রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রে ৩৩ বছরের অভিনয় জীবন তাঁর। কাজ করেছেন প্রায় সাড়ে তিন’শ ছবিতে। এর মধ্যে অসংখ্য ছবি হয়েছে দর্শকপ্রিয়। সবাই তাকে শ্রদ্ধাভরে ডাকে বুম্বাদা। এই বুম্বাদার অভিনীত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ভারতের প্রখ্যাত নির্মাতা গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘শঙ্খচিল’ মুক্তি পেয়েছে শুক্রবার। মুক্তির আগে মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছিলেন এখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎ ও ছবির প্রিমিয়ার শোতে অংশ নেয়ার জন্য। বিশেষ সাক্ষাৎ ও কিছু মুহূর্তের অবসরে পূর্বপশ্চিমের মুখোমুখি হয়েছিলেন এই অভিনেতা। বলেছেন মুক্তি পেতে যাওয়া এই ছবিটি নিয়ে নানা কথা। জানিয়েছেন চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সৈয়দ নূর-ই-আলম। ছবি তুলেছেন দ্বীপময় চৌধুরী ডিউক। এই আলাপচারিতার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
মুক্তির আগেই জাতীয় পুরস্কার পেলো ‘শঙ্খচিল’ ছবিটি, অনুভূতি কেমন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কোন অর্জনেই অনুভূতি খারাপ হয় না। কিন্তু এই ছবির অর্জনে আমি একটু বেশি আনন্দিত। এটি নিয়ে আমার বিশেষ আবেগ আছে। আমার পছন্দের এই ছবিটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছে এটা আসলে আমার কাছে বড় একটি ঘটনাই।
বড় ঘটনা বলছেন, বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করবেন…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বড় ঘটনা এজন্যই বলছি যে, ছবিটা আসলে একটা আবেগ-অনুভূতির গল্প। একটি পরিবারের গল্প। বিশ্বের সার্বজনীন সীমান্ত সমস্যার গল্প। সীমান্তবর্তী মানুষের জীবন-যাপন ও তাদের দু:খ -কষ্টের গল্প। একই সংস্কৃতির মানুষজন কিভাবে সীমারেখার কারণে আলাদা হয়ে যায় এবং তাতে সৃষ্ট সমস্যার কথা উঠে আসার গল্প। ছবিটি বাংলাভাগে বাঙালীর বেদনার গল্প। এতে অভিনয় করতে পেরে নিজেও গর্বিত বলতে পারেন। এটা আমার ক্যারিয়ারের বিশেষ একটা ছবি। এজন্যই এই ছবির জাতীয় পুরস্কার অর্জন আমার জন্য বড় একটি ঘটনা। ছবিটি দেখে পশ্চিমবাংলার মানুষও ভূয়সী প্রশংসা করছেন। বিশেষ করে সোমবার (১১ এপ্রিল) পশ্চিমবাংলার গভর্নর ছবিটি দেখেছেন। ওনার প্রথম ১০ মিনিট দেখার কথা ছিল কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ ছবি দেখা শেষ করেই উঠেছেন। এবং চোখে জল নিয়েই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন।
ছবিটিতে অভিনয়ে অভিজ্ঞতার কথা বলুন…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: একজন অভিনেতার জন্য বড় পাওয়া তার অভিনয় জীবনের টুকরো টুকরো সুখস্মৃতিগুলো। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই অনেক সুখস্মৃতি রয়েছে। পশ্চিম বাংলার মতো এখানেও যে আমাকে সবাই ভালোবাসেন এটা স্বচক্ষে দেখেছি। ওখানকার মতো এখানেও বাপ-মা-ছেলে-মেয়ে সবাই আমাকে বুম্বাদা বলে ডাকেন। আমি অনেক আনন্দ পেয়েছি। সাতক্ষীরার যে জায়গায় আমাদের শুটিং ছিলো সেখানে যাওয়ার পথে এমনকি রাতেও আমরা যখন গাড়ি করে যেতাম তখন মেয়েরা সবাই বেনারশী শাড়ি পড়ে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকতো। আমাকে দেখার জন্য। এটা কিন্তু আমার জন্য অনেক মজার ছিলো(একটু হেসে)।
ছবিতে আপনার কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করতে দেখা গেছে…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কবিতা আবৃত্তি করেছি এমন ছবি আমার নেই। কবিতা আবৃত্তির জন্য আমাকে ভালোই কষ্ট করতে হয়েছে। অবশ্য গৌতমদা এক্ষেত্রে দারুণ সহযোগিতা করেছে। ছবিতে কবিতার সংযোজন বাড়তি স্বাদ এনে দিয়েছে।
সহ-শিল্পীদের সম্পর্কে বলুন…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ছবিতে কুসুম শিকদার ও সাঁঝবাতিকে আমি বেশি নম্বর দেবো এ কারণে যে, অন্য যারা অভিনয় করেছে যেমন মামুনুর রশীদ, দীপঙ্কর দে, উষশী চক্রবর্তী ও প্রিয়াংশু এদের অভিনয় সম্পর্কে জানা ছিল। এ দুজনের অভিনয় সম্পর্কে জানা ছিল না। আমার স্ত্রীর ভূমিকায় কুসুম শিকদার দুর্দান্ত করেছে। আর সাঁঝবাতি অর্থাৎ রুপসা যাকে ছবিতে আমি চম্পকেশ্বরী নামে ডাকি তার অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। মনেই হয়নি এটা তার প্রথম ছবি। আমার সঙ্গে রূপসার একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। সে আমাকে বিভিন্ন উপহার দিতো আমিও তাকে উপহার দিতাম। শুধু মোবাইলটা দিতে পারিনি এখনও, তার বাবা-মায়ের বারণের কারণে।
পূর্বপশ্চিম: ‘মনের মানুষ’ থেকে ‘শঙ্খচিল’ এই দুটো দুই ঘরানার ছবি…দুই ধরণের চরিত্রধারণের অনুভূতি কেমন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ‘মনের মানুষ’ ছবিতে লালন চরিত্রে অভিনয়ে একটু ভীতই ছিলাম। কেননা লালন তো সার্বজনীন শ্রদ্ধার পাত্র। তাকে আমি কতটা ধারণ করতে পারবো নিজের মধ্যে এটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। অনেক সাধনা করেছি এই চরিত্রটি নিজের মধ্যে ধারণ করতে। গৌতমদা অনেক সহযোগিতা করেছে এক্ষেত্রে। ছবির শুটিং শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই চরিত্র থেকে বের হতে পারিনি। অন্য কথায় লালনকে পার করতে আমার অনেক সময় লেগেছে। এজন্য গৌতমদার পরবর্তী ছবিতে অভিনয়ে একটু সময় নিয়েছি। যদিও আমি উন্মুখ হয়ে থাকি তার ছবিতে অভিনয়ের জন্য।
তার মানে আপনি গৌতম ঘোষের ছবিতে অভিনয়ে চরিত্রের গভীরতার কারণে অভিনয় করেন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: গৌতমদা অবশ্যই একটা কারণ। ‘মনের মানুষ’তিনি এতোটাই সাফল্য পেয়েছেন যে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা ছবি নির্মাণ করতে পারতেন কিন্তু তা করেননি। এই ‘শঙ্খচিল’ নির্মাণ করতে পাঁচ বছর লাগিয়ে দিলেন। উনি এক জায়গায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই গল্পটা পান। বিষয়টা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ভিশনটা আমার মাথার মধ্যে চলে আসে। ছবি চলবে কি না জানি না। কিন্তু ‘শঙ্খচিল’ বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই ছবিতে অভিনয় করাটা আমার কাছে খুব সহজ ছিল না।
পূর্বপশ্চিম: ‘শঙ্খচিল’ বাংলাভাগের গল্প। এ ছবির সঙ্গে এখনকার দর্শক কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবে বলে মনে করেন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ছবিটি আসলে কোটি কোটি বাঙালির গল্প। এই প্রজন্মের কেউ যদি না-ও পারে, তাদের বাবা-মায়েরা পারবেন। এটি শুধু বাংলাদেশ-ভারত ক্রাইসিস নিয়ে নয়, সারা পৃথিবীই সীমান্তবর্তী মানুষের গল্প। সারা পৃথিবীর মানুষই বর্ডার ক্রাইসিসে ভুগছে। একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা এটা। ছবির আবেগ সব দর্শককেই স্পর্শ করবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষ করে ভারতের পক্ষ থেকে দুই দেশেই ছবি নির্মাণ ও বাজারজাতকরণের জন্য যে তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল সেই উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হয়েছে?