ঢাকা ০৯:০২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উৎপাদন খরচের চেয়েও ধানের দাম কম কৃষকের মাথায় হাত

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:২০:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ এপ্রিল ২০১৬
  • ৬৭২ বার

বোরো মৌসুমে ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রংপুরের সিও বাজারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন স্থানীয় সহস্রাধিক কৃষক। ক্ষুব্ধ হয়ে তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে স্মারকলিপিও দেন। কৃষকদের বক্তব্য ছিল, ধানের চেয়েও আলুর দাম বেশি। এটা হতে পারে না। ধানের মূল্য অন্তত ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা হতে হবে। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার মনপাল গ্রামের কৃষক চান মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন, ‘এক মণ ধান বিক্রি করেও একজন শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা যাচ্ছে না।’ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার পানিহাকা গ্রামের কৃষক এনামুল হকও একই কথা বললেন, প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায়। মণপ্রতি অন্তত ২০০ টাকা তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুম থেকে ধানের আবাদ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

শুধু এ কজন কৃষকই নন, সারা দেশেই ধানের একই চিত্র। কৃষকের মাথায় হাত। উৎপাদন খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ধান চাষের পরিবর্তে অনেকে আলু, ভুট্টাসহ অন্য সবজি চাষাবাদ করছেন। অনেক এলাকায় শিল্পনগরী গড়ে উঠছে। আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। মূল্য না পেয়ে কৃষি আবাদই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন কেউ কেউ। সরকার যথাযথ উদ্যোগ না নিলে কৃষক কৃষি আবাদ বাদ দিয়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এক মণ ধানের দর সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৮০ টাকা। কিন্তু খাদ্য বিভাগ কৃষকের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে ধান কিনছে না। অতীতে একাধিকবার এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে কোনো পণ্যের সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম কমে যায়। বাংলাদেশে এখন ধানেরও বাম্পার ফলন হচ্ছে। কৃষকের ন্যায্য মূল্য পেতে দুই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এক. কৃষকের নিজেরই গুদামজাত করে পর্যায়ক্রমে ধান বিক্রি করা। এ ক্ষেত্রে সরকার তাদের ঋণ দিতে পারে। দুই. সরকারও নির্ধারিত মূল্যে ধান কিনে নিতে পারে। এ দুই প্রক্রিয়ায় এগোলে মাঝে ফড়িয়া শ্রেণি থাকবে না। কৃষকও ন্যায্য মূল্য পাবে।’

নোয়াখালী : জেলার কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বোরো, বিআর-৪০, বিআর-২৩, বিটআর-১১সহ বিভিন্ন জাতের ধানের ফসল উৎপাদন করছেন। অথচ মৌসুমে ধান বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না তারা। বাজারে দেখা গেছে, কৃষক বোরো, বিআর-৪০সহ বিভিন্ন জাতের প্রতি মণ ধান বিক্রি করছেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। অথচ একজন কৃষিশ্রমিককে দৈনিক মজুরি দিতে হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এক মণ ধান বিক্রি করে একজন শ্রমিক পাওয়া যায় না। অনেক কৃষক মহাজনের ঋণের বোঝা নিয়ে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। খাদ্য বিভাগের সরকারি মূল্যে এক মণ ধান ৮৮০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও খাদ্য বিভাগ ধান কিনছে না। কৃষক বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষকরা। এর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন ভাটিরটেকের তেরিছপুলের কৃষক আবদুল জলিল, চরওয়াপদার আবুল হাসেম, মো. জাবেরসহ অনেকে।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কৃষক ন্যায্য মূল্যে পায় না। বাজার দর কম। ফড়িয়ারা ধান কিনতে চায় না। সরকারি নিয়মে প্রতি মণ ধানের মূল্য ৮৮০ টাকা অথচ খাদ্য বিভাগ ধান কিনছে না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে জেলা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তার অফিসে গেলে বন্ধ পাওয়া যায়। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল।

