমরান খান দুই পক্ষই নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর আগে দুইবার দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছে। তবে সেই দুইবারই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরা – ১৯৮৯ সালে বেনজীর ভুট্টো এবং ২০০৬ সালে শওকত আজিজ – দায়িত্বে থেকে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান সংসদীয় সমীকরণ বলছে এই দফায় ইমরান খান বড় ধরণের পরাজয়ের সম্মুখীন হবেন – এমনকি তার নিজের দলের ভেতরের ভিন্ন মতাবলম্বীরা ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ না করলেও।

সরকার সুপ্রিম কোর্টের একটি রুলের জন্য আবেদন করেছে, যেটি বিদ্রোহ বিরোধী আইনের অধীনে ভিন্ন মতাবলম্বীদের শুধু ভোট দেয়া থেকেই বিরত রাখবে না, তাদের সংসদ থেকেও আজীবন নিষিদ্ধ করবে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা মিত্রদের সাথে বৈঠক করছেন, আর প্রচার করছেন যে তারা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।

বিশ্লেষক উজাইর ইউনিস মনে করেন, ইমরান খান তার মিত্রদের সাথে সমঝোতায় ব্যর্থ হয়েছেন, এবং তিনি যদি ‘আশ্চর্যজনকভাবে এই পরিস্থিতি উৎরে যান’, তবুও তিনি যথেষ্ট অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেই থাকবেন। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় নির্ধারিত সময়ের আগে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে তাকে। কোনওভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যদি তিনি ক্ষমতায় টিকেও যান, তাহলে যতদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য তার ওপর আরও বেশি চাপ আসবে।” বিশ্লেষক আবদুল বাসিতও মনে করেন যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনওভাবে ক্ষমতায় টিকে গেলেও ‘পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে’ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে তাকে।

ইমরান খানের বিরোধীরা তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের চেষ্টা করলেও দায়িত্বে থাকা অবস্থায় খান তার কার্যক্রম নিয়ে কৃতিত্ব নিতেই পারেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ইমরান খানের দল পিটিআই দরিদ্রদের মধ্যে সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানের কোভিড পরিসংখ্যানও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বেশ ভালো, যদিও এই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।

বাইশ কোটি জনসংখ্যার দেশে কোভিড আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন মাত্র ১৫ লাখ মানুষ, আর মৃত্যু হয়েছে ৩০ হাজারের – পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় যা খুবই কম। তবে বিশ্লেষক আরিফা নূর মনে করেন যে খাইবার পাখতুনওয়ালা ও পাঞ্জাব প্রদেশে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করা ছিল ইমরান খান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য। “আসন্ন নির্বাচনে এটি তাদের বড় স্লোগান হতে পারে। অনেক মানুষকেই হয়তো কোভিডে তেমন ভুগতে হয়নি, কিন্তু স্বাস্থ্য কার্ডের মত একটা কর্মসূচী বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে বড় ধরণের প্রভাব রাখতে পারে।”

প্রশ্ন উঠছে, এ রকম পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের মত একটি দেশে – যেখানে আজ পর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পন্ন করতে পারেনি – সরকার উৎখাত হলে বিরোধী দল কী প্রতিশ্রুতি দিতে পারে? তড়িঘড়ি করে গঠন করা জোটের মাধ্যমে তৈরি সরকার কি পাকিস্তানের কাঠামোগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান দিতে পারবে? বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মুহূর্তে এসব সমস্যার কোন সমাধান নেই বিরোধী দলের সামনে।

বিশ্লেষক আরিফা নূর বলেন, “বিরোধী দলকে এক্ষেত্রে সুবিধাবাদী মনে হচ্ছে। দুঃখজনক ভাবে, আমাদের দেশে যেহেতু ক্ষমতার পালাবদলের নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে মানা হয় না, প্রতিবার যখন কেউ ক্ষমতায় আসে, ক্ষমতার বাইরে থাকারা মনে করেন যে নতুন ক্ষমতা নেয়া পক্ষকে অস্থিতিশীল করাটা ন্যায্য।”

বিশ্লেষক আবদুল বাসিত মনে করেন যে বিরোধী দল শুধু সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনাই করেছে, এরপর কী করবে সে সম্পর্কে কোন পরিকল্পনা নেই তাদের – এমনকি তা নিয়ে কোন চিন্তাও তাদের নেই। তার মতে, “পাকিস্তান আগামী অন্তত এক থেকে দেড় বছরের জন্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাবে।”

বিশ্লেষক উজাইর ইউনিসও মনে করেন যে ইমরান খানকে পদচ্যুত করা ছাড়া বিরোধী দলের আর কোন পরিকল্পনা নেই। তার মতে, এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে পাকিস্তানের নাগরিকরা। “যেই জিতুক না কেন, শেষ পর্যন্ত হার হবে পাকিস্তানের নাগরিকদের। পরের নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটাই অস্থিরতার মধ্যে সম্পন্ন হবে। নির্বাচন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কোন ধরণের স্থিতিশীল পরিস্থিতি পাবো না,” বলেন তিনি। সূত্র: বিবিসি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর