ঢাকা ১১:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তেল আমদানি সরিষার সফলতা সাশ্রয় করবে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫১:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১
  • ১৮৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গত বছর প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করেছিলেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোগাপাড়া গ্রামে কৃষক লোকমান হোসেন। উচ্চ ফলনশীল বিনা জাতের সরিষার ফলন পেয়েছিলেন বিঘাপ্রতি সাত মণেরও বেশি। সেসময় বাজারে ভালো দাম পাওয়ার কারণে বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা লাভ হয় তার। তাই এ বছর আরও লাভের আশায় পাশের দুই বিঘা জমি ইজারা নিয়ে সাড়ে ৫ বিঘায় সরিষা আবাদ করেছেন লোকমান।

সরিষা চাষে নিজের অভিজ্ঞতার কথা  জানিয়েছেন লোকমান হোসেন।

তিনি বলেন, বাজার ভালো থাকায় প্রতি মণ সরিষা বিক্রি করা যায় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দরে। সরিষা আবাদে সময় ও সেচের প্রয়োজন কম। আবার বীজের কোনো সমস্যা হয় না। সব মিলিয়ে কম খরচে বেশি লাভের জন্য সরিষা এখন সেরা ফসল।

বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধিতে সরিষার ভালো দাম পাওয়া, উন্নত জাতের কারণে স্বল্প সময়ে অধিক ফলনের পাশাপাশি খরচ ও স্বল্প পরিশ্রমের কারণে এখন সরিষা চাষে বেশ আগ্রহী টাঙ্গাইলের অধিকাংশ কৃষক। এজন্য দেশের সরিষা উৎপাদনের অন্যতম জেলা এটি। এখন টাঙ্গাইলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সরিষা ফুলের হলুদ রঙের সমারোহ। পাশাপাশি ওই এলাকায় আবার সরিষার জমির পাশেই মৌ চাষের প্রচলন খুবই বেড়েছে। মাঠের পাশে বাক্স বসিয়ে মৌ চাষিরা মধুও সংগ্রহ করছেন। ফলে সরিষাচাষি ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হওয়ায় টাঙ্গাইলে সরিষা চাষ বেড়েছে।সরিষা চাষে লাভবান রাউজানের কৃষকরা - banglanews24.com

 

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর জেলায় ৪৫ হাজার ৭শ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৫০ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ করেছেন কৃষকরা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। প্রতিবছর এ জেলায় সরিষার চাষ বেড়েই চলেছে।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার  বলেন, গতবছর সরিষা বিক্রিতে কৃষকদের কোনো সমস্যা হয়নি, বরং খুব ভালো দাম পেয়েছেন তারা। আবার এখন উন্নত জাতের সরিষা বীজের কোনো সংকটও নেই। কৃষকরা বারি সরিষা-১৪ চাষ করছেন, সেটা কেটে আবার বোরো ধানও লাগানো যায়। ফলে আমন ও বোরোর মধ্যকার সময়টাতে সব পতিত জমিতে এখন সরিষার চাষ হচ্ছে।

তিনি বলেন, তেলবীজ উন্নয়নে সরকারের দুটি প্রকল্পের কারণে এ বছর কোথাও বীজের সমস্যা হয়নি। বরং বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা স্বল্পদামে, কোথাও বিনামূল্যে সরিষার বীজ পেয়েছেন।

আহসানুল বাসার জানান, গত বছর জেলায় ৫২ হাজার ৭৮৯ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদন হয়েছিল। এবছর সেই পরিমাণ ৬০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

শুধু টাঙ্গাইল নয়, সারা দেশেই এবছর সরিষার বাম্পার আবাদ হয়েছে। সার্বিকভাবে ফলনও বাম্পার হবে বলে আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ  বলেন, সরিষার বিষয়ে নিঃসন্দেহে এবার বাম্পার ফলনের আশা করা যায়। কারণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে। এখন যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ না হয়, তাহলে ফলনও ভালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে এবছর ৫ লাখ ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। গত বছর হয়েছিল ৫ লাখ ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে। সেখান থেকে ৭ লাখ ৮৭ হাজার টন সরিষা উৎপাদন হয়। এবছর উৎপাদন ৮ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

jagonews24

জনপ্রিয় হচ্ছে উন্নত জাতের সরিষা
কৃষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত জাতের সরিষার চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশেষ করে আমন ও বোরো চাষের মাঝামাঝি সময়টাতে পতিত জমিতে সরিষা চাষের একটি প্রচলন তৈরি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। যা সম্ভব হচ্ছে স্বল্প জীবনকালের ধান ও সরিষার জাত উদ্ভাবনের ফলে।