কুমিল্লা : ধান চাষ করে কৃষক বিপাকে পড়েছেন। লাকসাম উপজেলার মনপাল গ্রামের কৃষক চান মিয়া জানান, প্রতি কানি (১২০ শতক) জমি চাষ করতে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি কানিতে ধান পেয়েছেন ২০ মণ। ৫০০ টাকা হিসেবে ২০ মণের দাম ১০ হাজার টাকা। এবার ব্রি-২৮ ধানে রোগ হওয়ায় ফসল কম হয়েছে। অন্যদিকে বাজারেও ধানের ধান কম। একজন ধান কাটার শ্রমিকের মূল্য ৪৫০ টাকা। তারপর তার দুই বেলা ভাত ও এক বেলা নাস্তার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ১ কানি জমিতে যে ধান পাচ্ছেন, তার অর্ধেক ধান কাটা শ্রমিকের পেছনে চলে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানান, কৃষক ধানের ভালো দাম পাচ্ছেন না। ধানের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তারা খরচ তুলতে পারতেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কুমিল্লার উপপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, এ পর্যন্ত জেলায় ২৪ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় ফসল ভালো হয়েছে।

বগুড়া : বগুড়ার হাটবাজারে উঠতে শুরু করেছে বোরোর নতুন ধান। তবে দাম না থাকায় বোরো চাষিরা ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছেন। বগুড়ার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫২০ টাকায়। কৃষক বলছেন, এ দামে ধান বিক্রি করলে আবাদের খরচই উঠবে না।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানান, গেল বছর বগুড়ায় বোরোর ফলন হয়েছে বাম্পার। আবহাওয়া অনুকূলের সঙ্গে সার ও বীজ সময়মতো প্রয়োগ করা হয়েছে। বগুড়া জেলায় এবার বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ১৯০ হেক্টর জমি। ফলন ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৪২ মেট্রিক টন (চাল আকারে)। আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলে থাকায় ফলন ৮ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে কৃষি অফিস।

তবে সোনাতলা উপজেলার হুয়াকুয়া গ্রামের চাষি আবদুল মোত্তালেব জানান, প্রতি মণ ধান শুকানোর ওপর ভিত্তি করে বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫২০ টাকা। সেখানে প্রতি বিঘা জমিতে আবাদ ও শ্রমিক, বাজারে পরিবহন, ধান শুকানো, সার-বীজসহ খরচ হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। ১ বিঘা জমি থেকে ১৪ মণ ধান পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে ৫০০ টাকা মণ দরে বাজারে বিক্রি হবে ৭ হাজার টাকায়। এতে বোরো চাষিদের লোকসান গুনতে হবে। একই গ্রামের বোরো চাষিরা জানান, বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু চাষিদের খরচের সঙ্গে দাম পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে বোরো ধানের দাম খুবই কম।

শেরপুর : ধানের জেলা শেরপুর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ধান কাটা। জেলার কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, এবার শেরপুর জেলায় ৮৯ হাজার ৩৫৫ একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৩৯৫ টন। কৃষি বিভাগ মনে করে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ধান উৎপাদন হবে। তবে জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলনেও দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক।

পাকুরিয়ার কৃষক কালু মিয়া জানান, জমির ব্যবহারমূল্য ছাড়াই এক মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ৭০০ টাকার ওপরে আর বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫২০ টাকায়। একই এলাকার কৃষক ফারুক মিয়া জানান, ‘৪ একর জমিতে ধান করেছি। খরচ হয়েছে ১ লাখ টাকা। বর্তমান দামে ধান বিক্রি করলে ৮০ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। ধানের দাম কম থাকলেও একজন মজুরকে ৫০০ টাকার নিচে কাজে পাওয়া যায় না। কয়েক বছর ধরে আবাদ করে লোকসান গুনছি। আগামীতে আর আবাদ করব না।’ ঝিনাইগাতীর কৃষক কাফিউদ্দিন জানান, ‘সব কিছুর দাম বেড়েছে, কমেছে শুধু ধানের। ধানের দাম কম হলেও কেউ কিনতে চাচ্ছে না। বাকিতে ফড়িয়াদের কাছে কোনোরকম ধান গছিয়ে দিচ্ছি। আমরা আবাদ করে যেন পাপ করে ফেলেছি।’