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: আমি আসলে বাংলাদেশকে আলাদা দেশ হিসেবে মনে করি না। আমি মনে করি এটা আমার ভাষার আরেকটা অঞ্চল। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি দুই বাংলা মিলে আমরা ছবির নির্মাণ ও প্রযোজনা এবং বাজারজাতকরণ আরও শক্তিশালী ভাবেই করতে পারবো। দুই বাংলাতেই ছবি চলবে। এজন্য আমাদের প্রচেষ্টা নিরন্তর। এর নিদর্শন এই ‘শঙ্খচিল’।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে চলচ্চিত্রের নির্মাণের জন্য যে তোড়জোড় লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল ভারতে সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ততটাই অপারগ সেদেশের সরকার। যদিও ভারতে টিভি চ্যানেল খুব সহজে দেখছে এখানকার দর্শক..এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কথাটা ঠিক নয়। বাংলাদেশ থেকে যেকোনো কোম্পানি সেখানে টিভি চ্যানেল চালানোর অনুমতি নিয়ে তাদের অনুষ্ঠান চালাতে পারবে। এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম পালন করতে হবে। যেমন বিদেশী টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রে একটা পরিমাণ টাকা জমা দিতে হয় সরকারের কাছে। এছাড়া সেখানে টিভি চ্যানেল চালাতে পারবে কিনা এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে হবে।
আপনার কথা ঠিক, কিন্তু নিয়ম পালন করার পরও তো দেখা যায় অনুমতি দেয়া হচ্ছে না বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভারতে প্রচারের জন্য…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: নিয়ম পালন করলে কেন দিবে না। তাহলে অন্য কোন সমস্যা আছে।
মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘প্রাক্তন’ ছবির মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের সঙ্গে অভিনয় করলেন।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, দীর্ঘ ১৪ বছর পর। ঋতুপর্ণার সঙ্গে আমার অভিনয়ের রসায়নটা মেলে ভালো। আমার আর ঋতুর আলাদা দর্শক আছে।
মুক্তির তালিকায় থাকা বাংলা ‘জুলফিকর’ ও হিন্দি ‘থ্রিদেব’ নিয়ে বলুন…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ‘জুলফিকর’ অঁনসম্বল কাস্টের ছবি। অ্যাকশন আছে। কমলদা’র ছবিটা এগুলোর চেয়ে একেবারে আলাদা। গত ২০ বছরে বাংলায় এমন বোল্ড ছবি হয়নি। দেখলে মনে হবে বিদেশি ছবি। হিন্দি ছবিটা আমি ধরছি না। ওটা করে আমার ক্যারিয়ারে দারুণ কিছু সুবিধা হবে না। ওটা প্রমোট করার জন্য আদৌ সময় বের করতে পারব কি না, জানি না!
৩৩ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ার আপনার, দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ পর্যায়ে এসে কি মনে হচ্ছে আপনার, আপনি কি সফল?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: নিজেকে কখনোই সফল অভিনেতা আমি বলিনি। আমার দেখা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এই সময়ে আমূল পরিবর্তন এসেছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে চেষ্টা করেছি। এখন সিনেমাতে এতো ভেরিয়েশন যে নিজেকে এখনও অভিনয়ের ছাত্র মনে হয়।