এর মধ্যে স্বল্প জীবনকালের আমন ধানের জাতগুলো কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসে স্বল্প জীবনকালের আমন ধান সংগ্রহের পর স্বল্প জীবনকালের অথচ উচ্চ ফলনশীল সরিষার জাত বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ ও বিনা সরিষা-১০, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫ এবং বারি সরিষা-১৭ চাষ করা হচ্ছে।

ফলে আমন ধানের পরে ওই পতিত জমিতে স্বল্প সময়ে সরিষার আবাদ হচ্ছে। পরে এ শস্য বিন্যাসটি পর্যায়ক্রমে রোপা-আমন-সরিষা-বোরোশস্য বিন্যাসে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ শস্য বিন্যাসে প্রতিকূলতা সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল বিনা সরিষা-৯ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আরও বেশি জমিতে সরিষা আবাদসহ উচ্চ ফলনের মাধ্যমে সরিষার উৎপাদন বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ উদ্ভাবনগুলো জনপ্রিয় করতে কাজ করছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)।

এ বিষয়ে বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম  বলেন, স্বল্প সময়ের জাতগুলো ফলনের পাশাপাশি কৃষকের আয়ও বাড়াচ্ছে। ফলে এতে আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে।

তিনি বলেন, দেশের প্রধান তেলবীজ সরিষার আবাদ বাড়ানো সম্ভব হলে একদিকে ভোজ্যতেলের বিশাল সংকট কেটে যাবে, অন্যদিকে তেলের জন্য সরকারকে প্রতিবছর খরচ করতে হয় ২৭ থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকার বিপুল ভার, যা সাশ্রয় হবে।

উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করছে দুটি প্রকল্প
দেশে সব ধরনের ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য গত বছর ২৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।

jagonews24

এ প্রকল্পে ২০২৫ সালের মধ্যে তেলজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ এবং উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ ও আমদানি ব্যয় কমানোই ওই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পটি বর্তমান তেলবীজ (সরিষা, তিল, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, সয়াবিন) আবাদি এলাকা ৭ দশমিক ২৪ লাখ হেক্টর থেকে বাড়িয়ে ১৫ থেকে ২০ হেক্টরে উন্নীত করার উদ্দেশ্যে কাজ করছে।

এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত তেলবীজের আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, মৌ-চাষ অন্তর্ভুক্ত করে তেলজাতীয় বীজের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ানো, ব্লকভিত্তিক কৃষক দল (৭ হাজার ৫৭২টি) গঠনের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার ও টেকসই করা, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত প্রজনন বীজ ব্যবহার করে প্রকল্প মেয়াদে বিএডিসির ১ হাজার ৫২ দশমিক ৩২ টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করায় কাজ করছে প্রকল্পটি।

এছাড়া ‘কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ’ প্রকল্পের মাধ্যমেও তেলের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে এ প্রকল্প তেলের জন্য একক নয়। এতে ডাল ও মসলাযুক্ত রয়েছে। প্রকল্পটির চলমান তৃতীয় পর্যায় (১ম সংশোধিত) শেষ হবে আগামী বছর।

জানা যায়, ২০১৭ সালে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের মূল কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৩ সালের মধ্যে তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৭ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করতে সম্ভব হবে।

প্রকল্পটির পরিচালক খায়রুল আলম  বলেন, এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে বীজ উদ্যোক্তা তৈরি, সেটা সম্ভব হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার বীজ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তাদের আমরা ক্ষুদ্র-মাঝারি বীজ উদ্যোক্তা বলছি। এজন্য এবছর তেলবীজের কোনো সংকট নেই।

‘প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। তাদের বীজের জন্য রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। তারা শুধু বীজ উৎপাদন নয়, নিজেরা বীজ সংরক্ষণ ও বাজারজাত করছেন। তেলবীজসহ অন্য বীজ উৎপাদনে প্রকল্পটি অত্যন্ত কার্যকর হয়েছে।

jagonews24

চাহিদাও বাড়ছে দ্রুত
২০০৯ সালে তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টনে।

দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদার ৯০ শতাংশ আসে বিদেশ থেকে আর দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে বিদেশ থেকে প্রায় ৪৭ লাখ মেট্রিক টন তেল আমদানি করতে হয়েছে, যার পেছনে ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ৮শ কোটি টাকা।

দেশে ২০১৫ সালে তেল ও চর্বি ব্যবহারের পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ২২ মিলিয়ন টন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৮ মিলিয়ন টন। মাথাপিছু তেল ও চর্বি ব্যবহারের পরিমাণ বছরে ২০১৫ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৮০ কেজি, তা বেড়ে ২০১৯ সালে হয়েছে ১৮ দশমিক ৭ কেজি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