নওগাঁ : নওগাঁয় ধানের দাম নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কৃষক। জেলায় ধানের বাম্পার ফলন হলেও দাম কমে যাওয়ায় হতাশ তারা। পত্নীতলা উপজেলার ঘোষনগর গ্রামের মনজুর এলাহী জানান, ‘এবার প্রতি বিঘা জমির ভাড়াসহ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘায় শুধু ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে মণপ্রতি ৭৫০ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে ধানের মূল্য ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। যদি ধানের মূল্য বৃদ্ধি করা না হয় তাহলে ধান বিক্রি করে কৃষক লাভের পরিবর্তে লোকসানে পড়বেন।’

রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামের কৃষক আজিজার রহমান জানান, ইরি-বোরোর এ মৌসুমে তার ২৫ বিঘা জমিতে জিরাশাইল ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ শুরু করেছেন। এ পর্যন্ত বিঘাপ্রতি গড়ে ২২ মণ করে ধান পেয়েছেন। কিন্তু ধানের দাম কমে যাওয়ায় হতাশ তিনি। আত্রাই উপজেলার সুদরানা গ্রামের কৃষক আজাদ হোসেন বলেন, প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে তিনি এ মৌসুমে জিরাশাইলসহ বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড ধান চাষ করেছেন। কোনো রোগবালাই ছাড়াই ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে কিন্তু শঙ্কা হচ্ছে ধানের মূল্য নিয়ে। তিনি বলেন, ‘সরকার সরাসরি আমাদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করলে আমরা একটু হলেও লাভবান হব। বর্তমানে ধানের বাজারে দামের যে পতন তাতে কৃষক লোকসানের মুখে পড়বেন। তাই আমাদের মতো কৃষকের কথা ভেবে সরকারের উচিত ধানের মূল্য বাড়ানো। তা না হলে কৃষক মাঠে মারা যাবেন।’

কিশোরগঞ্জ : ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় কিশোরগঞ্জের কৃষক চরম বিপদে পড়েছেন। খেতমজুর সংকট, ধান কাটা ও পরিবহন খরচ তিন-চার গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যে চরম হতাশা বাড়ছে। সরকারি ক্রয় কেন্দ্রগুলোয় ধান সংগ্রহ শুরু হয়নি। এলাকায় কোনো ক্রেতা নেই। ফড়িয়া-বেপারিরা অসহায় কৃষকের কাছ থেকে বর্তমানে প্রতি মণ ধান ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে খরিদ করছেন। চলতি মৌসুমে ইটনা উপজেলায় কৃষক ২৩ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে উন্নয়নশীল ধানের আবাদ করেছেন। বাম্পার ফলনও হয়েছে। একমাত্র বোরো উৎপাদন এ উপজেলার ৮০-৮৫ ভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহের উৎস। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ভূমিহীন, খেতমজুর, ছোট ও মাঝারি কৃষক, প্রান্তিক ও বর্গাচাষি। প্রতি মণ ধান ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। উৎপাদন খরচ আরও অনেক বেশি।

বরিশাল : ধানের দেশ বরিশালে এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলনে কৃষকের মুখে হাসি থাকলেও হতাশায় বিলীন হচ্ছে সে হাসি। ধান বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় পড়ছেন। মাঠ প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে ধান মাড়াই পর্যন্ত খরচ বাদ দিলে বোরো মৌসুমে লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জানিয়েছেন কৃষক। ফলে তারা হতাশায় ভুগছেন। সরকার প্রকৃত অবস্থা বিবেচনা করে ধানের নতুন দাম নির্ধারণ না করলে আগামীতে ধান রোপণে কৃষক নিরুৎসাহিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আজিজ ফরাজি জানান, বিভাগের ছয় জেলায় এবার ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। তবে সরকার এ মৌসুমের জন্য এখনো ধানের মূল্য নির্ধারণ করেনি। মে মাসের মধ্যেই দাম নির্ধারণ হতে পারে।

