হাওর বার্তা ডেস্কঃ দুই পাশে স্যালুট দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সৈয়দ খালেদ আহমেদ ও আবু জায়েদ রাহী, মাঝে হেঁটে আসছেন এবাদত হোসেন চৌধুরী- মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের পর এই ছবিটি সাড়া ফেলেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই ছবিটিকে বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের প্রতীকী চিত্রও বলা চলে। যেখানে আধিপত্য সিলেটের পেসারদের।
সাদা বলের ক্রিকেটে আরও অর্ধযুগ আগেই ঘরের মাঠে পর্যন্ত চার পেসার নিয়ে খেলার নজির দেখিয়েছে বাংলাদেশ দল। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে তাসকিন আহমেদ, রুবেল হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমানরা মিলে মিরপুর শেরে বাংলার নিচু ও ধীরগতির উইকেটেও একপ্রকার পেস বিপ্লবই ঘটিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রসঙ্গ যখন লাল বলের টেস্ট ক্রিকেট, তখন দেশের ইতিহাসের শুরু থেকেই আধিপত্য স্পিনারদের। অভিষেক টেস্টে অফস্পিনার নাইমুর রহমান দুর্জয় থেকে শুরু করে মোহাম্মদ রফিক, সাকিব আল হাসান, তাইজুল ইসলাম, মেহেদি হাসান মিরাজরাই সাদা পোশাকের ক্রিকেটে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের মূল কান্ডারি।
তবে ধীরে হলেও দৃঢ়তার সঙ্গে বদলাচ্ছে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের এই চিত্র। ২০১৩ সালে রবিউল ইসলামের পর ২০২১ পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের আর কোনো বোলার পাঁচ উইকেট নিতে পারেননি। অবশেষে চলতি বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফরের মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে ৬ উইকেট নিয়ে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছেন এবাদত হোসেন চৌধুরী।
বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক এবাদতের বাড়ি চায়ের শহর সিলেটের মৌলভীবাজারে। এবাদত ছাড়াও সিলেট থেকে উঠে আসা রাহী-খালেদরা এখন টেস্ট দলের নিয়মিত সদস্য।
আরেক তরুণ পেসার রেজাউর রহমান রাজাও সম্প্রতি ডাক পেয়েছেন স্কোয়াডে। এর বাইরে জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন রুয়েল মিয়া, তানজিম হাসান সাকিবরাও।
সবমিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের বড় একটা অংশই উঠে এসেছে সিলেট থেকে। স্পিনারদের আধিপত্যের ভিড়ে জাতীয় ক্রিকেট লিগে (এনসিএল) একমাত্র সিলেট বিভাগীয় দলেই থাকে পেসনির্ভর আক্রমণ। এবাদত-খালেদ-রাহীরা জাতীয় দলের দায়িত্বে ব্যস্ত থাকলে আক্রমণ সামলে নেন রাজা-তানজিমরা। পাশাপাশি স্থানীয়দের মধ্যে জয়নুল ইসলাম, আবিদুল হকরাও দেখাচ্ছেন আশা।
গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া এই পেস বিপ্লবের পেছনে সিলেটের পরিবেশ-প্রকৃতির বড় প্রভাব দেখছেন বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক ও সিলেট বিভাগীয় দলের কোচ রাজিন সালেহ। তার মতে, সিলেটের ছেলেরা সহজাতভাবেই প্রতিভাবান। সিলেটে চা বাগান ও পাহাড়ি এলাকার কারণে শারীরিকভাবেও শক্ত-পোক্ত থাকে ছেলেরা।
রাজিন বলছিলেন, ‘আফ্রিকান-ক্যারিবীয়রা যেমন শুরু থেকে সুঠাম গড়নের হয়ে থাকে, হয়তো জলবায়ুগত কারণে সিলেটের ছেলেদেরও ফিটনেস, স্ট্রেন্থ, স্ট্যামিনা ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালো থাকে, ওরা শুরু থেকেই শারীরিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়।’