তেল আমদানি সরিষার সফলতা সাশ্রয় করবে

আপডেট টাইম : ১১:৫১:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গত বছর প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করেছিলেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোগাপাড়া গ্রামে কৃষক লোকমান হোসেন। উচ্চ ফলনশীল বিনা জাতের সরিষার ফলন পেয়েছিলেন বিঘাপ্রতি সাত মণেরও বেশি। সেসময় বাজারে ভালো দাম পাওয়ার কারণে বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা লাভ হয় তার। তাই এ বছর আরও লাভের আশায় পাশের দুই বিঘা জমি ইজারা নিয়ে সাড়ে ৫ বিঘায় সরিষা আবাদ করেছেন লোকমান।

সরিষা চাষে নিজের অভিজ্ঞতার কথা  জানিয়েছেন লোকমান হোসেন।

তিনি বলেন, বাজার ভালো থাকায় প্রতি মণ সরিষা বিক্রি করা যায় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দরে। সরিষা আবাদে সময় ও সেচের প্রয়োজন কম। আবার বীজের কোনো সমস্যা হয় না। সব মিলিয়ে কম খরচে বেশি লাভের জন্য সরিষা এখন সেরা ফসল।

বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধিতে সরিষার ভালো দাম পাওয়া, উন্নত জাতের কারণে স্বল্প সময়ে অধিক ফলনের পাশাপাশি খরচ ও স্বল্প পরিশ্রমের কারণে এখন সরিষা চাষে বেশ আগ্রহী টাঙ্গাইলের অধিকাংশ কৃষক। এজন্য দেশের সরিষা উৎপাদনের অন্যতম জেলা এটি। এখন টাঙ্গাইলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সরিষা ফুলের হলুদ রঙের সমারোহ। পাশাপাশি ওই এলাকায় আবার সরিষার জমির পাশেই মৌ চাষের প্রচলন খুবই বেড়েছে। মাঠের পাশে বাক্স বসিয়ে মৌ চাষিরা মধুও সংগ্রহ করছেন। ফলে সরিষাচাষি ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হওয়ায় টাঙ্গাইলে সরিষা চাষ বেড়েছে।সরিষা চাষে লাভবান রাউজানের কৃষকরা - banglanews24.com

 

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর জেলায় ৪৫ হাজার ৭শ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৫০ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ করেছেন কৃষকরা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। প্রতিবছর এ জেলায় সরিষার চাষ বেড়েই চলেছে।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার  বলেন, গতবছর সরিষা বিক্রিতে কৃষকদের কোনো সমস্যা হয়নি, বরং খুব ভালো দাম পেয়েছেন তারা। আবার এখন উন্নত জাতের সরিষা বীজের কোনো সংকটও নেই। কৃষকরা বারি সরিষা-১৪ চাষ করছেন, সেটা কেটে আবার বোরো ধানও লাগানো যায়। ফলে আমন ও বোরোর মধ্যকার সময়টাতে সব পতিত জমিতে এখন সরিষার চাষ হচ্ছে।

তিনি বলেন, তেলবীজ উন্নয়নে সরকারের দুটি প্রকল্পের কারণে এ বছর কোথাও বীজের সমস্যা হয়নি। বরং বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা স্বল্পদামে, কোথাও বিনামূল্যে সরিষার বীজ পেয়েছেন।

আহসানুল বাসার জানান, গত বছর জেলায় ৫২ হাজার ৭৮৯ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদন হয়েছিল। এবছর সেই পরিমাণ ৬০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

শুধু টাঙ্গাইল নয়, সারা দেশেই এবছর সরিষার বাম্পার আবাদ হয়েছে। সার্বিকভাবে ফলনও বাম্পার হবে বলে আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ  বলেন, সরিষার বিষয়ে নিঃসন্দেহে এবার বাম্পার ফলনের আশা করা যায়। কারণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে। এখন যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ না হয়, তাহলে ফলনও ভালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে এবছর ৫ লাখ ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। গত বছর হয়েছিল ৫ লাখ ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে। সেখান থেকে ৭ লাখ ৮৭ হাজার টন সরিষা উৎপাদন হয়। এবছর উৎপাদন ৮ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

jagonews24

জনপ্রিয় হচ্ছে উন্নত জাতের সরিষা
কৃষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত জাতের সরিষার চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশেষ করে আমন ও বোরো চাষের মাঝামাঝি সময়টাতে পতিত জমিতে সরিষা চাষের একটি প্রচলন তৈরি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। যা সম্ভব হচ্ছে স্বল্প জীবনকালের ধান ও সরিষার জাত উদ্ভাবনের ফলে।