গৌরনদীর মাহিলাড়া এলাকার কৃষক দেলোয়ার হোসেন দুলাল জানান, এবার ১ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান উৎপাদনে মাঠ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। উচ্চফলনশীল ও স্থানীয় জাতের ধান উৎপাদনেও প্রতি হেক্টরে খরচ হয়েছে ৪৪ হাজার টাকা। হেক্টরপ্রতি হাইব্রিড জাত ধানের ফলন হয়েছে ১৮৭ মণ এবং উচ্চফলনশীল ধানের উৎপাদন হয়েছে ১৪৪ থেকে ১৫০ মণ। খেত থেকে ধান কাটার জন্য চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের তিন বেলা ভালো খাবার খাওয়ানোর পরও প্রতি ১৫ মণে ২ মণ ধান দিতে হয় তাদের। এরপর মাড়াইশ্রমিকদের প্রতি ১৫ মণে দিতে হয় ৩০ কেজি করে ধান। এরপর প্রতি মণ কাঁচা হাইব্রিড ধান ৪০০ টাকা এবং উচ্চফলনশীল ও স্থানীয় জাতের ধান বিক্রি করতে হয় ৫০০ টাকা মণ দরে। এ কারণে খরচ বাদ দিয়ে কিছুই থাকে না বলে তিনি জানান।

কৃষক আবদুর রহিম, মো. বাদশা জানান, মণপ্রতি কাঁচা ধানের দাম বাজারে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা হলে কিছুটা লাভ থাকত। এখন তাদের লোকসান হচ্ছে। এভাবে লোকসান হলে আগামীতে ধানের আবাদ কমিয়ে আনা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

দিনাজপুর : উত্তরাঞ্চলরের শস্যভাণ্ডার দিনাজপুরে আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। ফসল ঘরে তোলার আগেই পোকার আক্রমণ, সার-বীজ, কীটনাশক এবং বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণে খরচ বৃদ্ধিতেই নাকাল তারা। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এ অবস্থা হয় কৃষকের। আমন ধান কাটা, মাড়াই শেষে প্রতি মণ ধান ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন বলে জানালেন জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার নওগাঁ গ্রামের কৃষক কামরুল হাসান। উৎপাদন খরচ আরও অন্তত ২০০ টাকা বেশি। বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নের দামাইক্ষেত্র গ্রামের বর্গাচাষি শাহজাহান সিরাজ বুলবুল জানান, প্রতি বিঘা জমি আবাদ করতে সার-বীজ, কীটনাশক এবং বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণসহ অন্যান্য খরচ পড়ে ৭ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি জমির মালিককে দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। সর্বমোট খরচ পড়ে ১৩ হাজার টাকা। জমিতে ধানের ফলন হয়েছে ২০ মণ। ৫০০ টাকা মণ দরে বিঘাপ্রতি ধানের মূল্য ১০ হাজার টাকা। খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। তাহলে কৃষক চলবেন কীভাবে?

চিরিরবন্দর উপজেলার নসরতপুরের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, এবার তিনি শুধু পারিজাত জাতের ধান আবাদ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ফলন পেয়েছেন প্রায় ১৫ মণ। যেখানে অন্যান্য জাতের ধান আবাদ করে পেতেন বিঘাপ্রতি মাত্র ৮ থেকে ১০ মণ। চাষ করে আয়-ব্যয় সমান।

আমবাড়ী এলাকার কৃষক আফসার আলী জানান, ‘আমি ৪ বিঘা জমিতে আগাম জাতের গুটি স্বর্ণার চাষ করেছি। ১ বিঘা জমির ধান কেটে পেয়েছি ১৮ মণ। খরচ হয়েছে প্রায় ১২ হাজার টাকা। প্রতি মণ ধান মাত্র ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছি।’

এদিকে দিনাজপুরে বোরো আবাদে হালচাষ, সার, মজুরি, কীটনাশক ও সেচের মূল্য বৃদ্ধিতে এবার বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে কৃষককে। গত বছরের চেয়ে প্রতি বিঘায় ২-৩ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। গত বছর ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এবার দুশ্চিন্তায় কৃষক। অবশ্য ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার জন্য সরকারের নীতিমালাকে দায়ী করছেন মিলার ও চাল ব্যবসায়ীরা। * প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের বিভাগীয় নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিরা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