তিনি আরও জানান, সিলেটে ব্যাটারদের তুলনায় বোলারদের প্রস্তুতির ক্ষেত্রটাও তুলনামূলক বিস্তৃত। যে কারণে আন্তর্জাতিক মঞ্চের জন্য তৈরি হওয়ার মতোই অনুশীলন করতে পারে বোলাররা।
প্রায় একই কথা বলেছেন সিলেট জেলার সহকারী কোচ মোহাম্মদ রানা মিয়াও। সিলেটের স্থানীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিগুলোত পেসারদের নিয়ে কাজ করার সুযোগটা বেশি এবং সীমিত ব্যবস্থার মধ্যেও বোলিং অনুশীলন চালিয়ে নেওয়া যায় বলে তরুণদের মধ্যে পেসার হওয়ার ঝোঁকটা বেশি বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া সিলেটে বয়সভিত্তিক পর্যায়েও বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয় পেস বোলিংয়ের ওপর।
এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে নতুন একটি তথ্য জানিয়ে রানা মিয়া বলেন, ‘আমরা সিলেটে জুনিয়র বোলারদের নিয়েও আলাদা কাজ করে থাকি। বিশেষ করে গত ৬-৭ বছর আগে অনূর্ধ্ব-১৪ পর্যায়ে আঞ্চলিক ক্রিকেটে প্রথম দশ ওভার বাধ্যতামূলক পেস বোলিং করানোর রীতি চালু করেছি আমরা। শুরুতেই স্পিন আক্রমণের পক্ষে নই আমরা।’
সিলেটের পেসারদের উত্থান নিয়ে কথা হয় জাতীয় দলের পেসার সৈয়দ খালেদ আহমেদের সঙ্গেও। নিজ এলাকায় টেপ টেনিসের গতির ঝড় তোলা ডানহাতি এ পেসার ক্রিকেট বলে নিজের জাত চেনাতে সময় নেননি তেমন। এর পেছনে বড় কারণ হিসেবে খেলোয়াড়ি ও ব্যক্তিজীবনে নিয়মের মধ্যে থাকার ওপরেই বেশি জোর দেন খালেদ।
শুধু তিনিই নন, সিলেটের পেসাররা সবাই নিজেদের ফিটনেস, খাদ্যাভ্যাস ও ব্যক্তিজীবনে সুশৃঙ্খল বলে জানান খালেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা পেসার যারা আছি, তাদের সবাই একটা বিষয়ে বিশেষ নজর দেই যে, আমাদের ফিটনেস যেন নষ্ট না হয়। তাই ঘুম থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, জিম সেশন, রানিং- এগুলো নিয়ম মেনে করি সবসময়।’
এসময় রাজিনের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে খালেদও জানান, ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য সিলেটে চা বাগান ও পাহাড়ি এলাকাগুলো তাদের অনেক সাহায্য করে, ‘আমাদের যখন রানিং থাকে, তখন মাঠে দৌড়াই। আবার যখন কন্ডিশনিং রানিং করতে হয় তখন চা বাগান বা পাহাড়ে চলে যাই দৌড়াতে। তাই ফিটনেসটা ঠিক থাকে। আমরা লম্বা সময় টানা বোলিং করে যেতে পারি।’
শুধু তাই নয়, সিলেটের উঠতি পেসারদের মধ্যে শেখার আগ্রহটাও বেশি। খালেদ বলছিলেন, ‘সিলেটে এলে যখন রানিংয়ের জন্য একাডেমিতে যাই, তখন ছোটরা আসে, বিভিন্ন পরামর্শ নেয়। আমিও চেষ্টা করি ওদেরকে কিছু জানাতে। একসময় আমরা জাতীয় দলের সিনিয়রদের কথা শুনতাম। এখন ওরাও আমাদের কথা শোনে। ভালো লাগে।’
সিলেট থেকে উঠে আসা পেসারদের দেখাদেখি সারাদেশেই পেস বোলিংয়ের একটা বিপ্লব ঘটবে বলে আশাবাদী রাজিন সালেহ। আগামী দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণে পেস-স্পিনের ভারসাম্য চলে আসবে বলে বিশ্বাস করেন সিলেটের পেস বিপ্লবের অন্যতম কারিগর রাজিন সালেহ, রানা মিয়ারা।
এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিসিবির পরিকল্পিত জাতীয় দলের ছায়া দল বাংলা টাইগার্স প্রোগ্রামেও পেস বোলিং নিয়ে বিশেষ কাজ করা হবে বলে জানালেন রাজিন সালেহ। যেখানে শুধু পেসারদের উন্নতি নিয়েই নয়, পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে ব্যাটারদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকেও নজর দেবেন রাজিন সালেহ, আফতাব আহমেদরা। এটি সফল হলে দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশ দলও পেস দিয়ে বিশ্ব মাতাবে, এমনটাই প্রত্যাশা।