এর মধ্যে স্বল্প জীবনকালের আমন ধানের জাতগুলো কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসে স্বল্প জীবনকালের আমন ধান সংগ্রহের পর স্বল্প জীবনকালের অথচ উচ্চ ফলনশীল সরিষার জাত বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ ও বিনা সরিষা-১০, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫ এবং বারি সরিষা-১৭ চাষ করা হচ্ছে।

ফলে আমন ধানের পরে ওই পতিত জমিতে স্বল্প সময়ে সরিষার আবাদ হচ্ছে। পরে এ শস্য বিন্যাসটি পর্যায়ক্রমে রোপা-আমন-সরিষা-বোরোশস্য বিন্যাসে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ শস্য বিন্যাসে প্রতিকূলতা সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল বিনা সরিষা-৯ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আরও বেশি জমিতে সরিষা আবাদসহ উচ্চ ফলনের মাধ্যমে সরিষার উৎপাদন বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ উদ্ভাবনগুলো জনপ্রিয় করতে কাজ করছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)।

এ বিষয়ে বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম  বলেন, স্বল্প সময়ের জাতগুলো ফলনের পাশাপাশি কৃষকের আয়ও বাড়াচ্ছে। ফলে এতে আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে।

তিনি বলেন, দেশের প্রধান তেলবীজ সরিষার আবাদ বাড়ানো সম্ভব হলে একদিকে ভোজ্যতেলের বিশাল সংকট কেটে যাবে, অন্যদিকে তেলের জন্য সরকারকে প্রতিবছর খরচ করতে হয় ২৭ থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকার বিপুল ভার, যা সাশ্রয় হবে।

উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করছে দুটি প্রকল্প
দেশে সব ধরনের ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য গত বছর ২৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।

jagonews24

এ প্রকল্পে ২০২৫ সালের মধ্যে তেলজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ এবং উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ ও আমদানি ব্যয় কমানোই ওই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পটি বর্তমান তেলবীজ (সরিষা, তিল, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, সয়াবিন) আবাদি এলাকা ৭ দশমিক ২৪ লাখ হেক্টর থেকে বাড়িয়ে ১৫ থেকে ২০ হেক্টরে উন্নীত করার উদ্দেশ্যে কাজ করছে।

এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত তেলবীজের আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, মৌ-চাষ অন্তর্ভুক্ত করে তেলজাতীয় বীজের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ানো, ব্লকভিত্তিক কৃষক দল (৭ হাজার ৫৭২টি) গঠনের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার ও টেকসই করা, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত প্রজনন বীজ ব্যবহার করে প্রকল্প মেয়াদে বিএডিসির ১ হাজার ৫২ দশমিক ৩২ টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করায় কাজ করছে প্রকল্পটি।

এছাড়া ‘কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ’ প্রকল্পের মাধ্যমেও তেলের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে এ প্রকল্প তেলের জন্য একক নয়। এতে ডাল ও মসলাযুক্ত রয়েছে। প্রকল্পটির চলমান তৃতীয় পর্যায় (১ম সংশোধিত) শেষ হবে আগামী বছর।

জানা যায়, ২০১৭ সালে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের মূল কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৩ সালের মধ্যে তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৭ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করতে সম্ভব হবে।

প্রকল্পটির পরিচালক খায়রুল আলম  বলেন, এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে বীজ উদ্যোক্তা তৈরি, সেটা সম্ভব হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার বীজ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তাদের আমরা ক্ষুদ্র-মাঝারি বীজ উদ্যোক্তা বলছি। এজন্য এবছর তেলবীজের কোনো সংকট নেই।

‘প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। তাদের বীজের জন্য রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। তারা শুধু বীজ উৎপাদন নয়, নিজেরা বীজ সংরক্ষণ ও বাজারজাত করছেন। তেলবীজসহ অন্য বীজ উৎপাদনে প্রকল্পটি অত্যন্ত কার্যকর হয়েছে।

jagonews24

চাহিদাও বাড়ছে দ্রুত
২০০৯ সালে তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টনে।

দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদার ৯০ শতাংশ আসে বিদেশ থেকে আর দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে বিদেশ থেকে প্রায় ৪৭ লাখ মেট্রিক টন তেল আমদানি করতে হয়েছে, যার পেছনে ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ৮শ কোটি টাকা।

দেশে ২০১৫ সালে তেল ও চর্বি ব্যবহারের পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ২২ মিলিয়ন টন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৮ মিলিয়ন টন। মাথাপিছু তেল ও চর্বি ব্যবহারের পরিমাণ বছরে ২০১৫ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৮০ কেজি, তা বেড়ে ২০১৯ সালে হয়েছে ১৮ দশমিক ৭ কেজি।