উৎপাদন খরচের চেয়েও ধানের দাম কম কৃষকের মাথায় হাত

আপডেট টাইম : ১২:২০:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ এপ্রিল ২০১৬

বোরো মৌসুমে ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রংপুরের সিও বাজারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন স্থানীয় সহস্রাধিক কৃষক। ক্ষুব্ধ হয়ে তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে স্মারকলিপিও দেন। কৃষকদের বক্তব্য ছিল, ধানের চেয়েও আলুর দাম বেশি। এটা হতে পারে না। ধানের মূল্য অন্তত ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা হতে হবে। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার মনপাল গ্রামের কৃষক চান মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন, ‘এক মণ ধান বিক্রি করেও একজন শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা যাচ্ছে না।’ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার পানিহাকা গ্রামের কৃষক এনামুল হকও একই কথা বললেন, প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায়। মণপ্রতি অন্তত ২০০ টাকা তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুম থেকে ধানের আবাদ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

শুধু এ কজন কৃষকই নন, সারা দেশেই ধানের একই চিত্র। কৃষকের মাথায় হাত। উৎপাদন খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ধান চাষের পরিবর্তে অনেকে আলু, ভুট্টাসহ অন্য সবজি চাষাবাদ করছেন। অনেক এলাকায় শিল্পনগরী গড়ে উঠছে। আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। মূল্য না পেয়ে কৃষি আবাদই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন কেউ কেউ। সরকার যথাযথ উদ্যোগ না নিলে কৃষক কৃষি আবাদ বাদ দিয়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এক মণ ধানের দর সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৮০ টাকা। কিন্তু খাদ্য বিভাগ কৃষকের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে ধান কিনছে না। অতীতে একাধিকবার এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে কোনো পণ্যের সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম কমে যায়। বাংলাদেশে এখন ধানেরও বাম্পার ফলন হচ্ছে। কৃষকের ন্যায্য মূল্য পেতে দুই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এক. কৃষকের নিজেরই গুদামজাত করে পর্যায়ক্রমে ধান বিক্রি করা। এ ক্ষেত্রে সরকার তাদের ঋণ দিতে পারে। দুই. সরকারও নির্ধারিত মূল্যে ধান কিনে নিতে পারে। এ দুই প্রক্রিয়ায় এগোলে মাঝে ফড়িয়া শ্রেণি থাকবে না। কৃষকও ন্যায্য মূল্য পাবে।’

নোয়াখালী : জেলার কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বোরো, বিআর-৪০, বিআর-২৩, বিটআর-১১সহ বিভিন্ন জাতের ধানের ফসল উৎপাদন করছেন। অথচ মৌসুমে ধান বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না তারা। বাজারে দেখা গেছে, কৃষক বোরো, বিআর-৪০সহ বিভিন্ন জাতের প্রতি মণ ধান বিক্রি করছেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। অথচ একজন কৃষিশ্রমিককে দৈনিক মজুরি দিতে হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এক মণ ধান বিক্রি করে একজন শ্রমিক পাওয়া যায় না। অনেক কৃষক মহাজনের ঋণের বোঝা নিয়ে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। খাদ্য বিভাগের সরকারি মূল্যে এক মণ ধান ৮৮০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও খাদ্য বিভাগ ধান কিনছে না। কৃষক বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষকরা। এর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন ভাটিরটেকের তেরিছপুলের কৃষক আবদুল জলিল, চরওয়াপদার আবুল হাসেম, মো. জাবেরসহ অনেকে।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কৃষক ন্যায্য মূল্যে পায় না। বাজার দর কম। ফড়িয়ারা ধান কিনতে চায় না। সরকারি নিয়মে প্রতি মণ ধানের মূল্য ৮৮০ টাকা অথচ খাদ্য বিভাগ ধান কিনছে না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে জেলা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তার অফিসে গেলে বন্ধ পাওয়া যায়। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল।

