হাওর বার্তা ডেস্কঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু হলো। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো, মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’ এই ভাষণ শুনে আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। তখনই মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার। তখন পরিবারও ছিল না আমার কাছে। তাই একাই দৃঢ় মনোবল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকেই দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম।কথাগুলো বলছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা অতিন চন্দ্র দাস। সঙ্গে আলাপকালে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা স্মৃতির কথা উল্লেখ করেন জেলার এই বীর সন্তান।
পাশাপাশি তিনি যুদ্ধের সময় অনুপ্রেরণা, যুদ্ধের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথাও বর্ণনা করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা অতিন চন্দ্র দাসের বয়স প্রায় ৭৫ বছর। তিনি নাটোরের বড়াইগ্রামের লক্ষ্মীকোল এলাকার নরেন চন্দ্র দাস ও বুলু বালা দাসে ছেলে। অতিন চন্দ্র দাসের ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে।
রণাঙ্গনে যাওয়ার গল্প
নিজের মধ্যে থাকা দেশপ্রেম ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। প্রথমে ভারতে ট্রেনিং শেষে বিমানে এসে প্যারাসুটে করে নামার সময় বাতাস আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে ২৪ ঘণ্টা প্যারাসুটেই ছিলাম। নামার কথা ছিল ময়মনসিংহে তবে বাতাসে দিক ভুল করে এসে পড়লাম নিজের গ্রামেই।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠল। এরপর দিন থেকেই বাঙালিরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। তখন যার যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী জনতা। অন্যায়, অবিচার, দুঃশাসন, হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের খতমে যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা প্রাণপণ লড়েছি।
তখন পরিবার আমার কাছে ছিল না, তাই কাউকে জানতেও পারেননি। এক খণ্ড স্বাধীন ভূখণ্ডের আশায় অচেনা পথে পা বাড়িয়েছিলেন অতিন চন্দ্র দাস। তখন তার বয়স ২৫ ছুঁইছুঁই। টগবগে তারুণ্যে উজ্জীবিত অতিন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাহসী দিকনির্দেশনায় তিনি যুদ্ধে যেতে মনস্থির করেছিলেন।
২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত্রির কথা মনে পড়লে চোখে ক্ষতবিক্ষত লাশের দৃশ্য ভেসে ওঠে। সেই রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব যারা দেখেনি, তাদের কোনোভাবেই হৃদয়বিদারক এ যুদ্ধ বোঝানো যাবে না। এভাবেই কথাগুলো বলতে বলতে কিছু সময় নীরব থাকেন অতিন চন্দ্র দাস।
প্রথমে ভারতে ট্রেনিং করি। তারপর বাংলাদেশে আসি এবং বাজশাহী বিভাগের ৭ নম্বর সেক্টরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুজ্জামান, কর্নেল উসমান, মেজন গিয়াস উদ্দিন নেতৃত্বে ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
তরুণদের প্রতি পরামর্শ
তরুণ প্রজন্মের কাছে চাওয়া-পাওয়া বলতে এটাই যে তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানুক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা ধারণ করুক। প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তারা সম্মান দিক। একটি দেশ কীভাবে পরাধীন থেকে স্বাধীন হলো, তা হৃদয়ে ধারণ করলে দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বাড়বে।
অনেকেই বলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভালো আছেন। কিন্তু বাস্তবে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভালো নেই। যারা মুক্তিযুদ্ধ না করেই মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, সার্টিফিকেট নিয়েছেন, তারাই ভালো রয়েছেন। যখন অমুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সামনে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে, তখন কষ্ট লাগে।
তবে অনেক কৃষক-শ্রমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সত্যিকারের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটা ভালো দিক। কষ্টের জায়গা হলো দিন দিন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কথা কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ছে। এর থেকে কষ্টের আর কিছু হতে পারে না।
বিজয়ের সংবাদ
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারাদেশের বেশির ভাগ এলাকা মুক্ত হয়ে বিজয় উল্লাস করলেও সেদিন নাটোর ছিল অবরুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর তখনো আমরা পাইনি। তখন আমরা যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম নাটোরকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। তখন একে একে সব মিশন শেষ করে সর্বশেষ একটা মিশনে নেমেছিলাম।
বিজয়ের পাঁচ দিন পর ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর অবরুদ্ধ নাটোরে আত্মসমর্পণ করে পাকবাহিনী। ১৯৭১ সালের এই দিনে নাটোরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন। সেদিন নাটোরের উত্তরা গণভবনে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান বাহিনী নাটোরের দিঘাপতিয়া গভর্নর হাউসে রাজশাহী বিভাগের সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করায় নাটোর হানাদারমুক্ত হয় পাঁচ দিন পর ২১ ডিসেম্বর। পাকিস্তান বাহিনীর উত্তরাঞ্চলের হেড কোয়ার্টার নাটোরে হওয়ায় ১৬ ডিসেম্বর থেকে এ অঞ্চলের পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের এখানে জড়ো করতে শুরু করা হয়।
২০ ডিসেম্বরের মধ্যে রাজশাহী, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও রংপর অঞ্চলের আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সব সেনাসদস্য এবং তাদের পরিত্যক্ত গোলা-বারুদ ও যানবাহনসহ নাটোরে নিয়ে আসা হয়। নাটোরের দিঘাপতিয়া গভর্নর হাউস, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজ, রানী ভবানী রাজবাড়ী, পিটিআই, ভিটিআই ও ফুলবাগান চত্বরে তাদের জড়ো করা হয়।
১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর দিঘাপতিয়া গভর্নর হাউসে পাকিস্তান বাহিনীর অফিসার ও জওয়ান মিলিয়ে ৭ হাজার ৬৯৫ সেনাসদস্যসহ তাদের হেফাজতে থাকা যানবাহন নিয়ে মেজর জেনারেল নজর হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্র বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল লসমন সিং এর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।