কুমিল্লা : ধান চাষ করে কৃষক বিপাকে পড়েছেন। লাকসাম উপজেলার মনপাল গ্রামের কৃষক চান মিয়া জানান, প্রতি কানি (১২০ শতক) জমি চাষ করতে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি কানিতে ধান পেয়েছেন ২০ মণ। ৫০০ টাকা হিসেবে ২০ মণের দাম ১০ হাজার টাকা। এবার ব্রি-২৮ ধানে রোগ হওয়ায় ফসল কম হয়েছে। অন্যদিকে বাজারেও ধানের ধান কম। একজন ধান কাটার শ্রমিকের মূল্য ৪৫০ টাকা। তারপর তার দুই বেলা ভাত ও এক বেলা নাস্তার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ১ কানি জমিতে যে ধান পাচ্ছেন, তার অর্ধেক ধান কাটা শ্রমিকের পেছনে চলে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানান, কৃষক ধানের ভালো দাম পাচ্ছেন না। ধানের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তারা খরচ তুলতে পারতেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কুমিল্লার উপপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, এ পর্যন্ত জেলায় ২৪ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় ফসল ভালো হয়েছে।

বগুড়া : বগুড়ার হাটবাজারে উঠতে শুরু করেছে বোরোর নতুন ধান। তবে দাম না থাকায় বোরো চাষিরা ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছেন। বগুড়ার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫২০ টাকায়। কৃষক বলছেন, এ দামে ধান বিক্রি করলে আবাদের খরচই উঠবে না।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানান, গেল বছর বগুড়ায় বোরোর ফলন হয়েছে বাম্পার। আবহাওয়া অনুকূলের সঙ্গে সার ও বীজ সময়মতো প্রয়োগ করা হয়েছে। বগুড়া জেলায় এবার বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ১৯০ হেক্টর জমি। ফলন ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৪২ মেট্রিক টন (চাল আকারে)। আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলে থাকায় ফলন ৮ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে কৃষি অফিস।

তবে সোনাতলা উপজেলার হুয়াকুয়া গ্রামের চাষি আবদুল মোত্তালেব জানান, প্রতি মণ ধান শুকানোর ওপর ভিত্তি করে বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫২০ টাকা। সেখানে প্রতি বিঘা জমিতে আবাদ ও শ্রমিক, বাজারে পরিবহন, ধান শুকানো, সার-বীজসহ খরচ হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। ১ বিঘা জমি থেকে ১৪ মণ ধান পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে ৫০০ টাকা মণ দরে বাজারে বিক্রি হবে ৭ হাজার টাকায়। এতে বোরো চাষিদের লোকসান গুনতে হবে। একই গ্রামের বোরো চাষিরা জানান, বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু চাষিদের খরচের সঙ্গে দাম পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে বোরো ধানের দাম খুবই কম।

শেরপুর : ধানের জেলা শেরপুর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ধান কাটা। জেলার কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, এবার শেরপুর জেলায় ৮৯ হাজার ৩৫৫ একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৩৯৫ টন। কৃষি বিভাগ মনে করে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ধান উৎপাদন হবে। তবে জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলনেও দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক।

পাকুরিয়ার কৃষক কালু মিয়া জানান, জমির ব্যবহারমূল্য ছাড়াই এক মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ৭০০ টাকার ওপরে আর বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫২০ টাকায়। একই এলাকার কৃষক ফারুক মিয়া জানান, ‘৪ একর জমিতে ধান করেছি। খরচ হয়েছে ১ লাখ টাকা। বর্তমান দামে ধান বিক্রি করলে ৮০ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। ধানের দাম কম থাকলেও একজন মজুরকে ৫০০ টাকার নিচে কাজে পাওয়া যায় না। কয়েক বছর ধরে আবাদ করে লোকসান গুনছি। আগামীতে আর আবাদ করব না।’ ঝিনাইগাতীর কৃষক কাফিউদ্দিন জানান, ‘সব কিছুর দাম বেড়েছে, কমেছে শুধু ধানের। ধানের দাম কম হলেও কেউ কিনতে চাচ্ছে না। বাকিতে ফড়িয়াদের কাছে কোনোরকম ধান গছিয়ে দিচ্ছি। আমরা আবাদ করে যেন পাপ করে ফেলেছি।’

নওগাঁ : নওগাঁয় ধানের দাম নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কৃষক। জেলায় ধানের বাম্পার ফলন হলেও দাম কমে যাওয়ায় হতাশ তারা। পত্নীতলা উপজেলার ঘোষনগর গ্রামের মনজুর এলাহী জানান, ‘এবার প্রতি বিঘা জমির ভাড়াসহ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘায় শুধু ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে মণপ্রতি ৭৫০ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে ধানের মূল্য ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। যদি ধানের মূল্য বৃদ্ধি করা না হয় তাহলে ধান বিক্রি করে কৃষক লাভের পরিবর্তে লোকসানে পড়বেন।’

রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামের কৃষক আজিজার রহমান জানান, ইরি-বোরোর এ মৌসুমে তার ২৫ বিঘা জমিতে জিরাশাইল ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ শুরু করেছেন। এ পর্যন্ত বিঘাপ্রতি গড়ে ২২ মণ করে ধান পেয়েছেন। কিন্তু ধানের দাম কমে যাওয়ায় হতাশ তিনি। আত্রাই উপজেলার সুদরানা গ্রামের কৃষক আজাদ হোসেন বলেন, প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে তিনি এ মৌসুমে জিরাশাইলসহ বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড ধান চাষ করেছেন। কোনো রোগবালাই ছাড়াই ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে কিন্তু শঙ্কা হচ্ছে ধানের মূল্য নিয়ে। তিনি বলেন, ‘সরকার সরাসরি আমাদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করলে আমরা একটু হলেও লাভবান হব। বর্তমানে ধানের বাজারে দামের যে পতন তাতে কৃষক লোকসানের মুখে পড়বেন। তাই আমাদের মতো কৃষকের কথা ভেবে সরকারের উচিত ধানের মূল্য বাড়ানো। তা না হলে কৃষক মাঠে মারা যাবেন।’

কিশোরগঞ্জ : ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় কিশোরগঞ্জের কৃষক চরম বিপদে পড়েছেন। খেতমজুর সংকট, ধান কাটা ও পরিবহন খরচ তিন-চার গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যে চরম হতাশা বাড়ছে। সরকারি ক্রয় কেন্দ্রগুলোয় ধান সংগ্রহ শুরু হয়নি। এলাকায় কোনো ক্রেতা নেই। ফড়িয়া-বেপারিরা অসহায় কৃষকের কাছ থেকে বর্তমানে প্রতি মণ ধান ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে খরিদ করছেন। চলতি মৌসুমে ইটনা উপজেলায় কৃষক ২৩ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে উন্নয়নশীল ধানের আবাদ করেছেন। বাম্পার ফলনও হয়েছে। একমাত্র বোরো উৎপাদন এ উপজেলার ৮০-৮৫ ভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহের উৎস। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ভূমিহীন, খেতমজুর, ছোট ও মাঝারি কৃষক, প্রান্তিক ও বর্গাচাষি। প্রতি মণ ধান ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। উৎপাদন খরচ আরও অনেক বেশি।

বরিশাল : ধানের দেশ বরিশালে এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলনে কৃষকের মুখে হাসি থাকলেও হতাশায় বিলীন হচ্ছে সে হাসি। ধান বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় পড়ছেন। মাঠ প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে ধান মাড়াই পর্যন্ত খরচ বাদ দিলে বোরো মৌসুমে লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জানিয়েছেন কৃষক। ফলে তারা হতাশায় ভুগছেন। সরকার প্রকৃত অবস্থা বিবেচনা করে ধানের নতুন দাম নির্ধারণ না করলে আগামীতে ধান রোপণে কৃষক নিরুৎসাহিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আজিজ ফরাজি জানান, বিভাগের ছয় জেলায় এবার ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। তবে সরকার এ মৌসুমের জন্য এখনো ধানের মূল্য নির্ধারণ করেনি। মে মাসের মধ্যেই দাম নির্ধারণ হতে পারে।

গৌরনদীর মাহিলাড়া এলাকার কৃষক দেলোয়ার হোসেন দুলাল জানান, এবার ১ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান উৎপাদনে মাঠ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। উচ্চফলনশীল ও স্থানীয় জাতের ধান উৎপাদনেও প্রতি হেক্টরে খরচ হয়েছে ৪৪ হাজার টাকা। হেক্টরপ্রতি হাইব্রিড জাত ধানের ফলন হয়েছে ১৮৭ মণ এবং উচ্চফলনশীল ধানের উৎপাদন হয়েছে ১৪৪ থেকে ১৫০ মণ। খেত থেকে ধান কাটার জন্য চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের তিন বেলা ভালো খাবার খাওয়ানোর পরও প্রতি ১৫ মণে ২ মণ ধান দিতে হয় তাদের। এরপর মাড়াইশ্রমিকদের প্রতি ১৫ মণে দিতে হয় ৩০ কেজি করে ধান। এরপর প্রতি মণ কাঁচা হাইব্রিড ধান ৪০০ টাকা এবং উচ্চফলনশীল ও স্থানীয় জাতের ধান বিক্রি করতে হয় ৫০০ টাকা মণ দরে। এ কারণে খরচ বাদ দিয়ে কিছুই থাকে না বলে তিনি জানান।

কৃষক আবদুর রহিম, মো. বাদশা জানান, মণপ্রতি কাঁচা ধানের দাম বাজারে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা হলে কিছুটা লাভ থাকত। এখন তাদের লোকসান হচ্ছে। এভাবে লোকসান হলে আগামীতে ধানের আবাদ কমিয়ে আনা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

দিনাজপুর : উত্তরাঞ্চলরের শস্যভাণ্ডার দিনাজপুরে আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। ফসল ঘরে তোলার আগেই পোকার আক্রমণ, সার-বীজ, কীটনাশক এবং বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণে খরচ বৃদ্ধিতেই নাকাল তারা। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এ অবস্থা হয় কৃষকের। আমন ধান কাটা, মাড়াই শেষে প্রতি মণ ধান ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন বলে জানালেন জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার নওগাঁ গ্রামের কৃষক কামরুল হাসান। উৎপাদন খরচ আরও অন্তত ২০০ টাকা বেশি। বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নের দামাইক্ষেত্র গ্রামের বর্গাচাষি শাহজাহান সিরাজ বুলবুল জানান, প্রতি বিঘা জমি আবাদ করতে সার-বীজ, কীটনাশক এবং বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণসহ অন্যান্য খরচ পড়ে ৭ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি জমির মালিককে দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। সর্বমোট খরচ পড়ে ১৩ হাজার টাকা। জমিতে ধানের ফলন হয়েছে ২০ মণ। ৫০০ টাকা মণ দরে বিঘাপ্রতি ধানের মূল্য ১০ হাজার টাকা। খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। তাহলে কৃষক চলবেন কীভাবে?

চিরিরবন্দর উপজেলার নসরতপুরের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, এবার তিনি শুধু পারিজাত জাতের ধান আবাদ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ফলন পেয়েছেন প্রায় ১৫ মণ। যেখানে অন্যান্য জাতের ধান আবাদ করে পেতেন বিঘাপ্রতি মাত্র ৮ থেকে ১০ মণ। চাষ করে আয়-ব্যয় সমান।

আমবাড়ী এলাকার কৃষক আফসার আলী জানান, ‘আমি ৪ বিঘা জমিতে আগাম জাতের গুটি স্বর্ণার চাষ করেছি। ১ বিঘা জমির ধান কেটে পেয়েছি ১৮ মণ। খরচ হয়েছে প্রায় ১২ হাজার টাকা। প্রতি মণ ধান মাত্র ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছি।’

এদিকে দিনাজপুরে বোরো আবাদে হালচাষ, সার, মজুরি, কীটনাশক ও সেচের মূল্য বৃদ্ধিতে এবার বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে কৃষককে। গত বছরের চেয়ে প্রতি বিঘায় ২-৩ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। গত বছর ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এবার দুশ্চিন্তায় কৃষক। অবশ্য ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার জন্য সরকারের নীতিমালাকে দায়ী করছেন মিলার ও চাল ব্যবসায়ীরা। * প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের বিভাগীয় নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিরা।